দুদক কর্মকর্তার বদলি নিয়ে যত আলোচনা

আজাদী প্রতিবেদন | শনিবার , ১৯ জুন, ২০২১ at ৫:৩০ পূর্বাহ্ণ

দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) চট্টগ্রাম সমন্বিত জেলা কার্যালয়-২ এর উপসহকারী পরিচালক মো. শরীফ উদ্দিনকে বদলি করা হয়েছে। গত ১৬ জুন দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) প্রধান কার্যালয়ের পরিচালক মুহাম্মদ মনিরুল ইসলাম স্বাক্ষরিত চিঠিতে মো. শরীফ উদ্দিনকে পটুয়াখালী বদলির আদেশ হয়। আগামী ১ জুলাই বদলিকৃত কর্মস্থলে তাকে যোগদান করতে অফিস আদেশে বলা হয়। ওই বদলি নিয়ে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার জুড়ে সচেতন মহলে ব্যাপক সমালোচনা চলছে। তারা বলছেন, সৎ ও নির্লোভ এ কর্মকর্তার বদলিতে চট্টগ্রামে দুদকের জালে আটকা পড়া প্রভাবশালীদের মামলাগুলোর তদন্তে ছেদ পড়তে পারে।
এ বিষয়ে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) চট্টগ্রাম জেলার সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট আখতার কবীর চৌধুরী বলেছেন, ‘বাংলাদেশ অপরাধীদের অভয়ারণ্যে পরিণত হচ্ছে। সৎ কর্মকর্তাদের অন্যায্য বদলির মাধ্যমে তার ষোলকলা পূর্ণ করছে খোদ দুদকই। নাগরিকদের কাছে ভাবনা হচ্ছে, ন্যায়নিষ্ঠ, কর্মনিষ্ঠ ও যোগ্য মানুষ হিসেবে দুদকের ওই কর্মকর্তাকে (শরীফ উদ্দিন) স্বপদে বহাল রাখা। তা না হলে দুদকে ‘শর্ষের ভেতরে ভূত’ থাকার বিষয়টি প্রমাণিত হবে। একটি নখদন্তহীন বাঘ হিসেবে বিবেচিত হবে প্রতিষ্ঠানটি।’ তিনি বলেন, ‘দুদকের দায়িত্ব হচ্ছে, দুর্নীতিবাজদের ধরে আইনের আওতায় আনা। দুদক ৩০ লক্ষ শহীদের রক্ষের প্রতি দায়বদ্ধ।’
জানা যায়, গত আড়াই বছরে দায়িত্বপালনকালে কঙবাজারে সরকারি উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য প্রায় সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকার ভূমি অধিগ্রহণে শত শত কোটি টাকা লোপাটের তথ্য উদঘাটন, এসব ঘটনায় প্রায় ৫০ কোটি টাকা জব্দ, সিআইপিসহ বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা গ্রেপ্তার, চট্টগ্রামের স্বাস্থ্যখাতের দুর্নীতি, রেলের ৮৬৩ খালাসী নিয়োগে দুর্নীতির তথ্য উদঘাটন, এ ঘটনায় মন্ত্রীর স্ত্রী-শ্যালকের বিরুদ্ধে প্রতিবেদন দেওয়া, রেল কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে মামলা, কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানিতে (কেজিডিসিএল) নিয়োগ, পদোন্নতি, গ্যাস সংযোগ, জমি কেনায় দুর্নীতি, বিশেষ করে সাবেক মন্ত্রীর বাসায় অবৈধ গ্যাস সংযোগের তথ্য উদঘাটন, ওই ঘটনায় গত সপ্তাহে মন্ত্রীপুত্রসহ ৫ জনের বিরুদ্ধে মামলা, তিন কর্মকর্তাকে গ্রেপ্তার, রোহিঙ্গাদের এনআইডি জালিয়াতিতে নির্বাচন কমিশনের পরিচালকসহ বেশ কয়েকজনের বিরুদ্ধে মামলা, রোহিঙ্গাদের পাসপোর্ট জালিয়াতি নিয়ে পুলিশ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে মামলা করে আলোচনায় ছিলেন দুদক চট্টগ্রাম সমন্বিত জেলা কার্যালয়-২ এর উপ-সহকারী পরিচালক মো. শরীফ উদ্দিন। তন্মধ্যে কঙবাজারের জমি অধিগ্রহণ দুর্নীতির ঘটনায় ১৪জন, কর্ণফুলী গ্যাসের তিন জন, রোহিঙ্গা মামলায় ৪জন, রেলে দুর্নীতির ঘটনায় একজন, ব্যাংক ঋণ কেলেংকারির ঘটনায় দুইজনকে গ্রেপ্তারও করেন তিনি। আলোচিত মামলাগুলোর তদন্ত চলাকালীন এই সময়টাতে প্রভাবশালী দুর্নীতিবাজরা দুদকের এই কর্মকর্তার পিছু নিয়েছিলেন বলে জানা গেছে। সর্বশেষ কঙবাজারের জমি অধিগ্রহণ মামলার ঘটনায় তাকে হুমকি ধমকিও দেওয়া হয়। এই কর্মকর্তার বদলির কারণে আলোচিত কমপক্ষে ৫০টির মতো মামলার তদন্ত নিয়ে জটিলতা ও সুফল পাওয়া নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে।
নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা যা বলছেন: সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) চট্টগ্রাম জেলার সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট আখতার কবীর চৌধুরী দৈনিক আজাদীকে বলেন, ‘কঙবাজারে হাজার হাজার কোটি টাকার মেগাপ্রকল্পের ভূমি অধিগ্রহণে অনিয়ম উদঘাটন, রোহিঙ্গাদের পাসপোর্ট কিংবা এনআইডি পাওয়া কিংবা মন্ত্রীর ছেলের বাসায় অবৈধ গ্যাস সংযোগের বিষয়গুলো উদঘাটন করেছিলেন চট্টগ্রাম দুদকের কর্মকর্তা শরীফ উদ্দিন। তিনি একজন দক্ষ ও সৎ কর্মকর্তা হিসেবে ইতোমধ্যে সাধারণ মানুষের আস্থা ও বিশ্বাস অর্জন করেছিলেন। কিন্তু তাকে বদলি করার বিষয়টি সঠিক সিদ্ধান্ত হয়নি।’ তিনি বলেন, অপরাধী দুর্নীতিবাজরা তাকে বশীভূত করতে না পারা এবং ওই লোকগুলো ক্ষমতাঘনিষ্ট হওয়ায় সরকারের উচ্চ পর্যায়ে তাদের হাত থাকার কারণে হয়তো তারাই ওই কর্মকর্তাকে সরিয়ে দিয়েছেন। এই সিদ্ধান্তের কারণে দুদক প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে, দুদকের সুনামহানি হচ্ছে, পাশাপাশি সরকারের ভাবমূর্তি নষ্ট হচ্ছে। দিনশেষে প্রভাবশালীদের বিরুদ্ধে চলমান মামলার তদন্ত ও অভিযোগের অনুসন্ধানগুলোর সুফল পাওয়া কষ্টসাধ্য হবে। বিশেষ করে যেখানে ক্ষমতার অপব্যহার, আইনভঙ্গের বিষয় রয়েছে। ভয়াবহ দুর্নীতির সেই মামলাগুলো অনেকটা হিমাগারে চলে যাওয়ার অবস্থা হচ্ছে।’
বাংলাদেশ হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশন চট্টগ্রামের সভাপতি এ.এম. জিয়া হাবীব আহসান দৈনিক আজাদীকে বলেন, ‘শরীফ উদ্দিন একজন দক্ষ অফিসার। আইনের ভাষায় “হোয়াইট কালার ক্রিমিনাল” যারা তাদের ধরা খুবই কষ্টকর। এসব হোয়াইট কালার ক্রিমিনালদের আইনের আওতায় আনতে সক্ষম হয়েছেন দুদকের ওই কর্মকর্তা। এসব হোয়াইট কালার ক্রিমিনালরা আলোচিত ওই বদলির সাথে জড়িত থাকতে পারে। কারণ সমাজের এ প্রভাবশালীদের হাত অনেক লম্বা। এখন সরকারের উচিত হবে, যেসব চাঞ্চল্যকর মামলাগুলো উনি তদন্ত করছেন, অন্তত সেগুলোর অভিযোগপত্র আদালতে দাখিল করা পর্যন্ত তাকে স্বপদে বহাল রাখা। অন্যথায় এসব মামলার তদন্তের ফলাফল নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে।
দুদক চেয়ারম্যান যা বললেন : দুদক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মঈনউদ্দিন আবদুল্লাহ বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় দৈনিক আজাদীকে বলেন, বদলি একটি রুটিন ওয়ার্ক। কর্মক্ষেত্রে যাদের আড়াই থেকে তিন বছর অতিবাহিত হয়েছে, তাদের বদলি করা হয়েছে। ওই আদেশে ২১ জনকে বদলি করা হয়েছে। কাজের গতি আনতে বদলি একটি অপরিহার্য বিষয়।’ তিনি বলেন, ওই কর্মকর্তা (শরীফ উদ্দিন) ভালো কাজ করেছেন। কিন্তু প্রভাবশালীদের রক্ষা করতে ওই কর্মকর্তাকে বদলির বিষয়টি সঠিক নয় বলে দাবি করেন দুদক চেয়ারম্যান।

পূর্ববর্তী নিবন্ধচকবাজার ওয়ার্ডে উপ-নির্বাচন করতে ইসিকে চিঠি
পরবর্তী নিবন্ধপৌরকর : মেয়র সমীপে