মহাবীর মাস্টারদা সূর্যসেন ও আমাদের স্বাধীনতা

জামাল উদ্দিন | বুধবার , ১২ জানুয়ারি, ২০২২ at ৬:২৫ পূর্বাহ্ণ


স্বাধীনতা ছাড়া কেউ বেঁচে থাকতে চায় না। এমনকি বনের পাখিও খাঁচা থেকে মুক্তি লাভের জন্য ছটফট করে। আর, মানুষ তো বুদ্ধি-জ্ঞান-মেধায় সকল প্রাণীর সেরা। তাই শেকলে বাঁধা থাকতে চায় না কখনো।
আমরা এমন একজন মহাবীরের কথা শুনবো, যিনি দেশকে পরাধীনতার শেকল থেকে মুক্ত করার জন্যে নিজের জীবনটিকে উৎসর্গ করেছিলেন। তিনি সূর্য সেন। মাস্টারদা সূর্য সেন নামেই যার পরিচয়।
তিনি ছিলেন এমন এক মহাবীর, যার কাছে ছিলো ‘জীবন মৃত্যু, পায়ের ভৃত্য।’ মাত্র ৪০ বছরের স্বল্প পরিসরের জীবন তাঁর। মাতৃভূমিকে বিদেশি ইংরেজ বেনিয়াদের হাত থেকে মুক্তির জন্যে, তিনি নিজের যাবতীয় সাধ-আহ্লাদ-বিলাস-ব্যসন-সবকিছুই বিসর্জন দিয়েছিলেন।
সূর্য সেন-এর জন্ম ১৮৯৪ সালে। চট্টগ্রাম জেলার রাউজান থানার নোয়াপাড়া গ্রামে। তাঁর বাবার নাম রাজমণি সেন ও মায়ের নাম শশীবালা দেবী। গ্রামের স্কুলে প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করে তিনি চট্টগ্রাম শহরে এসে ন্যাশনাল স্কুল থেকে এন্ট্রান্স পাস করেন। তারপর চট্টগ্রাম কলেজ থেকে এফএ পাস করে বহরমপুর কলেজ থেকে বিএ পাস করেন। বহরমপুর কলেজে পড়ার সময় তাঁর মধ্যে বিপ্লবী চেতনা জেগে ওঠে এবং গুপ্ত দলের সাথে যোগাযোগ ঘটে।
বিএ পাস করার পর তিনি চট্টগ্রামে ফিরে এলেন এবং অভিভাবকদের চাপে পড়ে বিয়ে করতে বাধ্য হলেন। ১৯১৯ সালে কানুনগোপাড়ার পুষ্পকুণ্ডলা দত্তকে বিয়ে করেন। কিন্তু মাতৃভূমি ও স্বজাতির মুক্তির মন্ত্রে আকুল সূর্য সেন নববধূর সঙ্গে একটুও কথা না বলে, বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলেন। ঝাঁপিয়ে পড়লেন ইংরেজ তাড়ানোর মরণজয়ী সংগ্রামে। আত্মবলি দানের এই যুদ্ধে নিবেদন করলেন নিজের অমূল্য জীবন।
মাস্টারদা ছিলেন ‘যুগান্তর’ দলের সদস্য। ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলনে সশস্ত্র বিপ্লবীদের অনেকেই ব্রিটিশ আদালতের রায়ে উঠতে হয়েছে ফাঁসির মঞ্চে। যেমন ক্ষুদিরাম। মাস্টারদা সূর্য সেন। দেশের মুক্তি সংগ্রামের ইতিহাসে চট্টগ্রামে ১৯৩০ থেকে ১৯৩৪ সালের ঘটনাবলি ইতিহাসে অপার মহিমা নিয়ে জ্বলজ্বল করে আছে। চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, ঢাকা, কলকাতা, চন্দননগর এসব স্থানে ছিলেন বিপ্লবীদের কর্মক্ষেত্র। চট্টগ্রামের কালারপুল, ধলঘাট, গৈরলার বীরত্বগাথা সূর্য সেন এর অমর অক্ষর মহিমার সাক্ষ্যগ্রহণ করে আছে। ১৯৩০ সালের ১৮ এপ্রিল যুব বিদ্রোহের সূচনা। জালালাবাদ পাহাড়ে ১৮ এপ্রিল থেকে ২১ এপ্রিল পর্যন্ত বিপ্লবীদের মরণপ্রাণ লড়াই, অকাতরে প্রাণ বিলিয়ে দেয়া কেবল ভারতবাসী নয়, পুরো পৃথিবীকেই অবাক করে দিয়েছিলো।
সূর্য সেন গ্রেপ্তার
অমিত তেজা সশস্ত্র বিপ্লবের মহানায়ক সূর্য সেনের জীবন ছিল সব সময় দুঃখবহ। নিশ্চিন্তে দু’দণ্ড সময় কাটানোর সুযোগ তার ছিল না। তাঁকে ঘিরে থাকত সবসময় ইংরেজ প্রশাসনের কড়া নজরদারি। তাদের শুধু একটাই চাওয়া ছিল- কখন তাকে হাতেনাতে গ্রেপ্তার করা যায়। তাই হন্যে হয়ে সূর্য সেনকে খুঁজতেন ইংরেজ প্রশাসন তাদের আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী ও গোয়েন্দারা। তাঁরা সবসময় সূর্য সেনের পিছু লেগে থাকত। সূর্য সেনও ইংরেজদের চোখে ধুলো দিয়ে এখানে সেখানে আত্মগোপনে থাকতেন।
সেই সময় ১৯৩৩ সালের ২৭ মে সূর্য সেন চট্টগ্রামের গৈড়লা গ্রামের মহিম চন্দ্র বিশ্বাস ও ক্ষীরোদা প্রভা বিশ্বাসের বাড়িতে আত্মগোপনে ছিলেন। কিন্তু সূর্য সেনকে ধরিয়ে দেওয়ার নগদ অর্থ পুরস্কারের লোভে স্থানীয় লোক নেত্র সেন ইংরেজদের কাছে গোপনে সূর্য সেনের খবর পৌঁছে দেয়। অতঃপর ইংরেজ বাহিনীর কাছে অনেকটা আকস্মিকভাবে ঐ বাড়িতে অপ্রস্তুত সূর্য সেন আক্রান্ত হন। সূর্য সেন ও ব্রজেন সেন সেখানে ইংরেজদের হাতে বন্দী হন। সূর্য সেনের সহযোদ্ধারা পালিয়ে যেতে সক্ষম হন। সূর্য সেনকে ধরিয়ে দেওয়া বিশ্বাসঘাতক নেত্র সেনকে ১৯৩৪ সালের ১১ জানুয়ারি আরেক বিপ্লবী কিরণ সেন দা’র কোপে হত্যা করে।

সূর্য সেনের ফাঁসি
চট্টগ্রাম বিদ্রোহ সফল সশস্ত্র অভ্যুত্থানের মহানায়ক বিপ্লবের মহান নেতা সূর্য সেনকে গ্রেপ্তারের পর বিচারের জন্য ব্রিটিশ সরকার স্যোশাল ট্রাইব্যুনাল গঠন করে। ইংরেজ বিচারকদের নিয়ে গঠিত লোকদেখানো স্যোশাল ট্রাইব্যুনাল তার বিচারকার্য সম্পন্ন করে সূর্য সেনের ফাঁসির আদেশ দেয়। বাংলার আপামর জনগণ সারা বাংলা এ অযৌক্তিক রায়ে ক্ষুব্ধ ও স্তম্ভিত হয়ে পড়ে। চারদিকে ব্রিটিশ শাসনের প্রতি ঘৃণা-প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। ১৯৩৪ সালের ১২ জানুয়ারি মধ্যরাতে চট্টগ্রাম কারাগারের অভ্যন্তরে অতি গোপনীয়তার মধ্য দিয়ে সূর্য সেনের ফাঁসি কার্যকর করা হয়। জেলের সেলের মধ্যে নিরস্ত্র সূর্য সেনের সাথে জেলের কারারক্ষীদের সংঘর্ষও ঘটে। শেষে অমানুষিক নির্যাতন ও প্রহারে জর্জরিত আহত ও অর্ধচেতন সূর্য সেনকে জোর করে নিয়ে গিয়ে নিজেরাই ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলিয়ে তাঁর মৃত্যু নিশ্চিত করে ব্রিটিশ প্রশাসন।
সূর্য সেনকে নৃশংসতার এখানেও শেষ হয়নি প্রতিশোধপরায়ণ ইংরেজদের। অনেকের ধারণা ‘দ্য রিনাউন’ নামক যুদ্ধজাহাজে গভীর বঙ্গোপসাগরে পাথর বেঁধে সূর্য সেনের মরদেহ ডুবিয়ে দেয় ঘৃণিত ইংরেজ শাসকগোষ্ঠী।
সূর্য সেনের শেষকথা
মাস্টারদা সূর্য সেন ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের সশস্ত্র অভ্যুত্থানের অন্যতম মহানায়ক। ১৯৩০ সালের ১৮ এপ্রিল চট্টগ্রামে ইংরেজ সাম্রাজ্যবাদের কাছ থেকে সশস্ত্র বিদ্রোহের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল হয়েছিল সূর্য সেনের নেতৃত্বে।
১৯৩০ সালের ২১ এপ্রিল ব্রিটিশ বাহিনীকে পরাজিত করে চার দিন চট্টগ্রাম স্বাধীন রাখার পর প্রায় চার বছর যাবৎ একটির পর একটি গেরিলাযুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়ে ১৯৩৪ সালের ১২ জানুয়ারি কালজয়ী বিপ্লবী সূর্য সেন ফাঁসির মঞ্চে দেশের জনগণের জন্য নিজের প্রাণ উৎসর্গ করেন।
অমর বিপ্লবী সূর্য সেন ফাঁসির পাঁচ ঘণ্টা আগে দেশের যুব সমাজকে এই বলে ডাক দিয়ে গেছেন- ‘আমার বন্ধুরা এগিয়ে চল, কখনও পিছিয়ে যেও না। পরাধীনতার অন্ধকার সরে যাচ্ছে। ঐ দেখা যাচ্ছে স্বাধীনতার নবারুণ। কখনো হতাশ হয়ো না। সাফল্য আমাদের হবেই। পৃথিবীতে এমন কোনো শক্তি নাই যা আমাদের স্বাধীনতার পথ রুদ্ধ করতে পার।’
চট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহের সর্বাধিনায়ক মাস্টারদা সূর্যসেন। ভারতের মুক্তি সংগ্রামের অন্যতম মহান নেতা, সাম্রাজ্যবাদী শৃঙ্খলমুক্ত প্রথম বিপ্লবী সরকারের প্রধান ও রাষ্ট্রপতি।
মাস্টারদা সূর্য সেন ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের সশস্ত্র অভ্যুত্থানের অন্যতম মহানায়ক বিদ্রোহ-সংগ্রামের মাধ্যমে তারই নেতৃত্বে চট্টগ্রামের অকুতোভয় বিপ্লবীরা ইংরেজবাহিনীকে পরাজিত করে চট্টগ্রামে ব্রিটিশ শাসনক্ষমতাকে অচল করে দেয়। একটি জ্বলন্ত অগ্নিপিণ্ডের মতো সূর্য সেন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী শক্তির বিরুদ্ধে ভারত তথা বাংলার আকাশে বিপ্লবের অগ্নিশিখা ছড়িয়েছেন।
জয় বাংলা
এখানে শেষ হলেও আশার শিখা জ্বালাতে পারি এ জন্য যে, বাংলাদেশ স্বাধীন। বাংলাদেশ এগুচ্ছে এবং এগিয়ে যাবে তরুণপ্রাণের জাগরণে। আছে আমাদের তেরশত নদ-নদীর প্রবহমান গতিধারা। বঙ্গবন্ধুর চিরদৃপ্ত তর্জনী, বজ্রকণ্ঠ,আদর্শ। আছে সূর্য সেনের মহান আত্মত্যাগ।
মাস্টাদা’র বিপ্লবী জীবনী নিয়ে বলাকা প্রকাশনের সার্বিক সহযোগীতায় নির্মিত হয়েছে একটি পূর্ণাঙ্গ তথ্যচিত্র। ১২ জানুয়ারি ঐতিহাসিক জেএম সেন হল প্রাঙ্গণে ‘তোমাকেই চিনি সুর্য সেন’ মাস্টারদা সুর্য সেনের বিপ্লবী জীবনের পূর্ণাঙ্গ তথ্যচিত্রের উন্মুক্ত প্রদর্শনের আয়োজন করা হয়েছে। জয় হোক জন-জাগরণের, জয় বাংলা।
লেখক : গবেষক ও প্রকাশক

পূর্ববর্তী নিবন্ধদূরের টানে বাহির পানে
পরবর্তী নিবন্ধপ্রবাহ