তায়েফ- নবীজির রক্তে সিক্ত মরু প্রান্তর

ডা. মোহাম্মদ ওমর ফারুক | রবিবার , ২৬ ডিসেম্বর, ২০২১ at ৫:০৮ পূর্বাহ্ণ

নবীজির দুধ মাতা হযরত হালিমাতুস্‌ সাদিয়া (রাঃ) এর জন্মস্থান তায়েফ সিটি থেকে ৭০ কিলোমিটার দূরে ঘনসবুজ গাছপালা পরিবেষ্ঠিত লোকালয় পরিদর্শন। শৈশবকালে নবীজির বক্ষবিদীর্ণ যেখানে হয়েছিল সে স্থানটি দেখার অপূর্ব সুযোগটা হয়েছিল কোন এক সময়। এলো সে মাহেন্দ্রক্ষণ। মক্কার আকাশটা যেন শুভ্রতায় ভরা। শাদা মেঘের ওড়াওড়ি- ফর্সা রোদের ঝিলিক উতলা করে মন, নবীজির দেশে আসাটা যেন এ’ গুনাহগার বান্দার ক্ষয়িষ্ণু সৌভাগ্য। যাঁরা প্রথম তায়েফ যাচ্ছেন তাদের মনে জাগে উষ্ণ আশা, আকাঙ্ক্ষা জাগে অনন্য উচ্চতায়। সূরা ইয়াছিনের ৭৭ নম্বর আয়াতে এই বিশাল সাম্রাজ্যের একচ্ছত্র অধিপতি মহান রাব্বুল আলামিন এভাবে বলছেন, ‘এ মানুষগুলো কি দেখে না যে, আমি তাদের একটি (ক্ষুদ্র) শুক্রকীট থেকে পয়দা করেছি, অথচ (ক্ষুদ্র কীটের) সে (ক্ষুদ্র মানুষটি একদিন আমার সৃষ্টির ব্যাপারে) খোলাখুলি বিতন্ডাকারী হয়ে পড়ল।’ ডারউইন এর বিবর্তনবাদ, ড.মরিস বুকাইলির সৃষ্টি রহস্য নিয়ে সন্দেহ ইত্যাদিকে মিথ্যা প্রমাণিত করে সুপ্রীম পাওয়ারে উদ্ভাসিত আল্‌-কোরআন। ড. বুকাইলি পবিত্র কোরআনের ভুল ধরতে গিয়ে নিজেই মহাসাগরের অতলে হারিয়ে গেলেন। আল্‌- কোরআন যে বিশাল সৃষ্টি যার কোন সীমারেখা নেই সেটি গবেষণা করতে গিয়ে তিনি রচনা করলেন পৃথিবীজোড়া খ্যাতির শীর্ষে থাকা গ্রন্থ কোরআন, বাইবেল ও বিজ্ঞান। ঘন্টা দেড়েকের মধ্যে আমরা পৌঁছি তায়েফ শহর, যে তায়েফ সিটির তাপমাত্রা আমাদের দেশের মতন। ১৭ থেকে ২০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা এখানে। পরিবেশটা খুব ভাল, ঝির ঝির বাতাসে তায়েফ সিটি কুর্নিশ জানায় যেন আমাদের এটি মক্কা প্রদেশের একটি শহর। জনসংখ্যা প্রায় ১২ লাখ। এটিকে সৌদি আরবের গ্রীষ্মকালীন রাজধানীও বলা হয়। শহরটি আঙ্গুর, ডালিম, ডুমুর, গোলাপ এবং মধু এর জন্যে অতিপরিচিত একটি কৃষি নির্ভর কেন্দ্র। তায়েফ সিটির বাসিন্দাদের মধ্যে প্রধানত সৌদি আরবের উপজাতিদের আধিক্য রয়েছে, তাছাড়াও এশিয়া, তুরস্ক এবং অন্যান্য আরবদেশ অধ্যুষিত জনগোষ্ঠীর উপস্থিতি এখানে রয়েছে। ৬ শতকে তায়েফ শহরটি বানু তাকাফ গোত্রের দ্বারা সমৃদ্ধ ছিল, যা আজও তায়েফ শহর এবং তার আশেপাশে বিদ্যমান। শহরটি মক্কা নগরীর ১০০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্বে অবস্থিত। তায়েফ সিটিতে বসবাসকারী মানুষদের সাথে মক্কা শহরে বসবাসকারী মানুষদের ঘনিষ্ঠ বাণিজ্য সম্পর্ক ছিল। তায়েফের বাসিন্দারা কৃষিপণ্য এবং ফলমূল উদ্ভাবন করে তাদের ব্যবসা কার্যক্রম চালিয়ে যেত। ১৯১৭ সালের ১৭ জুলাই অটোমান সাম্রাজ্যের কাছে শহরটি নিয়ন্ত্রণে আসে, যা তিন শতাব্দি ধরে অটোমানরা শাসন করেছিল। ১৯৪০ এর দশকের শেষের দিকে সৌদি আরবের প্রথম পাবলিক পাওয়ার জেনারেটরটি তায়েফে প্রতিষ্ঠিত হয়। বিচ্ছিন্ন শহর সড়ক নির্মাণের ক্ষেত্রে ১৯৬৫ সালে তৎকালীন রাজা ফয়সল মক্কা ও তায়েফের মধ্যে ৫৪ মাইলব্যাপী সড়ক উদ্বোধন করেন। ১৯৯১ সালের উপসাগরীয় যুদ্ধকালীন তায়েফ এমন একটি আধুনিক শহর ছিল যে, যোগাযোগের ক্ষেত্রে এটি রেনডন গ্রুপের টেলিভিশন এবং রেডিও নেটওয়ার্কের স্থান হিসেবে নির্বাচিত হয়েছিল। যা কুয়েতের সংবাদপত্রসমূহকে নিয়ন্ত্রণ করত। তায়েফের দক্ষিণে একটি বৃহত্তর প্রাকৃতিক পার্ক রয়েছে যার নাম আল্‌-রাদফ পার্ক, যেখানে বৃক্ষরাশি ও ঘ্রানাইট শিলা দ্বারা পরিবেষ্ঠিত থাকে। আমার রাসূল (সাঃ) ৬১৯ খ্রিষ্টাব্দে যখন এখানে এসেছিলেন আল্লাহর একত্ববাদ প্রচারের জন্য তখন ওয়াদি মিটনা নামক স্থানে আশ্রয় নিয়েছিলেন। তিনি দাওয়াতী কাজের মিশন নিয়ে ৭৫ কিলোমিটার পথ পায়ে হেঁটে হেঁটে তায়েফ গেলেন একজন মাত্র গোলাম সাথে নিয়ে। কিন্তু তায়েফ উপজাতিরা যুবক, কিশোরদের পাথরের বৃষ্টিতে আহত রাসূল (সাঃ) রক্তাক্ত হয়ে জমিনে লুটিয়ে পড়ে হুঁশহারা হয়ে যান, হুঁশ আসলে আবার তিনি দাঁড়াতে চেষ্টা করেন সাথে সাথে আবার পাথর মারা হয়েছে, রাসূলের শরীর অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে জর্জরিত হয়ে তাঁর পবিত্র রক্তে পায়ের জুতা পর্যন্ত জমাট বেঁধেছে, তিন তিনবার তিনি জ্ঞানহারা হয়েছেন তায়েফবাসীদের অমানবিক নির্যাতনে। শে’বে আবু তালিবের বন্দী জীবনে হযরত মোহাম্মদ (সাঃ) কি অবর্ণনীয় নির্যাতনের শিকার হয়েছেন তা সবাই অবগত আছেন, অনাহারে-অর্ধাহারে গাছের পাতা, পত্রগুল্ম খেয়ে এক নয়, দুই নয় পর পর তিনটি বছর কাটিয়েছেন নিষ্ঠুর বন্দীশালায়। কোরাইশ কাফেরদের ভয়ে এক রাতে কয়েকবার বিছানা পরিবর্তন করতে হয়েছে।
নিদ্রাহীন তিনটি বছর এভাবেই চলেছে রাসূল (সাঃ) এর জীবনে। আমাদের প্রিয়তম নবী মোহাম্মদ (সাঃ) এর মাথার উপর সূর্যের প্রচন্ড তাপদাহ যেমন আমার আল্লাহ তায়ালা সইতে পারেন না, একখন্ড কালো মেঘ যেন তাঁর মাথার উপর ধূ ধূ মরুপ্রান্তরে চলার সময় ছায়া বিস্তার করে রাখে। প্রচন্ড বালিঝড় চলছে বাইরে, মরুঝড় অতিক্রম করে রাসূল (সাঃ) আসলেন হযরত আয়েশার ঘরে। হযরত আয়েশা জিজ্ঞাসা করলেন, ‘হে আল্লাহর রসূল! আপনার দেহ মোবারকে কোন বালি নেই কেন? ‘হে আয়েশা, তুমি কি আমাকে চেন? আমি আল্লাহর সৃষ্টি সেই নূর, ধূলাবালি যাঁকে স্পর্শ করে না।’ নবীজির জীবনে এই ধরনের অনেক মুজেজা রয়েছে। আমার রাসূলের ব্যক্তি জীবনের বিষয়গুলো হয়তো আমরা আলাদাভাবে দেখতে পারি। কিন্তু দাওয়াতি কার্যক্রম করতে গিয়ে তিনি বার বার আঘাতে আঘাতে ক্ষতবিক্ষত হয়েছেন কিন্তু ঈমানের কঠোর পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছেন বারংবার। যেমনটি ঘটেছে তাঁর অন্যান্য সাহাবিদের বেলায়। এভাবে আমরা বলতে পারি-বদর, ওহুদ, হুনাইন এর বন্দী জীবনে নির্যাতনের কষাঘাতে আবর্তিত হয়েছেন তিনি। উম্মতি মোহাম্মদীর জন্য এ উদাহরণগুলো সামনে এগিয়ে যাওয়ার অপ্রতিরোধ্য আলোর মশাল হিসেবে কাজ করবে। আঁধারের ছায়া ভেদ করে রাসূল (সাঃ) এর উম্মত দৃপ্ত শপথ বুকে নিয়ে সামনে এগিয়ে যাওয়ার এইতো সময়। এ পথ দুর্গম, কণ্টকাকীর্ণ। এখানে নেই কোনো ফুলেল বিছানা, আছে শুধু বিস্তীর্ণ ধৈর্যের হিমালয় আর কারাগারের বেসুরো আওয়াজ।
লেখক : সভাপতি, রাউজান ক্লাব, সিনিয়র কনসালটেন্ট
(ইএনটি), জেনারেল হাসপাতাল, রাঙ্গামাটি

পূর্ববর্তী নিবন্ধবিনিময় নয় আত্মত্যাগ বা বিসর্জন
পরবর্তী নিবন্ধদেশ হতে দেশান্তরে