দেখার মানুষ শেখার মানুষ মোছলেম উদ্দিন আহমদ

আবু তাহের মুহাম্মদ | বুধবার , ৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ at ৫:২২ পূর্বাহ্ণ

মোছলেম উদ্দিন আহমেদ আওয়ামী ঘরানার রাজনীতির এক বিরল চরিত্র। আমরা সচরাচর আওয়ামী লীগ নেতা বলতে যা বুঝি বা দেখি তার অনেকটা ব্যতিক্রম ছিলেন মোছলেম ভাই। তিনি রাজনীতির পাশাপাশি বিভিন্ন সংগঠন ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে জড়িত ছিলেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট নিয়ে তার ব্যাপক কর্মকাণ্ড ছিল এবং তিনি একটি সার্কেল গড়ে তুলেছিলেন। এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় সিনেট নির্বাচন করে তার প্যানেলকে নিজ কর্ম তৎপরতা দিয়ে বিজয় এনে দেন যার মধ্য দিয়ে আশির দশকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে মুক্তিযুদ্ধপন্থী একটি সিনেট নির্বাচিত হয়।

স্বাধীনতা পূর্বকাল থেকে চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে তিনি মরহুম জহুর আহমেদ চৌধুরীর অনুসারী ছিলেন এবং মরহুম জহুর আহমেদ চৌধুরীর পুত্র শহীদ সাইফুদ্দিন খালেদ চৌধুরীর সাথে চট্টগ্রাম সিটি কলেজ তথা ছাত্রলীগের রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হন। মরহুম জহুর আহমেদ চৌধুরীর লাশ কাঁধে নিয়ে বঙ্গবন্ধুর সাথে মুসলিম ভাই এখনো আমার চোখে ভাসছেন। একাত্তরের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের সূচনা লগ্নে তিনি মহিউদ্দিন চৌধুরীর সাথে গ্রেপ্তার হয়ে চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারে কারারুদ্ধ হন। যুদ্ধ শুরু হয়ে গেলে তারা পাগলের বেশ নিয়ে কোনো রকমে কারাগার থেকে পালিয়ে আসেন। পরে মোছলেম ভাই শেখ ফজলুল হক মনির সান্নিধ্য লাভ করেন এবং যুবলীগকে চট্টগ্রামে সংঘটিত করার দায়িত্ব নেন। তার অন্যতম সাথী ও উৎসাহ দাতা ছিলেন শহীদ মৌলবি সৈয়দ আহমদ। আওয়ামী লীগেরও আগে তিনি দক্ষিণ জেলায় যুবলীগের রাজনীতিকে অত্যন্ত সফলভাবে প্রসারিত ও প্রতিষ্ঠিত করেন এবং একদল সাহসী যুবক তৈরি করেন যারা পরবর্তীতে নানা আন্দোলনে আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব দিয়েছেন। যুবলীগের নেতৃত্বে থাকাকালে দলের সম্মেলন ও নানা জাতীয় দিবসে তিনি নিয়মিতভাবে ম্যাগাজিন প্রকাশ করতেন যাতে থাকতো মুজিবীয় সাহিত্য। দক্ষিণ জেলার রাজনীতি করলেও মোছলেম ভাই চট্টগ্রাম নগরের বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অত্যন্ত সক্রিয় ভূমিকা রেখেছিলেন। নগর কেন্দ্রিক নানা কর্মকাণ্ডে তার উপস্থিতি নজরে আসতো সবার আগে। একই সাথে দলের বাইরে থাকা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ শক্তির সাথে তার সখ্যতা ছিল এবং তিনি তাদের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রাখতেন ‘‘বাক বাকুম পায়রা’ খ্যাত প্রখ্যাত ছড়াকার ও সাহিত্যিক রোকনুজ্জামান খান দাদাভাইয়ের সাথে ছিল তার নিবিড় যোগাযোগ ও সখ্যতা, তাই দাদাভাই চট্টগ্রামে দেশের প্রধান শিশু কিশোর সংগঠন কচিকাঁচার মেলার দায়িত্ব দিয়েছিলেন মোছলেম ভাইয়ের কাঁধে। যার মাধ্যমে সামরিক শাসনের ভেতরে আমরা স্বাধীনতার সত্যিকার ইতিহাস শিশুদের মাঝে তুলে ধরতে ও তাদের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে নিয়ে আসতে কাজ করার এক বিশাল সুযোগ পেয়ে যাই। যেসব শিশুরা পরবর্তীতে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ শক্তি তথা আওয়ামীলীগকে দেশের রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে সফলতা এনে দেন। সে সময় মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ চেতনায় শিশুকিশোরদের গড়ে তোলার দায়িত্ব নিয়েছিলাম মুসলিম ভাই ও কিছু তরুণ মিলে। সে ক্ষণে আমাদের সাথে যুক্ত ছিলেন আলহাজ্ব মুসা রেজা (আমেরিকা প্রবাসী), শফিউল ইসলাম ফারুক (বর্তমানে নগর আওয়ামী লীগের নেতা) সাংবাদিক আবু সুফিয়ান, প্রয়াত নগর ছাত্রলীগ নেতা গোলাম মোস্তফা বাচ্চু, একে এম জাকারিয়া, মো. নাজিম উদ্দিন (বর্তমানে জাপান প্রবাসী) মোসলেহ উদ্দিন মো. বদরুল, ছড়াকার সৈয়দ খালেদুল আনোয়ারসহ আরো অনেকে।

নগরীর শহীদ নগর তথা লালখান বাজার আওয়ামীলীগকে তিনি সংগঠিত করেন এবং এই এলাকার কাউন্সিলর নির্বাচিত হন বিপুল ভোটে। তিনি বহুমুখী সাংগঠনিক কাজে সর্বদা নিজেকে যুক্ত রাখতেন। বীর স্বাধিকার ও মুক্তিযোদ্ধা মোছলেম ভাই ঐতিহ্যবাহী চট্টগ্রামের কমার্স কলেজের প্রাক্তন ছাত্রছাত্রীদের সংগঠিত করেন। তিনি হযরত খাজা গরীবুল্লাহ শাহ (🙂 মাজার মসজিদ ওয়াকফ স্টেট এর সেক্রেটারি ছিলেন। এই স্টেটের কবরস্থানে তার মায়ের পাশে শায়িত হওয়ার ইচ্ছা ব্যক্ত করেছিলেন এবং জীবদ্দশায় ওই স্থান পরিদর্শন করে গেছেন মাস খানেক আগেই।

মোছলেম ভাই তার জীবদ্দশায় রাজনীতিতে কোনো নিজস্ব বাহিনী পুষতেন না, যেটি ছিল এই ঘরানার রাজনীতির এক বিরল দৃষ্টান্ত সব সময় কেতা দুরস্থ এবং সাদাসিধে জীবন যাপন করতেন মোছলেম ভাই। তার সাংগঠনিক তৎপরতার সংবাদ পত্রিকায় ছাপা হলে তিনি অত্যন্ত আনন্দিত হতেন সমাজকর্মেও ছিলেন অত্যন্ত পটু। আমার অগ্রজ বীর মুক্তিযোদ্ধা সফর আলী ভাইয়ের সাথে তার বন্ধুত্বের কারণে আমাদের পরিবারে আসা যাওয়া ছিল। আমার মাকে খালাম্মা বলে তিনি আমাদের গৃহে প্রবেশ করতেন হয়তো আর কোনদিন মোছলেম ভাই আসবেন না, ভোরে সাংগঠনিক কাজে আমাকে ঘুম থেকে জাগিয়ে সাথে নিয়ে যাবেন না, দূর পাড়াগাঁয় শিশু সংগঠন বা চবি’র কোনো ভোটার খুঁজতে। তার ব্যক্তিগত একটি পাঠাগার ছিল। প্রতিটি বইয়ের শুরুতে শিলমারা থাকতো ‘মোছলেম উদ্দিন আহমদের ব্যক্তিগত সংগ্রহ‘’ এখনো খুঁজলে পাওয়া যাবে মোছলেম ভাইয়ের পাঠাগারের বই আমার বুক সেলফে।

কালের প্রবাহে এরকম মোছলেম উদ্দিন আহমদরা আসবেন শ্রমে ঘামে জাতিকে কিছু দিয়ে যাবেন যা নিতান্তই মহান মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে। আমরা এই নেতার রুহের মাগফেরাত কামনা করি। আল্লাহ তাকে বেহেশত নসিব করুক।

লেখক: সাবেক ছাত্রলীগ নেতা, কবি ও সিনিয়র সাংবাদিক।

পূর্ববর্তী নিবন্ধস্মরণ: জননেতা মোছলেম উদ্দিন আহমদ
পরবর্তী নিবন্ধদূরের টানে বাহির পানে