দীর্ঘমেয়াদী পরিবেশ সুরক্ষা দিতে পরিবেশবিদদের লড়াই

রিতু পারভী | শনিবার , ১৪ মে, ২০২২ at ১০:৫১ পূর্বাহ্ণ

শ্রীলঙ্কার সামপ্রতিক বিপর্যয়ের কথা বিশ্বব্যাপী ব্যাপক আলোচিত। একটা দেশের অর্থনৈতিকভাবে দেউলিয়া ঘোষণা দেশটির অস্তিত্বকে ফেলে দিয়েছে চরম হুমকিতে। এর পেছনের কারণ খুঁজতে গিয়ে অনেকে এর জৈবিক চাষ পদ্ধতিকে দায়ী করছে। আসলে কী তাই! সাসটেইনেবল বা দীর্ঘমেয়াদী চাষ পদ্ধতি নিয়ে দীর্ঘদিন কাজ করে আসা পরিবেশকর্মী বন্দনা শিবা বলছেন অন্য কথা।

ভারতীয় পরিবেশবিদ, স্বনির্ভর খাদ্য উৎপাদনের প্রবক্তা, বিশ্বায়নবিরোধী লেখকবন্দনা শিবা বহুদিন ধরে দীর্ঘমেয়াদি কৃষি পদ্ধতি নিয়ে কাজ করে আসছেন। ১৯৮২ সালে তিনি রিসার্চ ফাউন্ডেশন ফর সায়েন্স, টেকনোলজি এণ্ড ন্যাচারাল রিসোর্স পলিসি প্রতিষ্ঠিত করেন। রাসায়নিক সার বন্ধ করে জৈবিক পদ্ধতিতে কৃষিব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য আজীবন লড়াই করে যাওয়া বন্দনা শিবা শ্রীলঙ্কা বিপর্যয়ের মূল কারণ হিসেবে অবকাঠামোগত উচ্চাভিলাষকে দায়ী করেছেন সাথে অব্যবস্থাপনা এবং দুর্নীতি।

অবকাঠামোর উন্নয়নের নামে ঝা চকচকে প্রকল্প দিয়ে শ্রীলঙ্কা আকন্ঠ ডুবে যায় ঋণে সাথে যুক্ত হয় করোনাকালীন অর্থনৈতিক মন্দা। আয়ের গুরুত্বপূর্ণ রাস্তাগুলো বন্ধ হওয়া এবং ক্রমাগত ঋণ দেশটিকে ঠেলে দেয় চরম অর্থনৈতিক মন্দার দিকে অথচ এর দায় দেয়া হয় জৈবিক চাষ পদ্ধতির উপর যা মোটেও সঠিক নয় বরং এর পেছনে রয়েছে কর্পোরেট আগ্রাসনের সুক্ষ্ম চাল।

বন্দনা চুলচেরা বিশ্লেষণ করে বুঝিয়ে দিয়েছেন শ্রীলঙ্কা কখনই সঠিক পথে দীর্ঘমেয়াদী জৈবিক চাষ পদ্ধতিতে ছিল না। বৈদেশিক ঋণে জর্জরিত শ্রীলঙ্কা ২০২১ সালে বহুদিন ধরে আলোচনার মাধ্যমে ঠিক করা ৩০০ মিলিয়ন ডলারের রাসায়নিক সার আর কীটনাশককে হুট করে ‘না’ বলে দেয়। জৈবিক অবকাঠামো তৈরি না করেই হুট করে জৈব ব্যবস্থায় ঢুকে যাওয়ায় কৃষিতে বিপর্যয়ে পড়ে শ্রীলঙ্কা যার দায় দেয়া হয় দীর্ঘমেয়াদী জৈবিক কৃষি পদ্ধতির উপর যা মোটেও সঠিক নয়। জৈব চাষ পদ্ধতির অবকাঠামো হুট করে তৈরি হয় না। এটা ধাপে ধাপে তৈরি হয়। নির্দিষ্ট এলাকার মাটি, আবহাওয়া, জীববৈচিত্র নির্ভর দীর্ঘমেয়াদী এক পরিকল্পনার মাধ্যমেই এর ফলাফল আশা করা যায়। চীন থেকে ব্যাকটেরিয়াযুক্ত জৈব সার শ্রীলঙ্কার মাটি এবং আবহাওয়ার সাথে খাপ খায় না। বন্দনা শিবা কিউবার উদাহরণ টেনে বলেন, কিউবা জৈব পদ্ধতিতে কৃষি ব্যবস্থার এক উজ্জ্বল উদাহরণ। কিউবা একদিনে তাদের এই ব্যবস্থা গড়ে তোলেনি। এর জন্য নিয়েছে ধাপে ধাপে পরিকল্পনা। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে পড়লে কিউবা রাসায়নিক সার এবং তেলের ঘাটতি পূরণ করতে সাসটেইনেবল বা দীর্ঘমেয়াদী জৈব চাষ পদ্ধতিতে চলে যায় ধীরে ধীরে এবং বর্তমানে বিশ্বে এই চাষ পদ্ধতির এক উজ্জ্বল উদাহরণ।

বন্দনা শিবা কর্পোরেট আগ্রাসনের দিকে দৃষ্টি নিতে সুফলা পাঞ্জাবের দিকে তাকাতে বলেন। কীভাবে এমন উর্বর এক ভূমিকে নিষ্ফলা করা হয়েছে। কীভাবে এর বুক চিরে চলে ক্যান্সার-রোগীবাহী ট্রেন। বিশ্বজুড়ে রাসায়নিক বিষ কীভাবে মানুষকে অসহায় করে তুলেছে তার দিকে মানুষের দৃষ্টি দিতে বলেন। বীজ, সার আর বিষের রাজনীতি করে একটা গোষ্ঠী কীভাবে বিশ্ব নিয়ন্ত্রণ করছে আর কীভাবে মানুষের দৃষ্টি নিয়ে যাচ্ছে জৈব চাষ পদ্ধতির বিপক্ষে সেদিকে বুদ্ধি নিয়ে তাকাতে বলেন।
জেনেটিক্যালি মোডিফায়েড ফুডের বিপক্ষে শক্তিশালী অবস্থানের জন্য বন্দনা শিবাকে ‘গান্ধী অফ গ্রেইন’ বা ‘শষ্যের গান্ধী’ বলা হয়ে থাকে। আপোষহীনভাবে তিনি প্রথাগত চাষ পদ্ধতির জন্য লড়াই করেছেন এবং প্রমাণ করেছেন, যে বিজ্ঞতার সাথে বহুকাল ধরে চলে আসা চাষ পদ্ধতি কাজ করে তার সাথে রাসায়নিক এবং বিষযুক্ত কৃষি পদ্ধতি কখনই তুলনীয় নয়। পরিমাণ গত নয় বরং পুষ্টি মান এবং গুণগত মান বেশি গুরুত্বপূর্ণ।

শ্রীলঙ্কার সামপ্রতিক পরিস্থিতি দীর্ঘমেয়াদি জৈবিক কৃষি পদ্ধতিকে আরেকবার মানুষের সামনে উন্মোচিত করেছে এবং কৃষিতে কর্পোরেট আগ্রাসনের আলোচনাকে সামনে নিয়ে এসেছে। বন্দনা শিবার মত পরিবেশকর্মীরা তাদের দৃঢ় অবস্থান দিয়ে লড়াই করেই চলেছেন পৃথিবীর জন্য একটি সাস্টেইনবল পরিবেশ দেয়ার। জয়তু বন্দনা শিবা।

পূর্ববর্তী নিবন্ধমানবতার সেবা ও টেকসই উন্নয়নে নিবেদিত থাকার অঙ্গীকার
পরবর্তী নিবন্ধভালোবাসার স্বাধীনতা