একটি পতাকা ও নিজস্ব ভূখণ্ডের আন্দোলন

আক্তারুণ নেসা বেগম | শুক্রবার , ৩১ মার্চ, ২০২৩ at ৫:১১ পূর্বাহ্ণ

মুসলিম এডুকেশন সোসাইটি হাইস্কুলের দিবা ও প্রাতঃ বিভাগ। আমার শ্রদ্ধেয় গর্ভধারীনি মা বেগম মোস্তফা ওসমান শিক্ষিকার দায়িত্ব পালন করতেন, ১৯৬৭১৯৬৮ সাল হবে। আমার মা মুসলিম এডুকেশন সোসাইটি হাই স্কুলের ফাউন্ডার সহকারী শিক্ষিকা ও কে.জি. দিবা এবং প্রাতঃ বিভাগের ইনচার্জ এর দায়িত্বে ছিলেন। উল্লিখিত স্কুলের প্রাতঃ ও দিবা বিভাগের কে.জি. দ্বিতীয় শ্রেণির ক্লাস টিচারও ছিলেন। আমি দিবা দ্বিতীয় শ্রেণির ছাত্রী ছিলাম। একদিন বেলা প্রায় ১১.৩০ মিনিটের দিকে অপর্ণাচরণের বড় আপুরা এসে আমাদেরকে বলতে লাগলেন ‘ছোটমনিরা বেরিয়ে এসো’, ‘ছোট মনিরা বেরিয়ে এসো’। আমরা কয়েকজন ছাত্রী দ্রুত বেরিয়ে সারিবদ্ধভাবে বড় আপুদের নির্দেশনায় অপর্ণাচরণ স্কুলের মাঠে গিয়ে জড়ো হলাম এবং মাঠে ঘাসের উপর গোল হয়ে বসলাম। আমাদের বড় আপুদের মধ্যে নির্দেশনা দিচ্ছিলেন ছবি রানী আপু এবং ছায়া আপু। বিভিন্ন স্কুল হতে বড় আপু, ছোট আপু সবাই ইতিমধ্যে এসে পড়েছেন। আস্তে আস্তে মাঠ ভরে গেল। চট্টগ্রামের একাধিক বেসরকারি প্রাইমারি স্কুল ও হাই স্কুল থেকে ছাত্রীরা অপর্ণাচরণ হাই স্কুলের মাঠে উপস্থিত হয়েছেন।

ইতিমধ্যে শোনা গেল আমাদের অপর্ণাচরণ বালিকা বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা ও দিদিমনিরাওবিশেষ করে শ্রদ্ধেয় বীণা দিদিমনি, শ্রদ্ধেয় বেলা দিদিমনি, শ্রদ্ধেয় সুলেখা দিদিমনি তাঁরাও আমাদের ছাত্রী জনসভাকে সাপোর্ট দিচ্ছেন। এরই মধ্যে আমাদের ছবিদি উচ্চকণ্ঠে বিভিন্ন শ্লোগান দিতে লাগলেন। আমাদের সভার মধ্যমণি আমাদের প্রাণ প্রিয়নেত্রী বাংলার অগ্নিকন্যা এসে পড়েছেন। ছোট মনিরা, আপুরা একটু সুন্দর হয়ে চুপ করে বস এবং আমাদের সাথে শ্লোগান দাও ।

নেত্রী মতিয়া চৌধুরী অপর্ণাচরণ বালিকা বিদ্যালয়ে এসেই উচ্চকণ্ঠে বক্তৃতা দিলেন। আমাদের পূর্ব বাংলার ছাত্র/ছাত্রীরা উচ্চ মূল্যে কাগজ কিনবে না, কাগজ/খাতার মূল্য কমাতে হবে। ‘কম টাকায় খাতা কিনব, নতুবা পূর্ব পাকিস্তান সরকার বাহাদুরকে গদিচ্যুত করব’। এই শ্লোগানে সভা উত্তাল, তবুও পূর্ব পাকিস্তান অর্থাৎ আমাদের বর্তমান বাংলাদেশ তদানিন্তন পাকিস্তান সরকার হঠাৎ করে স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের ব্যবহৃত রোলিং করা সিঙ্গেল লাইন, ডবল লাইন, তিন লাইন, চতুর্থ লাইন এর খাতার মূল্য সীমাহীন বাড়িয়ে দেয়। এতে করে বাংলাদেশের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্কুল কলেজ বন্ধের ডাক দেন। তারই অংশ হিসেবে আমাদের প্রিয় নেত্রী মতিয়া চৌধুরী আসেন অপর্ণাচরণ বালিকা বিদ্যালয়ের মাঠে। আমরা প্রাইমারি এবং হাই স্কুলের ছাত্রীরা অত্যন্ত মনোযোগের সাথে আমাদের নেত্রীর বক্তৃতা শুনি, শ্লোগান দিই এবং জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আল্টিমেটাম দেন যে, এক সপ্তাহের মধ্যে সকল প্রকার খাতার মূল্য পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্র/ছাত্রীদের জন্য না কমালে অনির্দিষ্টকালের জন্য স্কুল/কলেজ বন্ধ থাকবে।

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু হুংকার দিয়ে পাকিস্তান সরকারকে বললেন, সরকার বাহাদুর আমাদের দেশে (পূর্ব পাকিস্তানে) কাগজ তৈরী হয়, আমাদের কাগজ পশ্চিম পাকিস্তানে যায়, পশ্চিম পাকিস্তানে কাগজের মূল্য কম। আমাদের পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্র/ছাত্রীদের পড়ালেখার ক্ষেত্রে কাগজ/খাতা রোলিং খাতার মূল্য সীমাহীন বেশি এমন হতে পারবে না, যেহেতু আমাদের চট্টগ্রাম এবং খুলনায় কাগজের মিল আছে, কাগজ তৈরী হয়, এর পরই চট্টগ্রাম সহ সমগ্র পূর্ব পাকিস্তান (বর্তমান বাংলাদেশ) স্কুল, কলেজ বন্ধ হয়ে যায়।

সেহেতু আমাদের স্কুল কলেজের ছাত্র/ছাত্রীরা কমদামে কাগজ/খাতা কিনবে। অর্থাৎ পশ্চিম পাকিস্তানের কাগজের মূল্যের তুলনায় পূর্বপাকিস্তানের কাগজের মূল্য কম হতে হবে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হুংকারে পাকিস্তানের সরকার একটি প্রেসনোট দেন। প্রেসনোটে বলা হয়, আপনাদের পূর্ব পাকিস্তানে কাগজ তৈরী হলেও, আপনাদের কাঁচামাল থাকলেও কাগজ তৈরীর পর কাগজকে খাতায় রূপান্তর সহ. রোলিং করা সহ, বিভিন্ন ক্যাটাগরির খাতার রোলিং করার কোনো মেসিন আপনাদের পূর্ব পাকিস্তানে নেই। সমুদ্রপথে জাহাজে করে আপনাদের কাগজ পশ্চিম পাকিস্তান যায় এবং সেখান হতে রোলিং হয়ে খাতা আকারে আপনাদের পূর্ব পাকিস্তানের স্কুল/ কলেজের ছাত্র/ছাত্রীদের কাছে লেখার উপযুক্ত হয়ে আসে এবং পূর্ব পাকিস্তান হতে পশ্চিম পাকিস্তানে সমুদ্র পথে কাগজ নিয়ে এবং কাগজকে বিভিন্ন ক্যাটাগরির খাতায় পরিবর্তন করে, আবার পূর্ব পাকিস্তানে আনতে যে খরচ পড়ে তা সহ খাতার রোলিং এর খরচ মিলে পূর্ব পাকিস্তানে তৈরী কাগজ বা খাতার মূল্য অধিক বাড়াতে হয়েছে।

তদানিন্তন পাকিস্তান সরকারের প্রেস নোট পেয়ে জাতির পিতা পূর্ব পাকিস্তানের অবিসংবাদিত নেতা হুংকার দিয়ে বললেন, সরকার বাহাদুর আগামীকাল থেকে পূর্ব পাকিস্তান থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে পানি পথে জাহাজে করে কোনো কাগজ যাবে না। অত্যন্ত মেধাবী, সংগ্রামী, দেশপ্রেমী জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হুংকার দিয়ে পাকিস্তান সরকারকে জানিয়ে দিলেন যে, ‘সরকার বাহাদুর এক সপ্তাহের মধ্যে আমাদের পূর্ব পাকিস্তানে রোলিং মেশিন বসান’ বিভিন্ন ক্যাটাগরির খাতা তৈরীর মেশিন বসান এবং আমাদের পূর্ব পাকিস্তানে ছাত্রছাত্রীদের জন্য কম মূল্যে সব ক্যাটাগারির খাতা বিক্রয়ের আদেশ প্রদান সহ তৈরী সকল খাতা পশ্চিম পাকিস্তানে জাহাজে করে পাঠাবেন এবং পশ্চিম পাকিস্তানের স্কুল/কলেজের ছাত্র/ছাত্রীদের খাতার মূল্য বর্ধিত করে সমুদ্র পথে কাগজ বা খাতা প্রেরণের বাড়তি খরচ তুলে নিবেন বা এডজাস্ট করবেন। নতুবা স্কুল/কলেজ অনির্দিষ্ট কালের জন্য বন্ধ থাকবে।

বঙ্গবন্ধুর হুংকারে এবং পাকিস্তান সরকারের প্রেস নোটটির বঙ্গবন্ধুর বুদ্ধিদীপ্ত উত্তরে পাকিস্তান সরকার বাধ্য হলেন, পূর্ব পাকিস্তানে খাতা তৈরীর রোলিং মেশিন বসাতে এবং পূর্ব পাকিস্তানের স্কুল/ কলেজের, ছাত্র/ছাত্রীদের জন্য কাগজ বা খাতার মূল্য একেবারে সস্তা রাখতে ।

১৯৬৭১৯৬৮ সনের পূর্ব পাকিস্তানের কাগজ/খাতার মূল্য কমানোর লক্ষ্যে ধর্মঘট ও সংগ্রামের উত্তাল তরঙ্গে আমাদের ছাত্র/ছাত্রী সমাজ আমাদের বাংলাদেশের বর্তমান সংসদের উপনেতা বাংলার অগ্নিকন্যা আমাদের প্রিয় নেত্রী মতিয়া চৌধুরী অত্যন্ত বলিষ্ঠ সহযোগিতার ভূমিকা রেখে পূর্ব পাকিস্তানের (বর্তমান বাংলাদেশের) ছাত্র/ছাত্রী সমাজকে সীমাহীন সহযোগিতা করা সহ বাংলাদেশের ছাত্র/ছাত্রী সমাজকে বক্তৃতা প্রদান এবং তীক্ষ্ণজ্ঞানসহ সংগ্রামী মননশীলতার অধিকারী করেছেন। যার ফলশ্রুতিতে ১৯৭১ সালে স্বাধীন বাংলার আন্দোলনে পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্র/ছাত্রীগণ বাংলার অবিসংবাদিত নেতা স্বাধীনতা সংগ্রামের অগ্রপথিক জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর ডাকে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। বাংলাদেশের কোটি কোটি জনগণের জন্য একটি নির্দিষ্ট পতাকা, একটি নিজস্ব ভূখণ্ড, বাঙালি জাতীয়তাবাদের চেতনা এবং ধর্মনিরপেক্ষতার মূল্যবোধসহ স্বাধীন দেশ বাংলাদেশ অর্থাৎ আমাদের প্রাণপ্রিয় মাতৃভূমি এই বাংলাদেশ, কোটি কোটি বাংলাদেশীকে উপহার দেন। আমাদের সমগ্র বাংলাদেশীদের কাম্য বাংলাদেশ দীর্ঘজীবী হোক। বাংলাদেশের কষ্টার্জিত স্বাধীনতা অটুট থাকুক। একই সাথে অর্থনৈতিক মুক্তি আসুক। জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু।

লেখক : আইনজীবী

পূর্ববর্তী নিবন্ধশপথ
পরবর্তী নিবন্ধজুম্‌’আর খুতবা