দেশ হতে দেশান্তরে

মহাপ্রাচীরে অন্ধের হস্তিদর্শন

সেলিম সোলায়মান | রবিবার , ২৯ জানুয়ারি, ২০২৩ at ৬:১৫ পূর্বাহ্ণ

কিন্তু বাবারা দেয়ালে লেখা কি ঠিক? একই সাথে দু’পুত্রের উদ্দেশ্যে করা এই জিজ্ঞাসার একটাই উত্তর এলো যুগল কণ্ঠে, তা হল– ‘না’।

এরই সাথে দেয়ালে নাম লেখার জন্য একটু আগে হাতে তুলে নেয়া ছোট্ট ইটের টুকরোটি বেশ বিমর্ষ মনে মাটিতে ছুড়ে দিল দীপ্র।

তাহলে চল হেঁটে আসা যাক সামনের দিকে। কে কে যাবে আমার সাথে বল তো দেখি? কোনো জোরাজুরি নেই। যে যে যেতে চাইবে না, সে সে এখানে বসে বিশ্রাম নিতে পারবে। এখানে বাতাসের ঝাপটাও নেই, অতএব ঠাণ্ডাও লাগবে না তেমন।

আমার এ ঘোষণায় সবাই কলরব করে হ্যাঁ বোধক উত্তর দেবার সাথে সাথে যার যার আসন ছেড়ে নড়েচড়ে উঠে প্রায় সবাই নিজেদের মহাপ্রাচীর অভিযানের প্রস্তুতি ঘোষণা করলেও, চুপচাপ নটনড়ন চড়ন থাকলো শুধু লাজুই। বোঝা গেল তীরে এসে তরী না ডোবানোর প্রবল প্রতিজ্ঞায় আর তুমুল সিড়িভঙ্গ পণে অতোগুলো সিঁড়ি ভাঙার পর, কিঞ্চিৎ বিগড়ে থাকা পা সম্ভবত এখন তার আরো হাঁটার ব্যাপারে অপারগতা প্রকাশ করছে।

প্রমাদ গুনলাম মনে মনে। এতোগুলো সিঁড়ি ভেঙে এখানে উঠার কারণে ওর ঐ আহত পা কতোটা যে বিগড়েছে, তা তো বুঝতে পারছি না। নামতে পারবে তো এখান থেকে হেঁটে হেঁটে নীচে? আচ্ছা এটা একটা কথা হল, এরকম একটা সপ্তাশ্চর্যের জায়গা দেখার নিমিত্তে উপরে উঠার জন্য হেঁটে আসা ছাড়া অন্য কোনো উপায় থাকবে না, এটা তো ঠিক না। সব টুরিস্টের কি একই রকম শারীরিক সক্ষমতা থাকবে নাকি যে সবাই অতোগুলো সিঁড়ি হেঁটে হেঁটে উঠতে পারবে? অতো টাকায় টিকিট কিনে কোনো পর্যটক যদি উঠতে না পারে, তাতে তো অবশ্য কর্তৃপক্ষের কোনো কিছু যায় আসে না। টাকা তো তারা পেয়েই গেছে। গচ্ছা তো যা গেল, তা পর্যটকের। উপরে উঠতে না পেরে তারা কি তখন শুধু উপরের দিকে চাতক পাখির ন্যায় দূরের ঐ মহাপ্রাচিরের আবছা চেহারা দেখেই ফিরে যায় নাকি?

আসলে ব্যবসার কাছে, পুঁজির কাছে লাভটাই তো মুখ্য না শুধু একমাত্র মোক্ষ ছিল একসময়। মহামতি কার্ল মার্ক্স পুঁজিপতিদের হৃদপিণ্ড মানে শিল্পোন্নত ইউরোপ জুড়ে তাদের কলজে কাঁপিয়ে দিয়ে পুঁজিবাদের ভিত্তি নাড়িয়ে না দিলে তো, পোস্ট ক্যাপিটালিজম নামের যুগটাও শুরু হতো না। নিজের জান বাঁচানোর জন্য পোস্ট ক্যাপিটালিস্ট সময়ে এসেই না লাভের বাইরেও কিছু কিছু সামাজিক দায় কাঁধে তুলে নিতে বাধ্য হয়েছিল পুঁজিবাদ। কিন্তু এখন তো চলছে কনজুমারিজমের যুগ; যেখানে ক্রেতাকেই বাধ্য হয়ে গুরু মানতে হয় পুঁজিকে, ব্যবসাকে। সেখানে একসময়ের সমাজতান্ত্রিক চায়নার এই মুতিয়ানি মহাপ্রাচিরের কর্তাব্যক্তিদের ক্রেতাসন্তুষ্টির ব্যাপারে এতোটা উপেক্ষার ভাব তো মেনে নেয়া যায় না। টিকিট কেটে ঢোকার পর কারো কোনো শারীরিক সমস্যার জন্য কেউ যদি মহাপ্রাচিরের উপরে উঠতে না পারে, তবে তার বা তাদের জন্য বিকল্প ব্যবস্থা রাখার দরকার ছিল। আমাদের দেশের রাজনীতি সচেতন মানুষদের মধ্যে একটা কথা প্রচলিত আছে যে, বাম পঁচলে এতোটাই পঁচে যে তার দুর্গন্ধে আশেপাশেও থাকা যায় না। এ কি তারই চায়নিজ ভার্সন নাকি?

কী ব্যাপার? দাঁড়িয়ে আছো কেন তুমি? কী ভাবছ? ওরা তো এগিয়ে গেছে। তুমিও যাও। আমি এখানেই বসে কিছুক্ষণ রেস্ট নিয়ে, তারপর একটু যাবো হাঁটতে’।

স্ত্রীর এই কথায় সম্বিৎ ফিরতেই ঘাড় ঘুরিয়ে দেখি, দুই ভাতুষ্পুত্রসমেত হেলেন প্রায় ১০০/১৫০ মিটার এগিয়ে গেছে মহাপ্রাচিরের উপরের হাঁটা পথ ধরে। এ মুহূর্তে চলছে তাদের ছবি তোলাতুলি। ঘুরে তাই দিলাম জোর হাঁটা সেদিকেই।

মহাপ্রাচিরের ঐ ঘুমটি ঘর থেকে বেরিয়ে খোলামেলা প্রাচীরের উপরে পা রেখেই টের পেলাম বেশ ভালই তোড় বাতাসের, এখানে। তবে এতোক্ষণ সিঁড়ি ভেঙে উপরে উঠার কারণে যে বাড়তি তাপ তৈরি হয়েছিল শরীরে, তিন চার স্তরের গরম কাপড় ভেদ করে তা বাইরের বাতাসে মিলিয়ে যেতে না পারায় শীত লাগছে না তেমন।

আচ্ছা ১৬ জন ঘোড়সওয়ার কি আসলেই পাশাপাশি থেকে মার্চ করে এগিয়ে যেতে পারবে এর উপর দিয়ে? পায়ের নীচের মহাপ্রাচিরের উপরে গ্রানাইট পাথরে নির্মিত চওড়া রাস্তাটি দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে মনে হল, না তা সম্ভব না। খুব জোর ১৪/১৫ ফুট চওড়া হবে প্রাচিরের উপরিতলের এই হাঁটা পথটি। ছোট বেলায় কোন বইয়ে যে পড়েছিলাম ঐ ব্যাপারটা। মহাপ্রাচীরের বিশালত্ব বোঝানোর জন্য, যে বর্ণনা দেয়া হয়েছিল, তাতে লেখা ছিল যে এই প্রাচীরের উপর দিয়ে একসাথে ১৬ জন ঘোড়সওয়ার সৈনিক নাকি এগিয়ে যেতে পারত। এখন স্বচক্ষে এই প্রাচীর অবলোকন করে মনে হচ্ছে ব্যাপারটি সেই লেখকের কল্পিতকল্পনার অতিরঞ্জন। সেই লেখক কি আসলেই এসেছিলেন এই মহাপ্রাচির দেখতে? দেখার পরই তা লিখেছিলেন কি তিনি? নাকি লিখেছিলেন এক্কেবারে অন্ধের হস্তিদর্শনের মতো না হলেও পরের মুখে ঝোল চেখে চেখে?

নাহ, ওরকম মনে করাটা আসলে ঠিক না। প্রায় ২৩০০ বছর ধরে নির্মাণ করা, ২১ হাজার কিলোমিটারের চেয়ে কিছুটা বেশি দৈর্ঘের এই প্রাচীরের আমরা তো এসেছি মুতিয়ানি অংশে মাত্র। রিজেন্ট হোটেলের কন্সিয়ার্জ কন্যা মিস রিনার কাছ থেকে পাওয়া বুকলেট মারফত জেনেছি যে মহাপ্রাচীরের এই অংশটি দুই কিলোমিটারের কিছুটা বেশি দীর্ঘ। যার মানে হল আমিই তো তাহলে করছি মহাপ্রাচীরে অন্ধের হস্তিদর্শন। দেখছি তো আমি মোটে এর হাজার ভাগের এক ভাগ। হতে পারে সেই যে লেখক, যিনি ঐ ১৬ ঘোড়সওয়ারের হিসাবটির অবতারণা করেছিলেন, তিনি হয়তো যে অংশ দেখেছিলেন সে অংশটি ঐরকমই চওড়া ছিল।

দাদা, দাদা তুই ওদের কে নিয়ে এখানটায় দাঁড়া তো, একটা ছবি তুলি তোদের তিনজনের’। পরিবারের আমার অগ্রবর্তী দলটির কাছে পৌঁছুতেই বলল হেলেন।

খুবই যৌক্তিক কথা। এরকম একটি ঐতিহাসিক জায়গায়, সকলে মিলে দাঁড়িয়ে ছবি তো তোলাই উচিৎ। ফলে ওরই নির্দেশনায় বেশ কিছু ছবি তোলা হল নানান ভঙ্গিতে নানান এঙ্গেল থেকে এখনাকার মহপ্রাচিরের নানান অংশে দাঁড়িয়ে। অতপর আমি তুলে দিলাম কিছু ছবি ভাতুষ্পুত্রদের সাথে হেলেনেরও। আবার সবাই মিলে তোলা হল যাকে বলে সমবেত নিজস্বীও। যেটিকে ইংরেজিতে আমি বলি ‘উইফি’। কিন্তু এখানে লাজু না থাকায় পূর্ণতা পাচ্ছে না সেই উইফি। ঠিক আছে ফিরে গিয়ে ওকে সহ তুলবো উইফি, ভাবলাম মনে মনে।

চলো চলো, এবার সামনে এগিয়ে যাই আরো। অনেক ছবি তোলা হয়েছে। বলে সবাইকে নিয়ে এখানকার পাহারগুলোর চড়াই উৎরাইয়ের সাথে তাল মিলিয়ে কিছুটা এঁকেবেঁকে সামনের দিকে গ্রানাইট পাথরের লম্বা চওড়া বুকটি চিতিয়ে শুয়ে থাকা মহাপ্রাচীরের বুকে পা ফেলে সামনে এগুতে এগুতে, পুত্রদের এ বিষয়ক জ্ঞান ঝালাই করা যাক ভেবে জিজ্ঞেস করলাম

আচ্ছা বাবারা, বলো তো এই এরকম একটা দেয়াল এতো কষ্ট করে পাহাড়ের উপরে কেন বানিয়েছিল চায়নিজরা শত শত না হাজার হাজার বছর আগে?

কেন বানাবে আর? সিকিউরটির জন্য বানিয়েছিল’ ঝটপট এই জবাব দিয়েই দীপ্র তাকাল অভ্রর দিকে, ভাবটা এমন যে আগে উত্তর দিয়ে সে জিতে গেছে। বড় ভাইয়ের উদ্দেশ্যমূলক এ চাহনিকে মোটেও পাত্তা না দিয়ে অভ্র দেখলাম উদাসভাবে দেখছে আশেপাশের সবুজ পেরিয়ে দূর দিগন্তের দিকে।

আচ্ছা এবার বলোতো, আমাদের দুপাশে যে উঁচু রেলিংগুলো আছে, সেই রেলিংগুলো একটু পর পর খাঁজ কাটা খাঁজ কাটা কেন? দেয়ালের গায়ে উপরের দিকটা খোলা এরকম জানালার মতো খাঁজ গুলো কেন বানিয়েছিল ওরা?

ওখানে দাদা দাঁড়িয়ে’ একটু আগে উদাস ভঙিতে দিগন্তের দিকে তাকিয়ে থাকা অভ্র এবার ভাইয়াকে হারানোর জন্য দ্রুত উত্তর দিতে শুরু করতেই, ওর সামান্য তোতলানোর দুর্বলতার সুযোগটি নিয়ে দীপ্র দ্রুত বলল

সোলজাররা ওখানে দাঁড়িয়ে, পাহাড়ের ঐ পাশ থেকে কোনো শ্‌ত্রু আছে কি না তা দেখতো। আবার হতে পারে ওখানে কামান বসানো থাকতো’।

নিজের সামান্য এই সীমাবদ্ধতায় এমনিতেই অভ্র কথা বলে কম। তদুপরি এখন এভাবে নিজের মুখের জবাব ছিনতাই হয়ে যাওয়ায় রেগে গিয়ে ভাইয়ার উপর চড়াও হতেই, দ্রুত দু’জনকে ছাড়িয়ে দুই দিকে দু’জনকে বগলদাবা করে এগুতে থাকলাম।

আচ্ছা, এখানে মানুষ জন এতো কম কেন’?

প্রশ্নের মতো মনে হলেও, এটা প্রশ্ন না ঠিক। হেলেনের এই স্বগত মন্তব্যে বুঝলাম যে, যতো আয়োজন করে এসেছি আমরা এখানে, আর এখানকার ঢোকার মুখে দাঁড়িয়ে থাকা বিশালাকায় গেইট, টিকিট ঘর এসবের আয়তন আর জৌলুসের সাথে, এতো কম ট্যুরিস্টের উপস্থিতি মোটেও যায় না। আমাদের আগে ঐ যে সামনের দিকে কিছু পর্যটককে দেখতে পেলেও, আমাদের পরে কেউ এদিকটায় উঠেছে বলে মনে হচ্ছে না। তারপরও ব্যাপারটা নিশ্চিত করার জন্য পেছন ফিরে তাকিয়েও কারোর দেখা পেলাম না। এমনকি লাজুও মনে হচ্ছে এখনো উঠেনি। বসেই আছে প্রায় আধা কিলোমিটার পেছনে ফেলে আসা সেই ঘুমটি ঘরে। আচ্ছা আজ কী বার?

কি যে বার তাও তো মনে করতে পারছি না। ছুটিতে বেড়াতে এসে সব দিনকেই তো আমার ছুটিবার মনে হচ্ছে। দিন তারিখ এসবের তো খেই হারিয়ে ফেলেছি। ছোঁয়াফোনের পর্দায় চোখ রাখলেই অবশ্য দিন আর তারিখের মিমাংসা হয়ে যায় নিমিষে। কিন্তু এখন তা করতে আলসেমি লাগছে। যতোটা মনে হচ্ছে আজ নিশ্চয় রোববার নয়। এখানে কি তবে ছুটির দিনেই মানুষ জড়ো হয় নাকি। এসময়ই মনে পড়লো, টিকিট ঘরের কাছ থেকে ব্যাটারিচালিত কিছু যাত্রীবাহি খোলা গাড়িতে চড়ে, অনেকেই অন্য কোনদিকে চলে যেতে দেখেছিলাম। আমাদের লি খাঁও ঐ গাড়িগুলোর দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করে ইশারা ইঙ্গিতের সাথে চায়নিজ আর টুক টাক চিংলিশ শব্দ মিলিয়ে কিছু একটা বলতে চাচ্ছিল, যা আমি পাত্তা দিইনি তখন। এখন তো মনে হচ্ছে, এই মহাপ্রাচিরের উঠার মতো এখান থেকে দূরে কোথাও অন্য কোনো স্পট আছে নিশ্চিত। আর সেই স্পটটাই হয়তো বেশি জনপ্রিয়।

নিজ ইচ্ছার বিরুদ্ধে এসময় হাঁটার গতি বেড়ে যাওয়ার সাথে, শরীরের ভারসাম্যের পরিবর্তন হতেই লক্ষ করলাম, হাঁটছি এখন প্রাচীরের ঢাল বেয়ে। পাহাড়ের ঢালের সাথে তাল মিলিয়ে প্রাচীরের এই অংশের বেশ অনেকটাই ঢালু হয়ে এগিয়ে গেছে সামনের দিকে। তখনি ‘এই অভ্র চল আমরা দৌড়াই’ দীপ্রর এই প্রস্তাবে অভ্র কিছু বলার আগেই বললাম, না না বাবারা, এখানে দৌঁড়ানো যাবে না। দেখছো কেমন ঢালু। এরকম ঢালু জায়গায় দৌঁড়াতে গিয়ে তাল সামলাতে না পেরে পড়ে গিয়ে হাত পা, কেটে ছিলে যাবে তোমাদের।

নাহ, আমি আর যাবো না সামনে। ঠাণ্ডা লাগছে। পাও ব্যথা করছে। এই মনু, বাচ্চা পিকাসো তোমরা কেউ যাবে কি আমার সাথে? এখানে তো আর দেখার কিছু নেই। বাকি সবই তো একই রকম। ফেরার সময় এই ঢাল বেয়ে উঠতেও কষ্ট হবে ‘হেলেনের এ কথায় সাড়া অভ্র সাড়া দিয়ে জানালো সেও ফিরে যেতে চায় সেই ঘুমটি ঘরের দিকে। সাথে এও জানাল যে তার খিদেও পেয়েছে একটু। ঠিক আছে তোমরা দু’জন চলে যাও। দীপ্র তুমিও যাবে নাকি। খিদে পায়নি তোমার। মা’র কাছেই গেলেই তো খাবার পাবে। ‘না বাবা, আমি তোমার সাথে যাবো। আমার খিদে পায়নি’ দীপ্রর সাফ জবাব। ফলে ওকে নিয়েই এগুতে থাকলাম দুই বাপবেটা প্রাচীন এই মহাপ্রাচিরের ঢালের অংশটি বেয়ে।

লেখক : প্রাবন্ধিক, ভ্রমণ সাহিত্যিক।

পূর্ববর্তী নিবন্ধকষ্টে নয় আশায় বাঁচবো
পরবর্তী নিবন্ধমুক্তিযুদ্ধের প্রত্যয়ী স্মৃতি ‘কাহিনি যুদ্ধের নয় জীবনের’