দূরের দুরবিনে

অজয় দাশগুপ্ত | শুক্রবার , ১৪ জানুয়ারি, ২০২২ at ৬:৪৮ পূর্বাহ্ণ

পাওয়ার চাইতে অপ্রাপ্তি যেন ভারী না হয়

আজকাল সাহস করে সত্য বলাও মুশকিল। মাকড়সার জালের মতো নেট ওয়ার্ক। সে আপনি দেশে থাকেন আর বিদেশে কোথাও নিরাপদ না। যতোদিন বা যতো কাল দেশের সাথে যোগাযোগ ততো কাল ঘরে বাইরে বাঙালি কি এভাবেই মুখ বুঁজে থাকবে? উন্নয়ন অগ্রগতি বা সম্পদের হিসাব দেখে আমরা তুষ্ট। কিন্তু আমি বলছি মনোজাগতিক আর অন্তরের কথা। সে এখন প্রতিবাদ জানে না। দ্রোহ বোঝে না। সমাজ টুকরোএক বিষয় হয়ে গেলো চুপ থাকে। যার মূল কারণ সুশাসনের অভাব। উন্নয়ন আর স্তাবকতা এক বিষয় না। এটা না মানলে সমাজের অবসহা আরো খারাপ হবে। বাড়বে ধর্মান্ধতা চুরি ডাকাতি আর দু:শাসন।
ইতিহাস কখনো কাউকে তার প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত করে না। আবার যার যা প্রাপ্য তা বুঝিয়ে দিতেও বিলম্ব করে না। অনেক সময় আমরা ভাবি ইতিহাস তো অতীত । হয়তো এসব সেকালে ঘটতো। যা এখন আর হয় না। এককালে আমরা বাংলার শাসক হিন্দু রাজাকে আলাউদ্দীন খিলজির মুখোমুখি হবার বদল পালানোর কথা শুনেছি। শোনা যায় ১৭ জন সৈন্যের খিলজিকে না দেখে না জেনেই পালিয়েছিলেন সেন বাবু। আমরা এও জানি সিরাজদৌল্লা ও একটি বিতর্কিত চরিত্র। তিনি বাংলা বলতেন ও না। অথচ বাংলা বিহার ওড়িষ্যার নবাব নামে খ্যাত তিনি ই হয়ে গেলেন বাংলা নাটক ও মনোজগতের এক বিশাল দেশপ্রেমিক চরিত্র। এসব কথা বলছি এই কারণে বোঝা মুশকিল ইতিহাস বা সময় আসলে কা’কে কখন কোথায় দাঁড় করায়।
বাংলাদেশের রাজনীতি এখন মৃতপ্রায়। কোথাও কোন রাজনৈতিক কাজকর্ম কিংবা রাজনীতির কোন দাপট নাই। এর বিবিধ কারণ। তার ভেতর আমার মতে যেটি প্রধান কারণ সেটি হচ্ছে উন্নয়ন ও বিশ্বায়ন। উন্নয়ন বা অবসহার উন্নতি ঘটায় বাঙালি ঝুট ঝামেলায় যেতে নারাজ। আজকের তাদের খাবারের নিরাপত্তা বা থাকার বন্দোবস্ত কোন না কোনভাবে হয়ে যায় বলেই তাদের আগ্রহ নাই রাজনীতিতে। আর আজকের প্রজন্ম ডিজিটাল দুনিয়ার কারণে বুঝে গেছে লাইফ ইজ সামথিং ইমপোর্টেন্ট। আগের কালের মতো কথায় কথায় জীবন দানের কথা সে স্বপ্নেও ভাবে না।
কথাগুলো বললাম এই কারনে, রাজনীতি না থাকলেও হানাহানি বন্ধ হয় নি। বন্ধ হয় নি পরস্পরকে ছোট বা হেয় করার অপরাজনীতি। এসব ঘটনা ঘুরে ফিরে শেষ বা শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধের বছর একাত্তরে গিয়ে। সে সময়কার কারো ভূমিকাই আমরা অবিতর্কিত রাখতে পারি নি। বরং সম্মান ও শ্রদ্ধাবোধ হারিয়ে গেছে অনেক আগেই। সেটাও বলছি না বলছি এখনকার একমুখি রাজনীতিতে সবাই মিলে স্তাবকতা আর তোষামোদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ার কথা। ইতিহাসের আসল সত্য বা তার পাঠ কেউ মনে রাখে না। তাই যখন যে দেশশাসনে তার স্তুতিতে ঝাঁপিয়ে পড়া বাঙালির অভাব হয় না। এখন তার প্লাবন বইছে বাংলাদেশে। বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারের প্রতি এদের যে তথাকথিত আনুগত্য ও স্তাবকতা তাতে অতীত এসে হানা দেয় মনে। একমাত্র বঙ্গবন্ধু ও তাঁর চার সহযোদ্ধা ছাড়া সবাইকে কাবু করেছিল এই স্তাবকতা। বঙ্গবন্ধুকে কাবু না করলেও বিভ্রান্ত করে দেশ ও তাঁর সর্বনাশ করতে পিছ পা হয় নি তারা। এরাই হত্যা করেছিল তাঁকে সবংশে।
এরপর আমরা জিয়াউর রহমান থেকে এরশাদ অতঃপর খালেদা জিয়া সর্বত্র সে একই বাস্তবতা দেখেছিলাম। বিশেষত এরশাদের আমলে কতধরণের যে ভন্ডামী আর মোসাহেবী দেখেছি। প্রয়াত কাজী জাফর আর ম ওদুদ আহমেদের ভেতর একটা নীরব প্রতিযোগিতা কাজ করতো। সে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে না পড়ার জন্য তাঁরা এরশাদের বুকে আত বুলানো থেকে নকল কান্না কিছুই বাদ দিতেন না। অথচ সময়ের দেরী । এরশাদ পতনের পরপরই কাজী জাফর হয়ে উঠেছিলেন বিএনপির শরীক। আর ম ওদুদ সাহেব তো মন্ত্রী। এর মূল কারণ দুটো। একটা ছিলো আওয়ামী বিরোধিতা আর একটা হলো যেন তেন প্রকারে গদী লাভ। এরা কারো বন্ধু ছিলেন না। আজকে আমরা তেমন নেতাদের ভীড়ে সরকারী দলের নৌকা ভরে উঠতে দেখছি। যেদিকে তাকাই হাইব্রীড আওয়ামী নেতা লীগের সমর্থক।
একসময় মিছিল মিটিং করা সভা সমাবেশ করা ও ছিলো অসম্ভব। সে দুঃসময়ে যারা কাছে ছিলো তারা আজ পরিত্যক্ত। কিন্তু ভয়ের মূল জায়গাটা অন্যত্র। একদা বাম কমিউনিষ্ট পাটির্র সাথে সংশ্লিষ্ট কবি সাংবাদিক লেখকরা দেখলাম সম্পূর্ণ ভোল পাল্টে লীগ তো বটেই বঙ্গবন্ধু পরিবার নিয়েও তোষামোদীতে নেমেছেন। ইতোমধ্যে পুরষ্কার ও জুটে গেছে কারো কারো। কিন্তু খায়েশের শেষ নাই। শেষ নাই চাওয়া পাওয়ার। যতো পায় ততো চাই এর এই সমাজে তারা আরো চায় । তা চাঈতেই পারে। ডান বাম জামাত হেফাজত সবাই চায়। আর সরকারী দল দিতে ও কসুর করে না। অথচ যে সর্বনাশ বাসা বাঁধছে তার দিকে খেয়াল নাই কারো। এরশাদ যখন যেখানে যেতেন কাউকে না কাউকে কিছু না কিছু দিতেন। তেমনি এক ভদ্রলোক যিনি না কি এরশাদের ভাগ্য গণণার নামে হঠাৎ নেতা হয়ে গিয়েছিলেন সে জ্যোতিষীর দাপট দেখে যেমনি অবাক হতাম তেমনি বিস্মিত হয়েছি এরশাদ পতনের পর তাদের ভূমিকায় । অবশ্য এ আর নতুন কি? এই দেশেই মোশতাকের জন্ম হয়েছিল। এ দেশের মানুষ ছিলো মীরজাফর।
দমবন্ধ করা পরিবেশে দালালেরা কথা বলবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু আমাদের প্রত্যাশা ছিলো ভিন্ন। ইতিহাসের পাঠ থেকে কিছু শিখবে এটাই ভেবেছিলাম আমরা। ঐ যে বললাম এরশাদ আমলে তাঁর প্রেমে পড়া নারীদের তালিকা দেখলে বিশ্বসেরা প্রেমিকের ও মাথা খারাপ হবার কথা। রমনীমোহন এরশাদের পতনের পর বা তাঁর মৃত্যুর পর এদের কাউকে আহাজারী করতে শুনেছেন? দেখেছেন কাউকে বাইরে এসে কিছু বলতে? যে দুই বিবির লড়াই তাও কিন্তু ভোগ দখল নিয়ে। কি করে এসব দেখার পর ও চোখ বন্ধ করে ভাবি আমরা নিরাপদ? আমরা বলছি এই কারণে আওয়ামী লীগের পরাজয় বা তাদের সর্বনাশে বড় মাঝারি নেতাদের কখনো কিছু হয় নি। হয় ও না। তাঁরা ম্যানেজ করতে জানেন। ম্যানেজ করা ও আছে সবকিছু। হয় সাধারণ প্রগতিশীল আর সংখ্যালঘুদের। তাদের ঘরবাড়ী যায়। সম্পত্তি যায়। তাদের মেয়েরা ইজ্জত হারায়। আর বড় নেতারা তখন থাকেন কানাডা আমেরিকার মতো দেশে। যে পরিবারের সর্বস্ব একরাতে উজাড় হয়ে যায়। যাঁদের জীবনে মা বাবা ভাই বা আত্মীয়দের চলে যাবার আলাদা আলাদা দিন থাকে না তাদের পাশে তখন কেউই দাঁড়ায় না। কারণ এরা সুখের পাখি। বসন্তের কোকিল।
বাংলাদেশের বর্তমান পরিবেশ এমন ই এখানে সাদাকালো ভালো মন্দ সব মিলেমিশে একাকার। এই ডিজিটাল যুগে রাস্তায় তো বটেই বাড়ীতে পাশে থাকার ও কেউ নাই। সবাই যার যার ধান্দা আর মস্তিতে মশগুল। মাঝে মাঝে মনে হয় কি লাভ এসব লিখে? যারা টাকা বানানোর তারা তা বানিয়ে নিয়েছে। যাদের যা যা দরকার বাগিয়ে এখন কবে ভাগবেন সে আশায় দিন গুনছে। বাকী যে সাধারণ মানুষ তাদের কাছে এও যা সেও তা। তবু আশা ভরসা আর সম্ভাবনার দেশ ও মানুষের জন্য মায়া হয়। সমাজে এতো মোশাতক এতো হিন্দু রাজাকার এতো দালাল আর সুবিধাবাদী মানুষের প্রতি বিশ্বাস রাখাও যেন ভয়ের ব্যাপার।
বারবার ঘুরে দাঁড়ানো এই দেশের সর্বনাশ করেছে অপরাজনীতি। এবার যদি কিছু ঘটে তা করবে নো রাজনীতি। এই নো রাজনীতি আর স্তাবকতার উদ্দেশ্য দু একটা পদক পুরষ্কার আর টাকা। নেপথ্যে ভোগ। নারী অর্থ সম্পদের প্রতি এমন লোভ না আগে কেউ দেখেছে না দেখবে। এর সাথে উন্নয়নের নামে চলছে পোশাক শ্রমিক আর রেমিটেন্স পাঠানো মানুষ বাড়ানোর প্রতিযোগিতা। বাকি যে নলেজ নেশান বা বুদ্ধিবৃত্তি সে আজ রসাতলে।
কে দেখাবেন পথ? কোথায় দেশের উদ্ধার? লেখক : কবি, প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট

পূর্ববর্তী নিবন্ধজুম্‌’আর খুতবা
পরবর্তী নিবন্ধবাঁশরিয়া ক্যাপ্টেন উস্তাদ আজিজুল ইসলাম