দেশে মৃত্যু ছাড়াল ১০ হাজার

১৫ দিনে মারা গেলেন এক হাজার করোনা রোগী ।। আক্রান্ত বেশি যুবকরা, মৃত্যু বেশি বয়স্কদের ।। দুই সপ্তাহ পর কমল শনাক্তের হার

আজাদী ডেস্ক | শুক্রবার , ১৬ এপ্রিল, ২০২১ at ৬:০৮ পূর্বাহ্ণ

গত এক দিনে ৯৪ জনের মৃত্যু হল করোনাভাইরাসে, যা নিয়ে দেশে মোট মৃতের সংখ্যা ১০ হাজারের বিষাদময় মাইলফলক ছাড়াল। গতকাল বৃহস্পতিবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এই তথ্য জানায়। দেশে করোনাভাইরাস সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউ শুরু হওয়ার পর হু হু করে মৃত্যু বাড়ায় গত ১৫ দিনেই দেশে এক হাজার রোগী মারা গেছেন। তবে সংক্রমণের বিস্তার রোধে কঠোর লকডাউনের মধ্যে দিনে শনাক্ত রোগীর সংখ্যা কমেছে। গত ২৪ ঘণ্টায় শনাক্ত হয়েছেন ৪ হাজার ১৯২ জন। সব মিলিয়ে আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৭ লাখ ৭ হাজার ৩৬২ জনে, যাদের মধ্যে অধিকাংশই যুবক। এর আগে টানা দুই সপ্তাহ ধরে দেশে করোনা শনাক্তের সংখ্যা ছিল ৫ হাজারের বেশি। যেটা গত ৭ এপ্রিল ছিল রেকর্ড ৭ হাজার ৬২৬ জন। এটাই এখন পর্যন্ত একদিনে সর্বোচ্চ শনাক্ত। গত দুই সপ্তাহের মধ্যে অধিকাংশ দিন শনাক্ত ছিল ৬ থেকে ৭ হাজারের উপরে। তবে গতকাল সেটি আবার ৪ হাজারে নামল। এর আগে গত ২৮ মার্চ ছিল ৩ হাজার ৯শ ৮ জন। খবর বিডিনিউজ ও বাংলানিউজের।
এদিকে একদিনে ৫ হাজার ৯১৫ জনের সেরে ওঠার তথ্যও জানানো হয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বিজ্ঞপ্তিতে। সব মিলিয়ে সুস্থ হয়ে উঠেছেন ৫ লাখ ৯৭ হাজার ২১৪ জন। গত ৩১ মার্চ ৫২ জনের মৃত্যুর পর থেকে দৈনিক মৃত্যু কখনোই ৫০ এর নিচে নামেনি। এর মধ্যে বুধবার একদিনে সর্বাধিক ৯৬ জনের মৃত্যু ঘটে।
তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউ শুরুর পর গত ১৫ দিনেই ১ হাজার কোভিড-১৯ রোগীর মৃত্যু ঘটেছে। প্রথম মৃত্যুর আড়াই মাস পর গত বছরের ১০ জুন মৃতের সংখ্যা ১ হাজার ছাড়িয়েছিল। এরপর ৫ জুলাই ২ হাজার, ২৮ জুলাই ৩ হাজার, ২৫ অগাস্ট ৪ হাজার, ২২ সেপ্টেম্বর ৫ হাজার ছাড়ায় মৃতের সংখ্যা। এরপর কমে আসে মৃত্যুর বাড়ার গতি। ৪ নভেম্বর ৬ হাজার, ১২ ডিসেম্বর ৭ হাজারের ঘর ছাড়ায় মৃত্যুর সংখ্যা। এ বছরের ২৩ জানুয়ারি ৮ হাজার এবং ৩১ মার্চ মোট মৃত্যুর সংখ্যা ৯ হাজার ছাড়িয়েছিল।
জনস হপকিন্স ইউনিভার্সিটির তালিকায় বিশ্বে শনাক্তের দিক থেকে ৩৩তম স্থানে আছে বাংলাদেশ, আর মৃতের সংখ্যায় রয়েছে ৩৮তম অবস্থানে। গত ২৪ ঘণ্টায় নমুনা পরীক্ষা বিবেচনায় শনাক্ত রোগীর হার ২০ দশমিক ৮৯ শতাংশ। এই পর্যন্ত শনাক্তের হার দাঁড়িয়েছে ১৩ দশমিক ৮৩। আর শনাক্ত রোগীদের মৃত্যুর হার দাঁড়িয়েছে ১ দশমিক ৪৩ শতাংশে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানিয়েছে, গত ২৪ ঘণ্টায় সারা দেশে ২৫৭টি ল্যাবে ১৯ হাজার ৯৫৯টি নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে। এ পর্যন্ত পরীক্ষা হয়েছে ৫১ লাখ ১৫ হাজার ৫৭২টি নমুনা।
গত এক দিনে যারা মারা গেছেন তাদের মধ্যে ৬৪ জন পুরুষ আর নারী ৩০ জন। তাদের মধ্যে ৪ জন বাড়িতে মারা গেছেন, বাকিদের মৃত্যু হয়েছে হাসপাতালে। মৃতদের মধ্যে ৫২ জনের বয়স ছিল ৬০ বছরের বেশি, ২৫ জনের বয়স ৫১ থেকে ৬০ বছর, ১৪ জনের বয়স ৪১ থেকে ৫০ বছর এবং ৩ জনের বয়স ৩১ থেকে ৪০ বছরের মধ্যে ছিল। মৃতদের মধ্যে ৬৯ জন ঢাকা বিভাগের, ১২ জন চট্টগ্রাম বিভাগের, ৬ জন রাজশাহী বিভাগের, ৩ খুলনা বিভাগের, ২ জন বরিশাল বিভাগের, ১ জন করে সিলেট ও রংপুর বিভাগের বাসিন্দা ছিলেন।
আক্রান্ত বেশি যুবকরা : আক্রান্ত ৭ লাখ মানুষের মধ্যে প্রায় চার লাখই যুবক, যাদের বয়স ২১ থেকে ৪০ বছরের মধ্যে। আর এ পর্যন্ত যে ১০ হাজারের বেশি মানুষ কোভিড-১৯ রোগে মারা গেছেন, তাদের ৮ হাজারের বেশির বয়স পঞ্চাশের বেশি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যুবকরা বাইরে বের হচ্ছে বেশি, তাই সংক্রমিতও বেশি হচ্ছে। আর নানা শারীরিক জটিলতার কারণে বয়স্কদের মৃত্যুর হার বেশি।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাবে গত বছরের মার্চে প্রাদুর্ভাবের পর বুধবার পর্যন্ত ৭ লাখ ৭ হাজার ৩৬২ জনের দেহে নতুন করোনাভাইরাস শনাক্ত হয়েছে। মারা গেছেন ১০ হাজার ৮১ জন।
সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান-আইইডিসিআরের ১৪ এপ্রিল পর্যন্ত বয়সভিত্তিক বিশ্লেষণে দেখা গেছে, আক্রান্তদের সবচেয়ে বেশি ৫৪ দশমিক ৭ শতাংশের বয়স ২১ থেকে ৪০ বছর। সংখ্যার হিসাবে তা ৩ লাখ ৮৪ হাজার ৬৩৪ জন। এদের মধ্যে ২৭ দশমিক ৬ শতাংশের (১ লাখ ৯৪ হাজার ৭৫) বয়স ২১ থেকে ৩০ বছর। ৩১ থেকে ৪০ বছর বয়সী ২৭ দশমিক ১ শতাংশ বা ১ লাখ ৯০ হাজার ৫৫৯ জন। শনাক্ত রোগীদের ২ দশমিক ৯ শতাংশের বয়স ১০ বছরের কম। ১১ থেকে ২০ বছর বয়সের ৭ দশমিক ৩ শতাংশ, ৪১ থেকে ৫০ বছর বয়সের ১৭ দশমিক ৩ শতাংশ, ৫১ থেকে ৬০ বছর বয়সের ১১ দশমিক ২ শতাংশ এবং ষাটোর্ধ্ব ৬ দশমিক ৭ শতাংশ।
করোনাভাইরাস আক্রান্ত হয়ে যে ১০ হাজার ৮১ জন মারা গেছেন, তাদের মধ্যে পঞ্চাশোর্ধ্ব মানুষই ৮০ দশমিক ৮৯ শতাংশ অর্থাৎ, ৮ হাজার ১৫৫ জন। মোট মৃত্যুর ৫৬ দশমিক ২৯ শতাংশ অর্থাৎ ৫ হাজার ৬৭৫ জনের বয়স ৬০ বছরের বেশি।
আইইডিসিআরের উপদেষ্টা ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, বয়স্কদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম থাকে, সারাবিশ্বেই বয়স্কদের মৃত্যুর হার বেশি। তিনি বলেন, যাদের কোমর্বিডিটি থাকে, তারা করোনাভাইরাসে বেশি সাফার করে এবং তাদের মৃত্যুর সংখ্যাও বেশি। বাংলাদেশে বয়স্কদের অনেকেই জানেই না তার ডায়াবেটিস আছে, হাইপারটেনশন আছে। এ কারণে আক্রান্ত হওয়ার পর বাসায়ই জটিলতা তৈরি হয়ে যায়। হাসপাতালে নিয়ে আসার পর আসলে কিছু করার থাকে না।
হেলথ অ্যান্ড হোপ স্পেশালাইজড হাসপাতালের এই পরিচালক ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, যারা মারা যাচ্ছেন, তাদের অধিকাংশের বয়স যেমন ৬০ এর বেশি, ঠিক তেমনি অধিকাংশের কিন্তু একাধিক রোগ রয়েছে। বয়সীদের মৃত্যুর বিষয়টি তিনি ব্যাখ্যা করেন এভাবে- ৬০ বছরের বেশি বয়সীদের কথা না বলে আমরা যদি বলতাম, যেসব মানুষের শরীরে প্রতিরোধী ব্যবস্থা কমে গেছে এবং অন্যান্য রোগ যেমন- ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, ক্যান্সার, ব্রঙ্কিওল অ্যাজমা রয়েছে এবং একইসাথে শরীরের প্রতিরোধ করার ক্ষমতা কিছুটা কমে গেছে, সেই মানুষগুলোই বেশি মারা যাচ্ছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার উপদেষ্টা ডা. বে-নজির আহমেদ মনে করেন, কম বয়সে শরীর চর্চার মতো অভ্যাসগুলো না থাকায় বয়স্করা বেশি মারা যাচ্ছেন করোনাভাইরাসে। তিনি বলেন, অনেক দেশ আছে যেখানে ৬০ বা তার বেশি বয়সে জটিল রোগ হয়ে থাকে। কিন্তু আমাদের দেশে দেখা যায়, ৩০ বছরের পরেই বহু মানুষই উচ্চ রক্তচাপ বা ডায়াবেটিসে ভুগছে। অনেকে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হচ্ছে অপেক্ষাকৃত কম বয়সে। আমরা শরীর চর্চা করি না। শরীরচর্চা করলে শক্তিমত্তা বেড়ে যায়, অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলো ভালো থাকে। সেটা আমাদের দেশে খুব কম হয়। আমাদের দেশে বয়স্ক মানুষেরা হয়ত হাঁটাহাঁটি করে বা ডায়াবেটিস যাদের রয়েছে, তারা হাঁটাহাঁটি করে, কিন্তু আমাদের কালচারে নিয়মিত ব্যায়াম করার বিষয়টি নেই।
তবে দেশে করোনাভাইরাসের দ্বিতীয় ঢেউয়ে অপেক্ষাকৃত তরুণরা যে বেশি সংক্রমিত হচ্ছে, সেটাও তুলে ধরেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক এই পরিচালক। তরুণদের মধ্যে হাসপাতালে ভর্তির সংখ্যা বেশি। তার মানে তারা মারাত্মকভাবে আক্রান্ত হচ্ছে। তবে তাদের মৃত্যুহার কম। ডা. মুশতাক বলেন, যুবকরা নানা কাজে বাসার বাইরে বের হয়। তারা সচল জনগোষ্ঠী, তাদের সংক্রমিত হওয়ার ঝুঁকি বেশি। যুবকদের মাধ্যমে বাড়ির বয়স্কদের আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি থাকার বিষয়টিও তুলে ধরেন তিনি। বাসার বয়স্করা যারা একদিনও বাইরে বের হয় না, তারাও আক্রান্ত হচ্ছে যুবকদের মাধ্যমে। যুবকরা জানেও না তাদের দ্বারা বয়স্করা আক্রান্ত হচ্ছে। এ কারণে যুবসমাজের চলাফেরায় সাবধানতা অবলম্বন করা, স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলায় আরও জোর দিতে হবে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধএবারও জৌলুসহীন ইফতার বাজার
পরবর্তী নিবন্ধমসজিদে বিশৃঙ্খলা ।। ৫ জামায়াত-শিবির কর্মী গ্রেপ্তার