দূরের টানে বাহির পানে

হাসান আকবর | বুধবার , ১২ জানুয়ারি, ২০২২ at ৬:২৪ পূর্বাহ্ণ

গুয়াংজু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে হাজার হাজার মানুষ। হাজার হাজার মানে হাজার হাজার। বিমানবন্দরের ভিতরে গিজ গিজ করছে মানুষ। যে দিকে তাকাচ্ছি সেদিকেই মানুষ। মানুষ ছুটছে, মানুষ হাঁটছে, মানুষ দৌঁড়াচ্ছে। অগুনতি নারী পুরুষ। মা বাবার সাথে ছুটছে পুতুলের মতো শিশু, কিশোর। ছোট্ট ছোট্ট বাচ্চাগুলো কী সুন্দর করেই না পথ চলছে!! কোন কোন বাচ্চা উঠে বসেছে লাগেজ কেরিয়ার ট্রলিতে!!
চারদিকে অপার সৌন্দর্য হাতছানি দিলেও আমার মন পড়ে রয়েছে সহযাত্রীদের মুখে। ধারে কাছের প্রতিটি মানুষের দিকে তাকাচ্ছিলাম আমি, হাঁটছি আর তাকাচ্ছি। খোঁজ করছিলাম আমার সহযাত্রীদের। কিন্তু এত মানুষের ভীড়ে কোথায় পাবো তাদের? আমি আমার দলের সবাইকে হারিয়ে ফেলেছি, কিংবা আমি হারিয়ে গেছি! ওনারা কে যে কোন পথে গেছে কে জানে! ধারে কাছে একজন বাঙালীকেও দেখছিলাম না, যার সাথে কথা বলে সহযাত্রীদের খোঁজার ব্যাপারে কিছু সহায়তা পাওয়া যাবে।
আমি রয়েছি ইন্টারন্যাশনাল টার্মিনালে। লাগেজ নিয়ে কিছুদূর আসার পরই আমি হারিয়ে যাই বা হারিয়ে ফেলি সকলকে। এখন আমাকে যেতে হবে ডোমেস্টিক টার্মিনালে। যেখান থেকে সাংহাইর পথে উড়াল দেবে আমাদের পরবর্তী ফ্লাইট। ডোমেস্টিক টার্মিনাল কত দূরে! সেখানে যাওয়ার উপায়ই বা কি? বাস ট্রেনের কোন ব্যবস্থা আছে, নাকি হেঁটেই যাওয়া যাবে! দুবাই বিমানবন্দরে ট্রেন চলে, ট্রেন চলে সিংগাপুর এবং মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুরেও। ট্রেনে যাতায়ত করতে হয় এক টার্মিনাল থেকে অন্য টার্মিনালে। বাসের ব্যবস্থাও থাকে। পায়ে হেঁটে যাওয়ারও সুযোগ থাকে, তবে কেউ পারতপক্ষে ওপথ মাড়ায় না। গুয়াংজু বিরাট বিমানবন্দর, আধুনিক বিমানবন্দর। এখানের কি অবস্থা কে জানে!
আমি একটু দাঁড়ালাম। কফি পোড়া ঘ্রান খুব টানছিল আমাকে। চোখ ঘোরাতেই চোখে পড়লো বহুল প্রত্যাশার কফিশপ। জমজমাট বিকিকিনি চলছে। এক তরুণী কফি বানাচ্ছে। এতেই চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছে দারুণ ঘ্রান, কফি পোড়া গন্ধ। যে গন্ধ আমার ব্রেনে গিয়ে সুড়সুড়ি দিচ্ছে। আমি ক্যাফের সামনে গেলাম। একটি কফি দেয়ার অনুরোধ করলাম। বাড়িয়ে দিলাম কার্ড।
ধুমায়িত কফিতে চুমুক দিতে দিতে আমার করনীয় নির্ধারণের চেষ্টা করলাম। আমি কি ডোমেস্টিক টার্মিনাল খুঁজে সেখানে চলে যাবো, নাকি এখানে অপেক্ষা করবো! আমার লায়ন্স ক্লাবের সেক্রেটারি লায়ন ফজলে করিম ভাই কী উনার প্রেসিডেন্টকে অকুলে ভাসিয়ে দিয়ে চলে যাবেন! বুঝতে পারছিলাম না। কফি খেতে খেতে নানা ছক আঁকছিলাম। আমাদের সাংহাইর ফ্লাইট যে গেট থেকে ছাড়বে সেখানে গিয়ে অপেক্ষা করবো কিনা তাও বুঝতে পারছিলাম না। আমার সাথে পাসপোর্ট ও টিকেট আছে, কোন গেট থেকে সাংহাইর ফ্লাইট উড়বে তা খুঁজে বের করা কঠিন নয়। আমি ইচ্ছে করলে বোর্ডিং কার্ড নিয়ে ওই গেটে অপেক্ষা করতে পারি, কিন্ত কি করা উচিত বুঝতে পারছিলাম না। পাসপোর্ট এবং টিকেট সাথে থাকাটা আমার জন্য বড় ধরনের স্বস্তির কারণ হলো। অনেক সময় সহযাত্রীদের সবার পাসপোর্ট একজনের কাছে নিয়ে রাখে, টিকেটও। বহুসময় আমিও তাই করি। কিন্তু আজ যদি পাসপোর্ট ও টিকেট সাথে না থাকতো তাহলে ভোগান্তি বহুগুনে বেড়ে যেতো! ভবিষ্যত পথচলার জন্য এটি একটি শিক্ষাও হয়ে গেল!
আমার ভাবনাগুলো একটি দুষ্টুচক্রে পড়ে গেছে। আমি সাংহাইর ফ্লাইটের গেটে চলে গেলে সহযাত্রীরা যদি আমাকে এখানে খুঁজতে থাকেন তাহলে কারো সাথে কারো দেখা হবে না। আবার তারা যদি নির্দিষ্ট গেটে গিয়ে সাংহাই যাওয়ার ফ্লাইটের ওখানে আমার জন্য অপেক্ষা করেন আর আমি যদি এখানে চক্কর মারি তাহলে তাও গোলমাল হয়ে যাবে। এই দুষ্টুচক্র থেকে বের হওয়ার জন্য আমি ‘ইনফরমেনশন’ সেন্টারে গিয়ে কিছু সহায়তা চাওয়ার চিন্তা করলাম। বিশেষ করে মাইকে যদি ফজলে করিম ভাইকে কিছু বলা যায়! কিন্তু ইনফরমেশন সেন্টার কোন দিকে!
ছুটতে থাকা মানুষগুলোর মধ্যে বাহ্যতঃ ভদ্র দেখে কয়েকজনের পথ আটকালাম। ইনফরমেশন ডেক্সে কোনপথে যাবো জানতে চাইলাম। কিন্তু তারা আমার দিকে কিছুক্ষণ হাঁ করে তাকিয়ে থাকলো, অতপর মাথা নেড়ে সামনের দিকে ছুটতে লাগলো।
অল্পক্ষণের মধ্যে আমি বুঝে গেলাম যে, আমি যাদের পথ আটকে কথা বলছি তারা কেউ ইংরেজী বুঝেন না। আমাকে হয় চাইনীজ ভাষায় বলতে হবে, নাহয় নিজে নিজে হেঁটে হেঁটে সামনে এগুতে হবে, খুঁজতে হবে। অন্যথায় এই সংকটের সুরাহা হবে না। আমি জানতাম যে চীনসহ সন্নিহিত অঞ্চলে ইংরেজী ভাষার খুবই দুরবস্থা। এদের কোটি কোটি মানুষ এক লাইনও ইংরেজী জানে না। অনেক সময় জানলেও বলে না। এমনকি ইংরেজের সাথেও এরা নিজেদের চাইনীজ ভাষায় কথা বলে। ব্যাপারটি এমন যে, আমার দেশে বেড়াতে হলে আমার ভাষা জানতে হবে, আমার সাথে ব্যবসা করতে হলে আমার ভাষা শিখতে হবে, আমার সহায়তা নিতে হলে আমার ভাষায় কথা বলতে হবে। তারা সফল হয়েছে। পৃথিবীর নানা দেশের নানা ভাষী মানুষ চীনা ভাষা শিখে তাদের সাথে ব্যবসা বাণিজ্য করছে। আর এভাবে চীন দিনে দিনে পরিণত হয়েছে পৃথিবীর সেরা অর্থনীতির দেশে, সুপার পাওয়ারে।
নিজের অজান্তে একটি দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। আহা, পৃথিবীতে মায়ের ভাষার জন্য কেবলমাত্র আমরাই রক্ত দিয়েছি। কিন্তু মায়ের ভাষাকে পৃথিবীতে সম্মানের আসনে বসানোর জন্য যা করা দরকার ছিল তার অনেককিছুই আমরা করতে পারিনি। চীনারা মায়ের ভাষার জন্য রক্ত দেয়নি, কিন্তু মায়ের ভাষাকে সম্মানিত করার জন্য যা করা দরকার তার সবটুকুই তারা করতে পেরেছে। আর তাই তাদের ভাষা আজ সম্মানিত। পৃথিবীর নানা জাতের নানা বর্ণের মানুষ চীনা ভাষা শিখে তাদের সাথে ব্যবসা বাণিজ্য করছে। ইউরোপ আমেরিকার বহু মানুষকেও বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের বাণিজ্যের জন্য চীনা ভাষা শিখতে হয়েছে, হচ্ছে।
কফির মগটি হাতে নিয়ে হাঁটছিলাম সামনে। লাগেজ কেরিয়ার ট্রলিটি নিয়ে পথ চলছিলাম। আমাদের পরবর্তী ফ্লাইটের সময় এখনো দেরি আছে, সুতরাং টেনশনের কিছু নেই। কিছু না কিছু একটা হয়ে যাবে। তাছাড়া পৃথিবীতে এমন কোন সমস্যা নেই যেটির সমাধান হয়না। আবার এমন কোন সমস্যা নেই যেটি আমার আগে অন্য কোন মানুষ ফেস করেনি। সুতরাং যা হওয়ার হবে, আমি কফি খাওয়ার আনন্দ মাটি করতে চাচ্ছিলাম না।
হাঁটছিলাম সামনে। নানা কিছু দেখে দেখে পথ চলছিলাম। আমাকে পেছনে ফেলে ছুটছে মানুষ। আমি হাঁটছি তাদের পেছনে। আমি হারিয়ে গেছি, তবে ভয় পাচ্ছিলাম না। তেমন একটা তাড়াও ছিল না ভিতরে। রাত ভোর হয়ে আসছে, কিন্তু এয়ারপোর্টের ভিতরে তা বুঝার কোন উপায় ছিল না। লক্ষ কোটি বাতি জ্বলছে। সূঁই হারালেও খুঁজে পাওয়া যাবে! হঠাৎ ‘সূঁ্‌ই হারানো’র কথা মনে পড়ায় হেসে উঠলাম। আস্ত মানুষ হারিয়ে গেছে, খুঁজে পাচ্ছি না। আবার সূঁই!!!
হুররে!! ডোমেস্টিক টার্মিনালের পথ দেখিয়ে একটি এ্যারো সাইন পেলাম। বাহ, আন্দাজে হাঁটলেও আমি ঠিকপথেই এগুচ্ছিলাম। কতদূরে কে জানে, লম্বা পথ হলেও আমি হেলে দুলে ঠিকঠাকভাবে সামনের দিকে হাঁটতে লাগলাম। এক হাতে কফির মগ, অন্যহাতে আলতো করে ঠেলছি ট্রলি। এত আরামদায়ক ট্রলি আমি আর কখনো কোথাও পেয়েছিলাম কিনা মনে করতে পারছিলাম না। একেবারে আলতো ছোঁয়ায় পথ চলছে ট্রলিটি।
আগেই বলেছি গুয়াংজু বিমানবন্দর বিশাল। শুধু ইমিগ্রেশন ডেস্ক দেখে আমার মাথা ঘুরে গিয়েছিল। এখন বিমানবন্দরের দীর্ঘ পথ দেখে অনুমান করতে চেষ্টা করছিলাম আসলে এটি কত বড়। এক চোখের পথ বলতে যা বুঝায় ঠিক যেন তাই। যতটুকু দৃষ্টি যাচ্ছিল ততটুকুই বিমানবন্দর। হাঁটার পথ, চলন্ত পথ, চলন্ত সিঁড়িসহ নানা আয়োজন পরতে পরতে। হারিয়ে গেলেও আমি চারদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা আনন্দগুলো উপভোগ করতে করতে পথ চলছিলাম। বিমানবন্দরের হেথায় হোথায় ভেন্ডিং মেশিন। ফ্রিজের মতো এই মেশিন থেকে ইচ্ছেমতো জিনিস কিনে নেয়া চলে। কয়েন বা মুদ্রা দিলে স্বয়ংক্রীয়ভাবে নানা ধরনের পণ্য মেশিন থেকে বেরিয়ে আসে। চকলেট, বিস্কিট, জুসসহ নানা খাবার। জাপানের টোকিও বিমানবন্দরের ভেন্ডিং মেশিন থেকে গরম গরম চা খেয়েছিলাম। ইন্দোনেশিয়ার বালিতে খেয়েছিলাম ডাবের পানি, ভিতরে নারকেল কুচি। কত দেশের কত ধরণের ভেন্ডিং মেশিনে কত রকমের জিনিস যে বিক্রি হয়! থরে থরে সাজানো পণ্য। ভেন্ডিং মেশিনের তাক ভরে রয়েছে বিভিন্ন জিনিসে। অবশ্য কি কি জিনিস সেখানে রয়েছে, কি কি জিনিস কেনা বা নেয়া যাবে, কোনটির দাম কত তা দেখা যাচ্ছিল মেশিনের বাইরে থেকে, কাঁচের ভিতর দিয়ে। আমার হাতে কফির মগ, ফ্লাইটে খাবার খেয়েছি। তাই ভেন্ডিং মেশিন থেকে চকলেট বা জুস জাতীয় খাবার কেনার কোন প্রয়োজন আমার হলো না। খাবারের জন্য আমার কোন আকুতি নেই, নেই বাড়তি কোন আগ্রহ। তবে আমাদের দেশের বিমানবন্দরগুলোতে এক একটি ভেন্ডিং মেশিনের জন্য আমার আকুতি রয়েছে, রয়েছে আগ্রহ। এসব আয়োজন আমাদের দেশ থেকে যে কত দূরে!! (চলবে)
লেখক : চিফ রিপোর্টার, দৈনিক আজাদী।

পূর্ববর্তী নিবন্ধবিশ্বাসের স্বচ্ছতায় গড়ে উঠুক সম্পর্ক
পরবর্তী নিবন্ধমহাবীর মাস্টারদা সূর্যসেন ও আমাদের স্বাধীনতা