দূরের দুরবিনে

একটি নির্বাচন, ভোট, ফলাফল ও গণতন্ত্রের শিক্ষা

অজয় দাশগুপ্ত | শুক্রবার , ৩১ মার্চ, ২০২৩ at ৫:১৪ পূর্বাহ্ণ

সিডনি আরো একটি নির্বাচন দেখলো। পরিবর্তনের স্বাক্ষী হলাম আমরা। গণতন্ত্রে নির্বাচন এমনই। যার আরেক নাম উত্তেজনাহীন ভোট। সত্যি আবেগ ও উত্তেজনাহীন। আবেগ থাকলেও তা এতগোপন আর নীরব যে তা আছে কি নাই তাবোঝা মুশকিল। যে নির্বাচনের কথা বলছি তা ছিল গুরুত্বপূর্ণ। এদেশ অর্থাৎ অষ্ট্রেলিয়ার সবচেয়ে বড় অঙ্গরাজ্য নিউ সাউথ ওয়েলসের সরকার পরিবর্তন মানে বড় ঘটনা। এ রাজ্যেই দেশের সবচেয়েবেশী মানুষের বসবাস। ব্যবসা বানিজ্য সাহিত্য সংস্কৃতিখেলাধুলা রাজনীতি সবকিছুতে এগিয়ে থাকা সিডনির মানুষ আগ্রহ ছিল শীর্ষে ।ভোটতো হলো ই । সরকার পরিবর্তন ও হয়েগেলো নীরবে।

সকাল দশটার পর ভোটকেন্দ্রে গিয়ে দেখি তেমন কোন লাইন নাই। অল্প কিছু মানুষ দাঁড়িয়ে । বাইরে কিছু মানুষ জটলা করে দাঁড়িয়ে গল্প গুজব করছে। এজেন্ট তো থাকে না তবে কয়েকজন কর্মী লিবারেল ওলেবার দলের হয়ে হাতে হাতে লিফলেট ধরিয়ে দিচ্ছিলেন। তাদের চেহারা দেখলে আপনার মায়া হবেই।এমন অনুচ্চ কন্ঠে সবাইকে অনুরোধ করছিল যেনভোট চাওয়া এক ধরনের অপরাধ। এইসব গণতান্ত্রিক সমাজে আচরণ বড় বিষয়। কথাবার্তায় রাগ বাক্রোধ থাকতে পারে তবে তা যদি কোনভাবে কদর্য হয়ে পড়ে তবে মুশকিল। কেউ ছাড় পাবে না। একজন সাধারণ কর্মী থেকে নেতা সবাইকে সামলে চলতে হয়, এটাই নিয়ম।

যে নির্বাচন আমরা দেখলাম ভোট দিলাম তার গুরুত্ব ছিল বলেই মানুষ পরিবর্তন নিশ্চিত করেছে । লিবারেল দল বারো বছর একটানা শাসনে থাকার পর বিদায় নিয়েছে । নতুনভাবে রাজ্য শাসন করবে লেবার দল।সেটা যে কত স্বাভাবিক একটা বিষয় তার প্রমাণ মিললো ইলেকশানের ফলাফল ঘোষণার সময়। শনিবার রাতে প্রোগ্রেসিভ ভোট গণনার ভিত্তিতে, ক্রিস মিন্স পরবর্তী নিউ সাউথ ওয়েলসের প্রিমিয়ার হতে যাচ্ছেন, এবং স্টেটে সংখ্যাগরিষ্ঠলেবার সরকারকে নেতৃত্ব দেওয়ার পথে রয়েছেন। বিজয়ী ভাষণে, হবু প্রিমিয়ার ঘোষণা করেনযে তার দল ক্ষমতায় ফিরে এসেছে এবং কাজ করতে প্রস্তুতআমরা এই স্টেটের জনগণকে হতাশ হতে দেব না,” মি. মিন্স বলেন।

আমরা নিউ সাউথ ওয়েলসে সবার জন্য শাসন করব। আমরা জানি সামনের চ্যালেঞ্জগুলো ব্যাপক, আমাদের দায়িত্ব অনেক। কিন্তু যেহেতু নিউ সাউথ ওয়েলসেলেবার ফিরে এসেছে এবং এই বিরাট স্টেটে আমরা কাজ করতে প্রস্তুত।

বাংলাদেশের জনগণ এখন এখানে ভোটের বাক্সেও গুরুত্ব বহন করে। তার প্রমাণ পরাজিত লিবারেল ও বিজয়িলেবার দলের ঘোষণায়। লিবারেল যেমনটা সহায়তার আশ্বাস দিয়েছিল তেমনি লেবার বলেছিল: এদিকে, গত ১৭ মার্চ ২০২৩ নিউ সাউথ ওয়েলস লেবার পার্টির পক্ষ থেকে একটি মিডিয়া রিলিজে বলা হয়, তারা নির্বাচিত হলে বাংলাদেশী সাংস্কৃতিক উৎসব ও কর্মকাণ্ডে ১১০,০০০ ডলার সহায়তা প্রদান করবে।

এই বিবৃতিটিতে আরও বলা হয়, সিডনি অলিম্পিক পার্কে বঙ্গবন্ধু কাউন্সিল অস্ট্রেলিয়ার আয়োজিত বার্ষিক বৈশাখী মেলায় তারা অর্থায়ন করবে। এই মেলাটি অস্ট্রেলিয়ায় বাংলাদেশীদের সবচেয়ে বড় অনুষ্ঠান এবং বাংলাদেশের বাইরে এ জাতীয় অনুষ্ঠানগুলোর মধ্যে অন্যতম বৃহৎ একটি অনুষ্ঠান বলে উল্লেখ করে আরও বলা হয়, আগামী চার বছর ধরে প্রতিবছর ২৭,৫০০ ডলার করে অর্থায়ন করা হবে।

বাংলাদেশীরা এতে আনন্দিত। তাদের প্রত্যাশা বঙ্গবন্ধু কাউন্সিল অতীতের মতো এই কাজ বা নববর্ষ বরণে সর্বজনীন বাংলাদেশ ও বহুজাতিক সংস্কৃতির ভিন্ন মাত্রা তুলে ধরবে।

বলছিলাম ভোটের কথা। ভোটতো শান্তিপূর্ণ হয়েছেই তারপর ফলাফলও আসলো নির্বিঘ্নে। এরপর জয় পরাজয় স্বীকার করার পালা। আমাদের দেশে যারা জেতে তাদের চোখে তাদের ধারণায় নির্বাচন সুষ্ঠু ও সার্থক। আর যারাহেরে যাব তাদের গন্তব্য সোজা প্রেসক্লাব। তাদের কন্ঠে তখন প্রতিবাদ তাদের নীতি তখন এ্যাকশান। এই বাস্তবতা চলে আসছে যুগের পর যুগ। আর এদিকে? জয়ী নেতা ক্রিস স্ত্রী পুত্র সাথে নিয়ে বের হলেন বটে পার্তি অফিসে উল্লাসরত সমর্থকদের ভীড়ে তার দেখা নাই। টিকি ও মিলছে না। সবাই চলে এসেছিলেন সেখানে। এমন কি এদেশের প্রধানমন্ত্রী আলবিনিজি ও উপস্থিত রাজ্যের নবনির্বাাচিত মুখ্যমন্ত্রীকে স্বাগত জানাবেন বলে। কিন্তু ক্রিস তখনো পর্দার অন্তরালে। কেন?

তিনি সবুর করছিলেন কখন পরাজিত লিবারেল দলের নেতা বিদায়ী মুখ্যমন্ত্রী বা প্রিমিয়ার ডমিনিক পরাজয় বরণ করে নেন। ঐ দিকে লিবারেল পার্টির সদর দপ্তরে সস্ত্রীক এসে হাজির ডমিনিক। তাঁর ভাষণটি দারুণ লেগেছে আমার। ডমিনিক পরাজয় স্বীকার করে লেবার দলের নতুন নেতাকে স্বাগত জানানোর পাশাপাশি নিজের কাঁধে তুলে নিলেন পরাজয়ের দায়। দায়িত্ব নিয়ে বললেন সার্থকতার পর ও জনগণ চায় নি বলেই তারা হেরে গেছেন। কর্মী ও সমর্থকদের মুখে হাসিমুখে জানালেন তিনি আর দলের নেতা থাকবেন না। সাধারণ কর্মী হয়ে থাকতে চান। উপস্থিত কর্মী সমর্থকদের নো নো ধ্বনিতে হাসিমুখে জানালেন এটাই তাঁর চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত। তাঁর মতে দলের দরকার নতুন নেতা যিনি দলকে তারচেয়েও বেশী গতি দিতে পারবেন, পারবেন পরের বার জিতিয়ে আনতে।

সত্যি কথা এই, আমাদের জন্য এগুলো উদাহরণ শুধু না বিস্ময়ও বটে। আমরা এমন সমাজের মানুষ যেখানে পরাজয় স্বীকার এক ধরনের দুর্বলতা। কেউ তা স্বীকার করতে চায় না। জোর করে না নামানো পর্যন্ত নামতে চায় না অনেকে। সে সমাজে গণতন্ত্র কেবলই আঙুর ফল টকের মতো কিছু। সত্যিকারের গণতন্ত্র আর মুক্ত সমাজে কেউ জয় পরাজয় নিয়ে ভাবে না। দুটোই স্বাভাবিক। কারণ গদী বা ক্ষমতা এসব সমাজে চাকরির মতো। একটা সময় বা মেয়াদ পর্যন্ত করে ছেড়ে যেতে পারলেই যেন বাঁচেন তারা। ডমিনিকও যেন তাই করলেন। অন্যদিকে বিজয়ী ক্রিস মাইকে এসি ধন্যবাদ জানালেন হেরে যাওয়া প্রতিপক্ষের নেতাকে। সবাইকে মনে করিয়ে দিলেন এখন তিনি আর শুধু লেবার দলের কেউ না। সব দল সব মতের মানুষের প্রিমিয়ার হবেন তিনি। এও বললেন পরাজিতেরা যে জায়গায় রেখে গেছে সেখান থেকেই তার যাত্রা শুরু হবে। নতুন করে সাজাবেন সবকিছু।

গণতন্ত্রের সুবাতাস এমনই। কোন মারামারি কথা কাটাকাটি বা হৈ চৈয়ের দরকার পড়ে না। শুধু দরকার জনগণের সমর্থন। তারা পাশে থাকলেই জয়। এই জনগণ ভরসা বলেই যারা জেতে তারা থাকে তটস্থ আর যারা পরাজিত তাদের উদ্দেশ্য হয় জনগণের মনে জায়গা করে নেয়া। ভোটের আগে পরে মাইকিং সভা সমিতি বা ভাষণহীন পরিবেশের পর ও যাথেকে যায় তা হচ্ছে বিশ্বাস। বিশ্বাস কাজ করে বলেই মানুষ নীরবে তাদের অভিমত জানিয়ে দেয় ব্যালেট বাক্সে। ব্যালট পেপারই পরিবর্তন করে পরিবর্তন ডেকে আনে। আমাদের সমাজে সে ভোট এখনো অধরা। এখনো নির্বাচন কমিশন প্রশ্নের বাইরে নয়। গণতন্ত্র কায়েম হলেই একদিন এমন বাস্তবতা হয়তো পেয়ে যাবে আগামী কোন প্রজন্ম। সে আশাতেই আমরা বুক বেঁধে আছি।

লেখক : প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট, শিশুসাহিত্যিক।

পূর্ববর্তী নিবন্ধজুম্‌’আর খুতবা
পরবর্তী নিবন্ধশঙ্খনদীতে নিখোঁজ শ্রমিকের লাশ উদ্ধার