দূরের টানে বাহির পানে

হাসান আকবর | বুধবার , ৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ at ৫:২৩ পূর্বাহ্ণ

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

সাতসকালেও রাস্তায় প্রচুর ট্রাফিক, রকমারি গাড়ির পাশাপাশি বহু মানুষও নেমেছে পথে। ছুটছে নানা গন্তব্যে। এত গাড়ি থাকলেও রাস্তায় কোন জ্যাম নেই। আমরা কোন জটে পড়লাম না। ট্রাফিক সিগন্যালগুলোতে টুকটাক জটলা থাকলেও অল্পক্ষণের মধ্যেই কেটে যাচ্ছে। চার লেনের রাস্তা ধরে ছুটছে অসংখ্য গাড়ি। আমাদের ট্যুরিস্ট বাসটিও বেশ গতি নিয়ে এগুচ্ছিল। একে একে তিন তিনটি হোটেল থেকে আরো বেশ কিছু পর্যটক উঠানো হলো বাসে। হোটেলগুলোর প্রতিটির সামনেই ট্যুরিস্ট দাঁড়ানো ছিল, ঠিক আমার মতো। এতে করে কোথাও কারো জন্য অনাহুত অপেক্ষা করতে হলো না। বাস থামার সাথে সাথেই হুড়োহুড়ি করে যাত্রীরা সিট দখল করলো। তিনটি হোটেল থেকে নেয়া যাত্রীতে বাসটি প্রায় পুরোপুরি ভরে গেল। আমি পেছনে ফিরে এক ঝলকে বাসটি দেখে নিলাম। প্রায় প্রতিটি সিটেই যাত্রী রয়েছেন। চীনসহ সন্নিহিত অঞ্চলের চ্যাপ্টা নাকের মঙ্গোলিয় চেহারার ট্যুরিস্টদের পাশাপাশি ভারতীয় এবং পশ্চিমা নারী পুরুষও রয়েছেন। দেশ বিদেশের হরেক রকমের মানুষে ঠাসা একটি বাসে চড়ে পথ চলছিলাম আমি।

ট্যুরিস্ট গাইড মিজ পিনং লাউড স্পিকার নিয়ে কথা বলতে শুরু করলেন। প্রথমে নিজের পরিচয় দিয়ে দিনভর তিনি আমাদের সাথে থাকবেন বলে জানালেন। একজন পাকা ট্যুরিস্ট গাইডের মতোই তিনি হাসি হাসি মুখ করে কথা বললেন। ঐতিহাসিক তিয়েনআনমেন স্কয়ার ও ফরবিডেন সিটির নাম উল্লেখ করে আজ তিনি আমাদেরকে ওখানে ঘুরাবেন বলে জানালেন। তিনি বললেন, আমরা এখন সরাসরি সেখানে যাবো। ফরবিডেন সিটি! নামটি আমার কাছে কেমন যেনো লাগলো! তিয়েনআনমেন স্কয়ারের নাম আগে শুনলেও ফরবিডেন সিটির নাম কোনদিন শুনিনি। আমাদের গাইড তিয়েনআনমেন স্কয়ার প্রসঙ্গে কিছুই বললেন না, তবে ফরবিডেন সিটি সম্পর্কে বললেন যে, এটি ছয়শ’ বছরেরও বেশি পুরানো একটি শহর। আমরা আপনাদেরকে ওই শহরটিতে নিয়ে যাবো। একদিন ওই শহরে সাধারণ কোন মানুষেরই প্রবেশাধিকার ছিল না। আজ আপনারা সবাই সেখানে ঘুরবেন, বেড়াবেন। তখনকার নির্মিত নানা স্থাপনা মন ভরে দেখবেন। তবে কোথাও কোন কিছু নষ্ট হয় এমন কিছু করা যাবে না। পকেট সাবধানে রাখবেন।

ইন্ডিকেটর লাইটের টিক টিক আওয়াজের সাথে স্পিড কমে যাওয়ায় বুঝতে পারছিলাম যে আমাদের বাসটি থেমে যাচ্ছে, আমরা নামতে যাচ্ছি। তৃতীয় হোটেল থেকে ট্যুরিস্ট নিয়ে যাত্রা করার অল্পক্ষণ পরই থেমে গেলো আমাদের বাস। এত তাড়াতাড়ি কোথায় নিয়ে আসা হলো আমাদের! আমি কিছু বলার আগে কথা বললেন আমাদের গাইড। লাউড স্পিকার ওনার হাতেই ছিল। উনি বেশ সুন্দর করে বললেন যে, আমরা তিয়েনআনমেন স্কয়ারে থামছি। এখান থেকেই আমরা ফরবিডেন সিটিতে চলে যাবো। আপনারা চত্বরটি ঘুরেটুরে দেখুন। ছবি টবিও তুলতে পারেন। তবে অপরিচিত কারো হাতে মোবাইল দিয়ে ছবি না তোলায় ভালো! বিশাল চীনে আমার পরিচিত জন বলতে যে দুচারজন আছেন তারা সবাই গুয়াংজুতে। তাহলে ছবি তোলার জন্য পরিচিতজন কোত্থেকে পাবো! কথাটি বলতেই আমাদের গাইড হেসে কুটিকুটি। বললেন, আমিই ক্লিক করবো। বাসের অন্য সহযাত্রীরা করবে। আপনারা কি এখনো সবাই সবার বন্ধু হননি? আমি হাসলাম। কে যে কার বন্ধু হবে! কারো সাথে তো মন খুলে কথাও বলতে পারলাম না! ভাষার দুর্বলতা যে মানুষকে কি করে বোবা বানিয়ে ফেলে তা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছিলাম।

আমাদের গাইড বলতে থাকলেন, তিয়েনআনমেন স্কয়ার চীনের সর্ববৃহৎ চত্বর। এত বড় খোলা চত্বর চীনের আর কোথাও নেই। বিশাল বেইজিং শহরের একেবারে প্রাণকেন্দ্রেই এই তিয়েনআনমেন স্কয়ার। এটি একটি বিখ্যাত জায়গা। তিয়েনআনমেন স্কয়ার মানে হচ্ছে স্বর্গীয় এবং শান্তির চত্বর। এখানে একটি গেটও রয়েছে। যেটি মুলত ফরবিডেন সিটি থেকে এই চত্বরটিকে আলাদা করেছে। ফরবিডেন সিটির রাজ দরবারে এই গেট দিয়ে যাতায়াত করা যায়। আমি যা বুঝলাম তাতে মনে হলো কোন রাজদরবারকে কেন্দ্র করেই বিশাল এই চত্বরটি তৈরি করা হয়েছিল।

আমাদের গাইড মিজ পিনং কথা বলছেন ইংরেজীতে। তবে আমার দুর্বলতা হেতু উনার সব কথা বুঝতে পারছিলাম না। তিনি তিয়েনআনমেন চত্বরকে পৃথিবীর তৃতীয় বৃহত্তম চত্বর বলেও উল্লেখ করলেন। শহরের বুকে ১০৯ একর জায়গা নিয়ে গড়ে তোলা চত্বরটি চীনের বহু ঐতিহাসিক ঘটনার সাথে জড়িত। কিন্তু আমাদের গাইড এই স্কয়ারের বিখ্যাত হয়ে উঠার গল্পটি বললেন না। ওই ঐতিহাসিক ঘটনার ব্যাপারে একটি শব্দও উচ্চারণ করলেন না। আমি বেশ মনে করতে পারছিলাম যে, এটি সেই চত্বর যেখানে মুক্তবাজার অর্থনীতি এবং গণতন্ত্রের জন্য জড়ো হয়েছিলেন লাখো মানুষ। গণতন্ত্রকামী মানুষগুলোর উপর ট্রাক তুলে দিয়ে এবং নির্বিচারে গুলী করে সামরিক জান্তা খুন করেছিল অসংখ্য মুক্তিকামী মানুষকে। ১৯৮৯ সালের ৪ জুন সংঘটিত ওই ঘটনায় সরকারি হিসেবে মৃতের সংখ্যা শতাধিক। বেসরকারি হিসেবে সহস্রাধিক। এমন রক্তাক্ত একটি স্থানে এসে আমি মনে মনে মুক্তিকামী মানুষগুলোর আত্মার শান্তি কামনা করলাম। কষ্ট পেলাম এজন্য যে, এতগুলো মানুষ জীবন দিলেও তাদের প্রত্যাশা অধরা রয়ে গেছে!

তিয়েনআনমেন স্কয়ার চমৎকার একটি খোলা চত্বর। শুধু প্রাণ দেয়ার জন্য নয়, প্রাণভরে নিঃশ্বাস নেয়ার জন্যও জায়গাটি দারুণ। আসলে তিয়েনআনমেন স্কয়ার হচ্ছে একটি পাবলিক প্লেস। বিশ্বের প্রায় সব মেগাসিটিতেই এমন পাবলিক প্লেস থাকে, থাকা উচিত। যেখানে এক একটি অলস বিকেল প্রাণচঞ্চল হয়ে উঠে। শিশুরা খেলা করে প্রাণভরে, প্রেমিক প্রেমিকার স্বপ্নগুলো একটির পর একটি ডানা মেলে। তাদের মুখ থেকে বের হওয়া মোলায়েম কথাগুলো ঝর্ণার মতো ঝরে ঝরে পড়ে। চীনের শাসনব্যবস্থা নিয়ে পৃথিবীর নানা দেশে বহু সমালোচনা কিংবা চীনের লাখো কোটি মানুষের বুকের একদম গভীরে অনেক অতৃপ্তি থাকলেও তাদের প্রাণভরে নিঃশ্বাস নেয়ার মতো এই ধরনের অসংখ্য পাবলিক প্লেস রয়েছে। বেইজিং শহরেই রয়েছে অনেকগুলো। কিন্তু আমাদের শহরে কোন পাবলিক প্লেস নেই। আমাদের সিআরবি কিংবা সার্কিট হাউজের সামনের অংশসহ আউটার স্টেডিয়াম এলাকাকে পাবলিক প্লেস হিসেবে গড়ে তোলার সুযোগ থাকলেও তা হয়নি। ইট পাথরের জঞ্জালে ভরে যাচ্ছে শহর। আমাদের গাইড জানালেন যে, তিয়েনআনমেন স্কয়ারে সকালের দিকে মানুষ কম থাকে, তবে বিকেলে এখানে অগুনতি মানুষ ঘুরতে আসে। রাত অব্দি বহু মানুষই এখানে সময় কাটায়। অনেকেই পরিবার পরিজন নিয়ে ঘুরে, স্ট্রিট ফুডে ডিনার সেরে রাতে ঘরে ফিরে।

আমরা এসেছি সকালে। এখানে তেমন কোন ভিড় নেই। লোকজনও খুব বেশি নেই। হেথায় হোথায় কিছু পর্যটক ঘুরছেন, ছবি তুলছেন। চীনা ডিজাইনের বেশ বড়সড় একটি ভবন রয়েছে। ভবনটির ভিতরে কি আছে কে জানে!

বেশ কিছুক্ষণ পর আমাদের গাইড মিজ পিনং সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন। বললেন, এখন আমরা আরো অনেক সুন্দর একটি জায়গা দেখবো। বেইজিং এর সবচেয়ে বিখ্যাত জায়গা বললেও কম বলা হবে। ঐতিহ্যমন্ডিত চমৎকার সব স্থাপনায় ভরা অসাধারণ জায়গাটি আপনাদের ভালো লাগবে। তিনি বললেন, এখান থেকে হেঁটেই আমরা সেখানে যেতে পারতাম। তবে বিশেষ সুবিধার কারনে আমরা সবাই বাসে চড়বো। মূল গেটে বাস থেকে নামবো। আমরা সবাই একসাথে থাকার চেষ্টা করবো। কেউ দলছুট হবো না। প্রচুর লোকের ভিড় থাকবে, হারিয়ে গেলে আমাকে ফোন করবেন। আমরা এখন ঐতিহাসিক ফরবিডেন সিটি দেখতে যাবো। (চলবে)

পূর্ববর্তী নিবন্ধদেখার মানুষ শেখার মানুষ মোছলেম উদ্দিন আহমদ
পরবর্তী নিবন্ধপ্রবাহ