জুম্‌’আর খুতবা

কুরআনুল করীমের তিলাওয়াত ও হিফজ করার ফযীলত

অধ্যক্ষ মাওলানা মুহাম্মদ বদিউল আলম রিজভি | শুক্রবার , ৩১ মার্চ, ২০২৩ at ৫:১৩ পূর্বাহ্ণ

আল কুরআনের মর্যাদা: আল্লাহর প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপর তেইশবৎসর ব্যাপী অবতীর্ণ আসমানী কিতাব আল্লাহর বানী আল কুরআন হলো বিশ্ব মানবজাতির জন্য এক পূর্ণাঙ্গ অকাট্য নির্দেশিকা। সব বিষয়ের বর্ণনা সম্বলিত সুস্পষ্ট কিতাব। এ কিতাবের মর্যাদা প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেছেন, আমি আপনার ওপর এমন কিতাব অবতীর্ণ করেছি যা সকল বিষয়ের সুষ্পষ্ট বর্ণনাকারী আর মুসলমানদের জন্য হিদায়াত, রহমত এবং সুসংবাদ। (১৬সূরা: নাহল, ৮৯)

পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ভাষায় কুরআন অবতীর্ণ: মহান আল্লাহ তাঁর বান্দাদের উপর বড় অনুগ্রহ করেছেন। পৃথিবীর যে কোনো ভাষাভাষীদের জন্য আরবী ভাষায় অবতীর্ণ কুরআনের উচ্চারণ ও তিলাওয়াত সহজ করে দিয়েছেন। আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেছেন, “নিশ্চয়ই আমি এ কুরআনকে আরবি ভাষায় অবতীর্ণ করেছি যাতে তোমরা বুঝতে পার।” (১২সূরা, ইউসূফ: )

পবিত্র কুরআনের বিধান অনুসরণে বান্দার মুক্তি ও সাফল্য নিহিত। আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেছেন, এ কিতাব আমি অবতীর্ণ করেছি, যা বরকতময়, অতএব তোমরা তার অনুসরণ কর এবং তাকওয়া অবলম্বন কর, হয়ত তোমাদের প্রতি দয়া প্রদর্শন করা হবে। (সূরা: আনআম: ১৫৫)

কুরআন তিলাওয়াত সর্বোত্তম ইবাদত: পবিত্র কুরআন এমন শ্রেষ্ঠ বরকতময় গ্রন্থ, যে কিতাবের প্রতিটি অক্ষর, বর্ণ, শব্দ, বাক্য, তিলাওয়াতে অশেষ পূণ্য ও বরকত রয়েছে। এ কিতাবের প্রতিটি বর্ণের উচ্চারণ ইবাদত হিসেবে পরিগণিত, হাদীস শরীফে এরশাদ হয়েছে, “হযরত আসির ইবনে জাবির রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, কুরআন অধ্যয়ন করা সর্বোত্তম ইবাদত। (জামিউস সগীর)

কুরআনের প্রতিটি অক্ষর তিলাওয়াতে দশটি নেকী রয়েছে। পবিত্র কুরআন এমন বিস্ময়কর অদ্বিতীয় গ্রন্থ পৃথিবীতে যে গ্রন্থের কোনো তুলনা নেই। যে কিতাবের প্রতিটি হরফ শব্দ, আয়াত, সাবলীল, প্রঞ্জল, হৃদয়গ্রাহী মর্ম স্পশী। এ কুরআনের প্রতিটি আয়াতের বাক্য বিন্যাস আকর্ষণীয় ব্যঞ্জনায় উপস্থাপিত। এ কিতাবের সম্মোহনী শক্তি অপ্রতিদ্ধন্ধী। হাদীস শরীফে এরশাদ হয়েছে, হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাদ্বিয়াল্লাহ থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন,যে ব্যক্তি আল কুরআনের একটি হরফ পাঠ করে সে ব্যক্তি উহার বদলে একটি নেকী দশটিনেকীর সমান। আমি বলি না যে, আলিফ, লাম, মীম একটি হরফ বরং আলিফ একটি হরফ লাম একটি হরফ এবং মীম একটি হরফ। (সহীহ তিরমিযী, হাদীস: ২৯১০)

ইসলামে হাফিজে কুরআনের মর্যাদা: কুরআনুল করীম হিফজ করা বা মুখস্থকরণ একটি উত্তম ইবাদত। যারা হাফিজে কুরআন তারা কুরআনের ধারক ও বাহক, ইসলামে তাঁদের রয়েছে বিশেষ মর্যাদা। মুসলমানদের কাছে তারা সম্মানের অধিকারী হাদীস শরীফে তাদেরকে আল্লাহর বিশেষ মুসলমানদের কাছে তারা সম্মানের অধিকারী হাদীস শরীফে তাদেরকে আল্লাহর বিশেষ বান্দা হিসেবে আখ্যা দেয়া হয়েছে। হাদীস শরীফে এরশাদ হয়েছে, “মানুষের মধ্যে কতেক রয়েছে আল্লাহর পরিজন, সাহাবায়ে কেরাম আরজ করলেন ইয়া রাসূলাল্লাহ তাঁরা কারা? নবীজি এরশাদ করেন, কুরআনের বাহকগণ আল্লাহর পরিজন ও বিশেষ বান্দা। (সুনানু ইবনি মাযাহ, হাদীস: ২১৫)

কুরআন তিলাওয়াত কারীর জন্য কুরআন শাফাআত করবে। কিয়ামতের ভয়াবহ সংকটময় মূহুর্তে কুরআন তিলাওয়াত কারী বান্দারা সম্মানিত হবেন। পরকালীন সাফল্য ও মুক্তি তাদের জন্য সুনিশ্চিত হবে। আল্লাহর কুরআন তাদের জন্য সুপারিশ করবে। হাদীস শরীফে এরশাদ হয়েছে, “তোমরা কুরআন তিলাওয়াত করো, কেননা কিয়ামতের দিন তা তিলাওয়াত কারীর জন্য সুপারিশকারী হিসেবে উপস্থিত হবে।

হাফিজে কুরআনের পিতামাতার মর্যাদা: হাফিজের পিতামাতা সৌভাগ্যের অধিকারী ও সম্মানের অধিকারী বান্দা হিসেবে গন্য হবে। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ শিক্ষা ও উত্তম শিক্ষা হলো কুরআনের শিক্ষা। যে সব মা বাবা নিজ সন্তানকে কুরআনের হাফিজ বানিয়েছে কিয়ামতের দিন তারা বিশেষ মার্যাদা প্রাপ্ত হবে। হাদীস শরীফে এরশাদ হয়েছে, হযরত মুয়াজ জুহানী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি কুরআন পাঠ করে এবং তদানুযায়ী আমল করে কিয়ামতের দিন তার পিতা মাতাকে নূরের মুকুট পরিধান করা হবে। যে টুপির উজ্বলতা সূর্যের আলো অপেক্ষাও উজ্জ্বলতর হবে। তোমরা চিন্তা কর যে ব্যক্তি কুরআন অনুযায়ী আমল করে তার মর্যাদা ও সম্মান কত উত্তম হবে? (আবু দাউদ: হাদীস: ১৪৫২)

একমাত্র আল কুরআনই অবিকৃত পূর্ণাঙ্গ গ্রন্থ: আল কুরআনই একমাত্র অবিকৃত ক্রটিমুক্ত নিরেট সত্য ঐশীগ্রন্থ হিসেবে আজো বিশ্বময় দেদীপ্যমান। মহান আল্লাহ পৃথিবীর লক্ষ লক্ষ হাফিজে কুরআনের সীনায় কুরআনকে সংরক্ষণ করেছেন ও হাফেজদের বক্ষে পবিত্র কুরআনকে আমানত রেখেছেন। পৃথিবীর কোন অপশক্তি খোদাদ্রোহী নবীদ্রোহী ইসলাম বিদ্বেষী, দ্বীনের শক্রদের পক্ষ থেকে কুরআনের বিরুদ্ধে যতই ষড়যন্ত্র চক্রান্ত করা হউক না কেন? পবিত্র কুরআনের শিক্ষা ও কুরআনের অস্তিত্ব বিলুপ্ত করা কারো পক্ষে সম্ভব নয়। পবিত্র কুরআন সংরক্ষণের দায়িত্ব স্বয়ং মহান আল্লাহই গ্রহণ করেছেন, পবিত্র কুরআনে এরশাদ হয়েছে, নিশ্চয়ই আমিই কুরআন অবতীর্ণ করেছি এবং আমিই এর সংরক্ষণকারী। (১৫ হিজর:১৪)

ঘরে ঘরে কুরআনের তিলাওয়াত ও শিক্ষা অব্যাহত রাখুন: আল্লাহর রহমত বরকত ও দয়া অনুগ্রহ লাভের প্রত্যাশায় প্রতিটি ঘরে ঘরে কুরআন তিলাওয়াত জারী রাখুন। কুরআনের চর্চা ও শিক্ষা অব্যাহত রাখুন। যে ঘরে কুরআনের পঠন পাঠন অধ্যায়ন চর্চা ও অনুশীলন নেই, সেই ঘরে বরকত ও কল্যাণ নেই। হাদীস শরীফে এরশাদ হয়েছে, হযরত আবদুল্লাহ ইবনু আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, যার মধ্যে আল কুরআনের কোনো অংশ নেই সে হচ্ছে একটি বিরান ঘরের মতো। (মিশকাত: হাদীস: ২১৩৫)

হাফিজে কুরআন পরিবারের দশজনকে সুপারিশ করবে: পবিত্র কুরআনের ত্রিশপারা ১১৪টি সূরা যারা কঠোর মেহনত, দীর্ঘ সাধনা ও পরিশ্রমের মাধ্যমে নিজেদের বক্ষে ধারন করেছে, তাঁরা কেবল জান্নাতে যাবেন না, বরঞ্চ তারা নিজ পরিবার পরিজনের দশজন এমন ব্যক্তিকে সুপারিশ করবেন যাদের উপর জাহান্নাম অবধারিত ছিল। হাফিজদের জন্য এ অর্জন ও সম্মান গৌরবের ও আনন্দের। হাদীস শরীফে এরশাদ হয়েছে, হযরত হাফস ইবনে সুলায়মান রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি কুরআন অধ্যয়ন করে অতঃপর তা মুখস্থ করেছে। অতঃপর কুরআন যা হালাল করেছে নিজের জন্য তা হালাল করেছে এবং কুরআন যা হারাম করেছে সে নিজের জন্য তা হারাম করেছে, তখন আল্লাহ তা’আলা তাঁকে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন এবং নিজ পরিবারের এমন দশজনের জন্য যাদের পরিণাম জাহান্নাম অবধারিত ছিল। (তিরমিযী: তিরমিযী, পৃ: ২৯০৫)

হাফিজে কুরআনদের সম্মান করুন: হাফিজে কুরআনকে সম্মান করুন, আল কুরআনের শিক্ষা প্রচার প্রসারে তাঁদের ভূমিকা ও অবদান অনস্বীকার্য। তাঁদেরকে অবজ্ঞা অসম্মান করবেন না। তারা কুরআনের ধারক, বাহক, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি তাঁদেরকে সম্মান করল নিশ্চয় সে আমাকে সম্মান করল। (কানযুল উম্মাল, খন্ড:, পৃ: ২৫৮)

হে আল্লাহ আল কুরআনের হিদায়াত ও বরকত আমাদের নসীব করুন, কুরআনের তিলাওয়াত ও তদনুযায়ী আমল করার তাওফিক দান করুন। আমিন।

অধ্যক্ষ, মাদরাসাএ তৈয়্যবিয়া ইসলামিয়া সুন্নিয়া ফাযিল (ডিগ্রী), বন্দর, চট্টগ্রাম; খতীব, কদম মোবারক শাহী জামে মসজিদ।

মুহাম্মদ আশফাক চৌধুরী

আসদগঞ্জ, কোতোয়ালী, চট্টগ্রাম।

প্রশ্ন: তারাবীহ নামাযের শরয়ী বিধান কি? এর রাকআত সংখ্যা কত জানালে কৃতার্থ হব।

উত্তর: রমজান মাসে এশার নামাযের পর তারাবীহ নামায আদায় করা সুন্নাতে মু’আক্কাদা। জামাত সহকারে আদায় করা সুন্নাতে মু’আক্কাদায়ে কিফায়াহ। অর্থাৎ আল্লাহর মসজিদে জামাতের ব্যবস্থা না হলে সকলে দায়ী ও গুণাহগার হবে। তারাবীহ মসজিদে জামাত সহকারে পড়া উত্তম। যদি ঘরে জামাত সহকারে পড়ে মসজিদের জামাত পরিত্যাগের কারণে গুণাহগার হবেনা। তবে মসজিদে পড়লে যে সওয়াব পাওয়া যাবে তা পাওয়া যাবেনা। (বাহারে শরীয়ত, খন্ড: ৪র্থ, পৃ: ৫২, আলমগীরি)

অপ্রাপ্ত বয়স্কদের পিছনে প্রাপ্ত বয়স্কদের তারাবীহ হবেনা। এটাই বিশুদ্ধ। (বাহারে শরীয়ত, খন্ড:৪র্থ, পৃ:৫৩, আলমগীরি)

তারাবীহ নামায বিশুদ্ধ মতানুসারে জমহুর ওলামাদের মতে বিশ রাক’আত। অসংখ্য হাদীস দ্বারা বিশ রাকাতের বর্ণনা প্রমাণিত। বিশ রাক’আত হওয়ার ব্যাপারে সাহাবায়ে কেরামের যুগ থেকে সর্বযুগের মুসলিম উম্মাহ ও মুজতাহিদ ইমামগণ ঐক্যমত পোষণ করেছেন। (রদ্দুল মুহতার, ১ম খন্ড)

প্রসিদ্ধ ফিকহগ্রন্থ “নূরুল ঈযাহ” তে রয়েছে বিশ রাক’আত তারাবীহ দশটি সালামের মাধ্যমে আদায় করতে হবে। (নূরুল ঈযাহ, পৃ: ১১৯)

বুখারী শরীফের ব্যাখ্যা গ্রন্থ “উমদাতুল কারী”এর বর্ণনা মতে তারাবীহ নামাযের রাক’আত সংখ্যা বিশ। (উমদাতুলকারী, খন্ড: ১১, পৃ: ১২৭, “মিরকাত শরহে মিশকাত” ২য় খন্ড, পৃ: ১৭৫)

সাহাবায়ে কেরাম হযরত উমর (রা.)’র খিলাফতকালে ২০ রাক’আত তারাবীহ আদায় করতেন। হযরত উসমান (রা.) ও হযরত আলী (রা.) এর খিলাফতকালেও অনুরূপভাবে বিশ রাক’আত আদায় করতেন। (বিস্তারিত “ফাতওয়ায়ে ফয়জুর রসূল” ১ম খন্ড, পৃ: ৩৭৬৩৮০)

পূর্ববর্তী নিবন্ধএকটি পতাকা ও নিজস্ব ভূখণ্ডের আন্দোলন
পরবর্তী নিবন্ধদূরের দুরবিনে