জুম্‌’আর খুতবা

অধ্যক্ষ মাওলানা মুহাম্মদ বদিউল আলম রিজভি | শুক্রবার , ১৪ জানুয়ারি, ২০২২ at ৬:৪৭ পূর্বাহ্ণ

সূরা কাফিরুন’র শিক্ষা ও তাৎপর্য

প্রিয় মুসলিম ভাইয়েরা! আল্লাহ তা’আলাকে ভয় করুন। তাওহীদের মূলমন্ত্র কলেমায় বিশ্বাসী মু’মিন হিসেবে মহান আল্লাহর মাননীত ও তাঁর প্রিয় হাবীব সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রচারিত পবিত্র দ্বীন আল ইসলামের আদর্শ, শিক্ষা, রীতিনীতি পদ্ধতি গ্রহণ করুন, ইসলাম বিরুধী সকল বাতিল ও কুফরী মতবাদ বর্জন করুন।
সূরা কাফিরুন প্রসঙ্গ:
মহাগ্রন্থ আলকুরআনের ১০৯তম সূরা কাফিরুন মক্কী সূরা হিসেবে প্রসিদ্ধ, এতে রুকু সংখ্যা এক, আয়াত সংখ্যা ছয়টি, শব্দ সংখ্যা ছাব্বিশ, বর্ণ সংখ্যা চুরানব্বাই।
সূরার অনুবাদ:
১. আপনি বলুন, হে কাফিরগন!, ২. আমি ইবাদত করিনা যার ইবাদত তোমরা করো, ৩. এবং না তোমরা ইবাদত করো যাঁর ইবাদত আমি করি, ৪. এবং না আমি ইবাদতকারী যাঁর ইবাদত তোমরা করেছো, ৫. এবং না তোমরা ইবাদত করবে যাঁর ইবাদত আমি করি, ৬. তোমাদের দ্বীন তোমাদের এবং আমার দ্বীন আমার। (তরজমা কানযুল ঈমান, সূরা: কাফিরুন, আয়াত: ১-৬)
আলোচ্য বিষয়:
১. নবীজির প্রচারিত দ্বীন আল্লাহ কর্তৃক মনোনীত, কাফিরদের দ্বীন মানব রচিত কল্পনাপ্রসূত। ২. ইসলামী দাওয়াত তাওহীদ ভিত্তিক, কাফিরদের ধর্ম শিরকযুক্ত ও সম্পূর্ণরূপে ভ্রান্ত। ৩. দ্বীনের অনুসারীরা হবে ঈমান আক্বিদার প্রশ্নে কাফিরদের বিরুদ্ধে আপোষহীন। ৪. শির্ক ও বাতিলের সুস্পষ্ট বিরোধীতার বর্ণনা, ৫. কাফিরদের সমঝোতা প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করার ঘোষণা। ৬. তাওহীদ ও শির্ক দুয়ের মধ্যে সুস্পষ্ট পাথর্ক্য ঘোষণা।
শানেনুযুল:
সূরা কাফিরুন’র শানে নুযুল প্রসঙ্গে প্রখ্যাত তাফসীরকার সদরুল আফাযিল আল্লামা সৈয়দ নাঈম উদ্দিন মুরাদাবাদী (র.) স্বীয় খাযাঈনুল ইরফানে উল্লেখ, করেন মক্কার কাফিরদের একটি দল রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে ধর্ম পালনে সমঝোতার প্রস্তাব দিলো কাফিররা বললো আপনি আমাদের ধর্মের অনুসরণ করুন। আমাদের ধর্মের বিধি-বিধান মেনে চলুন। আমরা আপনার ধর্ম ইসলামের অনুসরণ করবো, এক বছর আপনি আমাদের দেবতাগুলোর পুজা অর্চনা করুন। এক বছর আমরা আপনার প্রভূর ইবাদত করবো আর এক বৎসর আপনি আমাদের প্রভূর ইবাদত করুন। তদুত্তরে নবীজি এরশাদ করেন, আমি আল্লাহরই আশ্রয় নিচ্ছি, তাঁর সাথে অন্য কাউকে অংশীদার স্থাপন থেকে। মহান আল্লাহ তাঁর প্রিয় হাবীবকে ধর্ম পালনে কাফিরদের সমঝোতা প্রস্তাব প্রত্যাত্থান করার নিদের্শ দিয়ে উপরোক্ত আয়াত সমূহ অবতীর্ণ করেন। সুরাটি নাযিলের পর নবীজি মসজিদুল হারামে তাশরীফ নিলেন সেখানে ক্বোরাইশদের ঐ দলটিকে নবীজি উপস্থিত দেখতে পেয়ে তাদের সম্মুখকে সূরাটি পাঠ করে শুনালেন, এতে তারা হতাশ হয়ে নবীজি ও তাঁর প্রিয় সাহাবীদের উপর নির্যাতনের পথকে বেচে নিল। (কানযুল ঈমান ও খাযাঈনুল ইরফানে বর্ণিত শানে নুযুল’র সারসংক্ষেপ)
বর্ণিত আয়াতগুলোতে ইসলাম ধর্মের সত্যতা ও কাফিরদের মিথ্যা ধর্মের পরিচয় আলাদাভাবে প্রকাশ পেয়েছে। বর্ণিত সূরায় সত্যের সাথে মিথ্যার সংমিশ্রণ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। কাফিরদের শির্কযুক্ত সকল প্রস্তাবনাকে সূরার প্রতিটি আয়াতে দ্ব্যর্থহীনভাবে নাকচ করে দেয়া হয়েছে। বিশ্বাসী ও অবিশ্বাসীদের তাওহীদ ও শির্কের সুস্পষ্ট রূপরেখা ও পার্থক্য বিঘোষিত হয়েছে। ইসলামের বিরোধীতাকারী মিথ্যাশ্রয়ী সত্যদ্বীনের অস্বীকারকারী সত্য গোপনকারী লোকদের ধর্ম পালন ও সত্যদ্বীনের ইবাদত পদ্ধতির মৌলিক পার্থক্য চিত্রিত হয়েছে। রাসূলুল্লাহর প্রচারিত দ্বীনের উদ্দেশ্য সমগ্র জীবনধারা তাওহীদ তথা আল্লাহর একত্ববাদের দিকে সত্যের পথে ন্যায় ও কল্যাণের পথে সকলকে সম্পৃক্ত করা পক্ষান্তরে কাফিরদের ধর্ম ব্যবস্থা হলো শির্কযুক্ত অজ্ঞতা ও জিহালতপূর্ণ সত্য ও মিথ্যার অভিনব সংমিশ্রণ যা ইসলামী চিন্তা চেতনা ও আক্বিদা বিশ্বাসের সম্পূর্ণ বিপরীত। রাসূলুল্লাহর প্রচারিত দ্বীন ও জীবন ব্যবস্থায় বাতিল মতাদর্শের কোন কার্যকলাপ ক্রিয়াকান্ড ও নীতি পদ্ধতিকে দ্বীন মনে করার বিন্দুমাত্র সুযোগ ও অবকাশ নেই।
সূরা ফযীলত:
যে ব্যক্তি শয়নকালে সূরা কাফিরুন তিলাওয়াত করবে ইনশাআল্লাহ তার শেষ নিঃশ্বাসের সময় ঈমান নসীব হবে। (তাফসীরে নুরুল ইরফান)
সহীহ মুসলিম শরীফে ‘হযরত জাবির রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত আছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ‘বায়তুল্লাহ শরীফ তাওয়াফের পর সূরা কাফিরুন ও সূরা ইখলাস সহকারে দু’রাকাত নামায আদায় করতেন। সর্বাধিক হাদীস বর্ণনাকারী সাহাবী হযরত আবু হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত’ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ফজরের দু’রাকাত সুন্নতে সূরা কাফিরুন ও সূরা ইখলাস পাঠ করতেন। [তাফসীরে ইবনে কাছীর, একাদশ খন্ড, পৃ: ৬১২, কৃত: আল্লামা ইবনে কাছীর (র.)]
সূরা কাফিরুন কুরআনের এক চতুর্থাংশ। যে মুসাফির পাঁচটি সূরা পাঠ করে সফরে বের হবে সে নিরাপদে ও প্রচুর স্বচ্ছলতা নিয়ে ফিরে আসবে। সূরাগুলো ১. সূরা কাফিরুন, ২. সূরা নসর, ৩. সূরা ফালাক, ৪. সূরা নাস, ৫. সূরা ইখলাস। [তাফসীরে ফুয়ুজুর রহমান, পারা: ৩০, পৃ: ১০৮৬, কৃত: আল্লামা ফয়েজ আহমদ ওয়েসি (র.)]
মুশরিকদের সাথে সম্পর্কহীনতার নির্দেশ:
কাফির মুশরিকরা ইসলামের চিরশক্র। তাদের পুজা অর্চনার সাথে মুসলমানদের কোন প্রকারের সম্পর্ক কস্মিকালেও গ্রহনযোগ্য নয়। আয়াতে একই কথা বারবার পূনরাবৃত্তি করে কাফির মুশরিকদের সাথে সামগ্রিকভাবে মুসলমানদের পার্থক্য ও ব্যবধান সুস্পষ্টভাবে ঘোষিত হয়েছে। কাফির মুশরিকদের চিরস্থায়ী ঠিকানা জাহান্নাম। আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেন, “নিশ্চয় যে ব্যক্তি শির্কে লিপ্ত হবে আল্লাহ তার উপর জান্নাত হারাম করে দিয়েছেন, তার ঠিকানা জাহান্নাম, আর জালিমদের জন্য কোন সাহায্যকারী নেই। (সূরা:মায়িদা, আয়াত: ৭২)
আল্লাহই একমাত্র উপাস্য:
কলেমার প্রথম অংশ “লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু” আল্লাহ ছাড়া কোন মাবুদ নেই, এতে সকল প্রকার বাতিল মাবুদের অস্তিত্ব অস্বীকার করে একমাত্র আল্লাহই উপাস্য এটাই চুড়ান্তরূপে সাব্যস্ত। আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেন, “তোমরা এক আল্লহর ইবাদত কর, তিনি ব্যাতীত তোমাদের জন্য কোনো মাবুদ নেই। (সূরা: আরাফ, আয়াত: ৫৯)
ইবাদত একমাত্র আল্লাহরই জন্য:
মহান আল্লাহ একমাত্র উপাস্য। তিনি ছাড়া অন্য কারো ইবাদত পাওয়ার অধিকার নেই। আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেছেন, “তাদেরকে এছাড়া কোনো নির্দেশ দেয়া হয়নি, তারা খাটি মনে আল্লাহর ইবাদত করবে। (সূরা: বাইয়্যিনাহ, আয়াত: ৫)
মানব জাতি একমাত্র আল্লাহর ইবাদত বন্দেগী উপাসনার জন্য আদিষ্ট, এরশাদ হয়েছে, “আমি জ্বিন ও মানুষকে আমার ইবাদতের জন্য সৃষ্টি করেছি।” (সূরা: যারিয়াত: আয়াত: ৫৬)
কাফির মুশরিকদের অনুসৃতসব পথই বাতিল:
আল্লাহ নির্দেশিত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রদর্শিত সর্বশ্রেষ্ট ধর্ম পবিত্র ইসলামই একমাত্র বিশ্বমানবতার মুক্তির সনদ। পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহর বাণী বিঘোষিত হয়েছে, “এটাই প্রমানিত যে আল্লাহই সত্য এবং আল্লাহ ব্যাতীত তারা যাদের উপাসনা করে তারা সবাই মিথ্যা। আর নিশ্চয় আল্লাহ সর্বোচ্চ সুমহান। (সূরা: লুকমান, আয়াত: ৩০)
বিপদে, সংকটে, অভাবে, অনটনে, সুস্থতা, অসুস্থতা, স্বচ্ছলতা, অস্বচ্ছলতা, সর্বাবস্থায়, বান্দা একমাত্র আল্লাহরই ইবাদত করবে। তাঁরই সাহায্য প্রার্থনা করবে, আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেছেন, আমিই আল্লাহ, আমি ব্যাতীত কোন ইলাহ নেই। অতএব আমার ইবাদত কর এবং আমার স্মরণার্থে নামায কায়েম কর। (সূরা: ত্বাহা, আয়াত: ১৪)
হে আল্লাহ! আমাদের কে আপনার মকবুল বান্দাদের অন্তর্ভূক্ত করুন। পবিত্র কুরআনের হিদায়াত ও আপনার প্রিয় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র অনুগত্য আমাদের নসীব করুন। আমাদেরকে একমাত্র আপনারই ইবাদত করার তাওফিক নসীব করুন। আমীন।
লেখক : খতীব, কদম মোবারক শাহী জামে মসজিদ, অধ্যক্ষ, মাদরাসা এ তৈয়বিয়া, হালিশহর, চট্টগ্রাম

মুহাম্মদ মোবারক হোসাইন
কদলপুর, রাউজান, চট্টগ্রাম

প্রশ্ন: যিয়ারতের উদ্দেশ্য দুর দুরান্তে সফর করা জায়েজ কিনা? জানালে উপকৃত হব।
উত্তর: যিয়ারতের নিয়্যতে দূর-দুরান্তে সফর করা শরীয়ত সম্মত। নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র অসংখ্য হাদীস ও মুজতাহিদ ইমাম গনের বর্ণনার আলোকে যিয়ারতের নিয়্যতে সফর করার বৈধতা প্রমানিত। হাদীস শরীফে উল্লেখ হয়েছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি একমাত্র আমার যিয়ারতের উদ্দেশ্য আমার সাথে সাক্ষাৎ করতে আসবে তার জন্য কিয়ামতের দিন শাফায়াত করা আমার দায়িত্বভূক্ত হয়ে যাবে। (তাবরানী শরীফ)
হাদীস শরীফে এরশাদ হয়েছে, নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রতিবৎসর শোহাদায়ে ওহুদের কবরে যিয়ারতে গমন করতেন। (উমদাতুলক্বারী শরহে বুখারী, খন্ড: ৮, পৃ: ৭০)
আল্লামা ইমাম ইবনে আবেদীন শামী “ফাতওয়ায়ে শামী” কিতাবে বর্ণনা করেন, ইমাম শাফেয়ী (র.) তাঁর জন্মস্থান ফিলিস্তিন থেকে সূদুর বাগদাদে ইমাম আযম আবু হানিফা (র.)’র যিয়ারতের উদ্দ্যেশে তাঁর মাযারে গমন করতেন। দু’রাকাত নামায পড়তেন, আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করতেন। (ফাতওয়ায়ে শামী)
নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র ওফাতের পর হযরত বেলাল রাদ্বিয়াল্লাহ তা’আলা আনহু সূদুর সিরিয়া থেকে নবীজির যিয়ারতের উদ্দেশ্য মদীনা শরীফ গমন করা হাদীস দ্বারা প্রমানিত। (আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া)
যিয়ারত একটি পুণ্যময় মুস্তাহাব আমল এর জন্য সফর করাও সওয়াবের কাজ। শরীয়ত সম্মত বৈধ কাজকে নাজায়েজ বলা ও বিদআত বলা অজ্ঞতার পরিচায়ক।

পূর্ববর্তী নিবন্ধব্যাংক হিসেবের নমিনি নিয়ে যত বিড়ম্বনা
পরবর্তী নিবন্ধদূরের দুরবিনে