সুশিক্ষাবঞ্চিত উচ্চশিক্ষিত দুর্নীতিবাজরাই দেশকে পেছনের দিকে টানছে, দেশের সমস্ত অর্জন ম্লান করে দিচ্ছে একথা আমরা আজ জোর দিয়ে বলতে পারি। এখানে সাম্প্রতিক আলোচিত–সমালোচিত দুইজনের দৃষ্টান্ত তুলে ধরতে চাই। আমাদের দেশ ও সমাজে কিছু পদ–পদবিকে আমরা সমীহ করে থাকি। যেমন ডক্টর, ডাক্টার, প্রফেসর, ইঞ্জিনিয়ার, আইনজীবী, আল্লামা, মাওলানা ইত্যাদি পদবিধারী লোককে আমরা বিশেষ সম্মানের চোখে দেখি। তন্মধ্যে ডক্টর বা ডাক্টার উপাধিধারী ব্যক্তিরাও সবার কাছে শ্রদ্ধাতুল্য। এই ডক্টররা সর্বোচ্চ শিক্ষিত এবং সর্বোচ্চ সনদধারী। তাই তাদের সম্মান–মর্যাদা অনেক উঁচুতে। কিন্তু এই যে কয়েকদিন ধরে পুত্র মুসফিকুর রহমান ইফাতের ‘ছাগলকাণ্ডে’ ধরা খাওয়া পিতা ড. মতিউর রহমানের (জাতীয় রাজস্ব বোর্ড এনবিআরের কাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট আপিলাত ট্রাইব্যুনালের সভাপতি) হাজার কোটি টাকার দুর্নীতি গণমাধ্যমে উঠে আসছে তা আপনি কীভাবে দেখবেন? ড. মতিউর রহমান একজন উচ্চ শিক্ষিত লোক। তা তাঁর পদ–পদবি দেখেই আঁচ করা যায়। এনবিআরের বড় পদে অধিষ্ঠিত থেকে তিনি ‘মেগা দুর্নীতি’ করেছেন। দুর্নীতির মাধ্যমে হাজার হাজার কোটি টাকা অর্জন করেছেন বলেই এখন ধরা না খেয়ে পারেন নি। এই উচ্চ শিক্ষিত ডক্টরেটদের দিয়ে আমরা কী করবো? সরকারি বড় পদে আসীন থেকে তিনি টাকার পাহাড়, সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলেছেন। দেশের বিভিন্ন স্থানে অট্টালিকা প্রাসাদ বানিয়ে শাদ্দাদি জীবনে গা ভাসিয়ে দিয়েছেন। তিনি যদি পারিবারিকভাবে কিংবা প্রাতিষ্ঠানিকভাবে সুশিক্ষা পেতেন কিংবা নৈতিক শিক্ষা অর্জন করতেন তবে কি তাঁর এই অবস্থা হতো? ড. মতিউর আজ ঘৃণ্য নিন্দিত এক চরিত্র। পাপ বাপকেও ছাড়ে না বলে একটা কথা আছে। পুত্রের ‘ছাগলকাণ্ডের’ জেরে মতিউরের কাণ্ডকীর্তি সীমাহীন দুর্নীতি–অনিয়মের চিত্র আজ গণমাধ্যমে প্রকাশ পাচ্ছে। ফলে তিনি ইতিমধ্যে এনবিআরের পদ থেকে অপসারিত হয়েছেন। ছিলেন সোনালি ব্যাংকের পরিচালক। এই পদও খুইয়েছেন। এর আগে আমরা কী দেখলাম? পুলিশের মহাপরিদর্শক আইজিপি ড. বেনজীর আহমদের বে–মেছাল বে–নজীর (দৃষ্টান্তহীন, তুলনাহীন) দুর্নীতির খবর যেভাবে গণমাধ্যমে উঠে আসছে তা পড়ে ও দেখে আমরা গভীরভাবে শিহরিত হচ্ছি, উদ্বিগ্ন ও বিচলিত হচ্ছি। আইজিপি থাকাকালে এই বেনজীর সাহেব সারা দেশে সম্পদের পাহাড় গড়েছেন। সারা দেশে হাজার হাজার একর জমি কিনেছেন। অসংখ্য ফ্ল্যাট প্রাসাদ বাগান বাড়ি ও রিসোর্টের মালিক তিনি। এমনকি সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের জায়গা জমিও তিনি অবৈধ প্রভাব খাটিয়ে জবরদখল করেছেন। এই মতিউর–বেনজীররা কেউ সাধারণ মানুষ নন। এরা সকলেই উচ্চ শিক্ষিত দুর্নীতিবাজ। বড় পদ–পদবিধারী কুখ্যাত সেরা দুর্নীতিবাজ এরা। ছাত্র জীবন থেকে এরা নৈতিক শিক্ষা হয়তো পায়নি, ফলে তাদের নৈতিক চরিত্রের অধোগামিতা আমরা আজ প্রত্যক্ষ করছি। শিক্ষা জীবন থেকেই নৈতিক শিক্ষার সুযোগ পেলে ওরা এমন ভয়ংকর দুর্নীতিবাজ হয়ে উঠতে পারতো না।
স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পেরিয়ে গেছে। কিন্তু অতীব দুঃখজনক যে, আমাদের সামগ্রিক শিক্ষা ব্যবস্থায় নৈতিকতা, মানবিকতা ও আদর্শিক বিষয়গুলো এখনো উপেক্ষিত রয়ে গেছে। আমরা প্রজন্মের মাঝে নৈতিক শক্ত ভিত্তি গড়তে ব্যর্থ হয়েছি। শিক্ষা যেন আজ অন্য সব কিছুর মতো ‘বাজারি পণ্য’ হয়ে উঠেছে। শিক্ষাকে আমরা অনেকে ‘ব্রত’ হিসেবে দেখি না। বরং যেভাবেই হোক বৈষয়িক লাভালাভের পেছনে রুদ্ধশ্বাসে আমরা ছুটছি। নীতি নৈতিকতা বিসর্জন দিয়ে যেনতেন প্রকারে টাকা উপার্জনই যেন আমাদের জীবনের মিশন ও ভিশন হয়ে উঠেছে। বড় ডাক্তার, প্রফেসর, উকিল হওয়ার স্বপ্নে আমরা যতটা বিভোর ও মগ্ন– নিজেকে সৎ, ন্যায়পরায়ণ দেশপ্রেমিক ও মানবপ্রেমিক হওয়ার চেষ্টায়–সাধনায় আমরা ততোটাই পিছিয়ে। সন্তানকে উচ্চ শিক্ষিত করার অভিপ্রায়ে আমরা এমনভাবে টাকা–শ্রম বিনিয়োগ করছি, যাতে ভবিষ্যতে দশগুণ টাকা এই সন্তানরা তুলে আনতে পারে। এই মানসিকতা ধ্যান–ধারণা আমাদের বড় দুর্ভাগ্যই বলতে হবে।
সমাজে অন্যায় অবিচার দুর্নীতি আজ প্রবলভাবে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। বিদ্যমান সমাজ ব্যবস্থাই মানুষকে দুর্নীতিগ্রস্ত করে তুলছে। শিক্ষা ব্যবস্থায় নীতি নৈতিকতা আজ উপেক্ষিত। ফলে শিক্ষার্থীরা সুশিক্ষা থেকে বঞ্চিত থেকে যাচ্ছে। নীতি নৈতিকতাবিহীন শিক্ষা ব্যবস্থাই মানুষকে দুর্নীতির দিকে নিয়ে যাচ্ছে। অথচ তা আমরা ভেবেই দেখছিনা। প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, হারাম উপার্জন করলে কোনো ইবাদতই আল্লাহ পাকের দরবারে কবুল হবে না। অন্য হাদিসে রয়েছে, যার মাল সম্পদ অন্যায়ভাবে গ্রাস করা হয়েছে তা তাকে ফিরিয়ে না দেয়া পর্যন্ত শাস্তির কবল থেকে রেহাই পাওয়া যাবে না। এজন্য পরকালে তাকে কঠিন শাস্তির মুখোমুখি হতে হবে। তাহলে এই বেনজীর–ড. মতিউর রহমানরা অন্যায়ভাবে শতকোটি–হাজার কোটি টাকা উপার্জন করেছে, পদ–পদবির প্রভাব খাটিয়ে অন্যের মাল সম্পদ আত্মসাৎ করেছে পরকালে তাদের জন্য কী পরিণতি অপেক্ষা করছে ভেবে দেখুন। এই দুনিয়াতেও তো তাদের জন্য রয়েছে পদে পদে লাঞ্ছনা, যা আমরা এখন দেখতে পাচ্ছি। পরকালেও কঠিন শাস্তি এরা এড়াতে পারবে না। কারো অন্যায় দুর্নীতি প্রতিরোধে এগিয়ে না আসাও বড় অন্যায়–অপরাধ। অপরাধ প্রতিরোধে এগিয়ে না আসাও বড় অন্যায়। অপরাধ দেখে কিছুতেই নীরব–চুপ থাকা যাবে না। কেননা, হাদিস শরিফে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সকল ধরনের অন্যায় প্রতিরোধের নির্দেশ দিয়ে বলেছেন, ‘তোমাদের মধ্যে কেউ যদি কাউকে অন্যায় কাজ করতে দেখে তাহলে সে যেন তার শক্তি দ্বারা তা প্রতিহত করে। যদি সে এতে অক্ষম হয়, তবে মুখ দ্বারা নিষেধ করবে। যদি সে এতেও অপারগ হয় তবে সে অন্তর দিয়ে অন্যায় অনাচারকে ঘৃণা পোষণ করবে’ (মুসলিম শরিফ–১৮৬)।
শিক্ষার নানা স্তর, বিভাজন থাকবে বাস্তবতার কারণে তা উপেক্ষা করা হয়তো সম্ভব নয়। কিন্তু শিক্ষার সকল স্তরে, ছোট বড় সকল পর্যায়ের শিক্ষাঙ্গনে (কেবল মাদ্রাসায় নয়) নৈতিক ধর্মীয় শিক্ষা ব্যবস্থা চালু হোক– এই দাবির সঙ্গে দ্বিমত পোষণের সুযোগ নেই। ইসলামী নৈতিক শিক্ষাও এক্ষেত্রে বড় প্রয়োজন। শিক্ষার সঙ্গে অবশ্যই নৈতিকতার যোগসূত্র ঘটাতে হবে। এখানে বলা প্রয়োজন, মেডিকেলের একজন শিক্ষার্থী ডাক্তার হয়ে রোগীর সঙ্গে কীরূপ আচরণ করবেন সেই শিক্ষাও দিতে হবে। আর এটাই নৈতিক শিক্ষার আওতায় পড়ে। একজন মেডিকেল শিক্ষার্থী মানবিক ও নৈতিক মানে সমৃদ্ধ হলে রোগীর প্রতি সদ্ব্যবহার করবে এটাই স্বাভাবিক। রোগীকে ফাঁদে ফেলে দুই হাতে টাকা কামানো চরম অনৈতিক গর্হিত কাজ এই শিক্ষাও মেডিকেলের শিক্ষার্থীকে দিতে হবে। ডাক্তারি পড়াশোনার ক্ষেত্রে এই দিকগুলো তেমন জোরালোভাবে না থাকায় বর্তমানে অনেক ডাক্তারের বিরুদ্ধে রোগীর প্রতি রূঢ় আচরণ, উপেক্ষা ও অবহেলার হরহামেশা অভিযোগ শোনা যায়। তাই মেডিকেলে আচরণগত বিদ্যা বা নৈতিক শিক্ষার ব্যবস্থা থাকা বড় জরুরি বলে আমি মনে করি। একজন মানুষের মাঝে তাকওয়া বা আল্লাহভীতি থাকলে এবং সকল কাজের জন্য মহান আল্লাহর কাছে জবাবদিহিতার চেতনা জাগ্রত থাকলে তার পক্ষে নীতিহীন হওয়া অসম্ভব। প্রতিটি শিক্ষার্থীকে যেমন জ্ঞানে–গুণে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করতে হবে, তেমনি তারা নৈতিকতার ক্ষেত্রেও উচ্চ মানদণ্ডের অধিকারী হবে তাই আজ সময়ের দাবি ও প্রত্যাশা। সমাজ থেকে বিদ্যমান ঘুষ, দুর্নীতি, অনাচার রুখতে নৈতিক শিক্ষার প্রসার আজ জরুরি হয়ে উঠেছে। তাই সন্তানদেরকে শিক্ষা জীবন থেকেই সুশিক্ষা দিন। তাদের নীতি নৈতিকতাসম্পন্ন মানুষ হিসেবে গড়ার সুযোগ করে দিন। আপনার সন্তানকে সুশিক্ষা দিয়ে আদর্শ মানবিক মানুষরূপে গড়ে তুলুন। সন্তানের শুভাকাঙ্ক্ষী ও অভিভাবক হিসেবে আপনি এই দায়–দায়িত্ব কিছুতেই এড়াতে পারেন না।
লেখক: সাংবাদিক