দীপুর লাল ঘুড়ি

দীনা মরিয়ম | বুধবার , ৩০ সেপ্টেম্বর, ২০২০ at ৪:৪১ পূর্বাহ্ণ

বাবুদের বাড়িটা একটা পাঁচতলা বিল্ডিংএর দোতলা। দক্ষিণের ঝুল বারান্দায় দাঁড়ালে মস্ত এক আমগাছ দেখা যায় আর গাছটা পেরুলেই দীপুদের টিনশেড ঘরের জ্বানালা।অসুস্থ হবার পর দীপু প্রায় সারাদিনই জ্বানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে থাকে। আগে স্কুল থেকে ফেরার পথে বাবু ্‌ওই জ্বানালায় দাঁড়িয়েই দীপুর সাথে গল্প করতো। শুধু বাবু কেন, রোকন,পলাশ, আদিত্য,শুভ সবাই। আস্তে আস্তে সবার আগ্রহে ভাটা পড়তে থাকলো। এখন আর কেউ তাকে দেখতে আসে না। সবাই যেন ভুলেই গেছে ওর কথা। নেহায়েত ঝুল বারান্দা থেকে জ্বানালা দেখা যায় বলেই দীপুর সাথে চোখের ইশারায় কিছুটা ভাব বিনিময় হয়। ওদের এই বলা না বলা কথার সাক্ষী হয়ে থাকে দুজন আমগাছ আর তার মগডালে ঝুলে থাকা সুতো কাটা একটা লাল রঙের ঘুড়ি। বাবুর ছোট মামা চায়না থেকে ফেরার সময় তার জন্য অনেকগুলো খেলনা নিয়ে এসেছিলো , খেলনার সাথে একটা ঘুড়িও ছিলো । আমাদের দেশি কাগজের ঘুড়ি নয়, চাইনিজ ম্যাটারিয়ালের ওপর নকশা আঁকা লাল একটা ঘুড়িওয়াটার প্রুফ। বাবু ঘুড়ি ওড়াতে জানে না তাই ওটা দীপুকে দিয়েছিলো । ঘুড়িটা দীপুর এতোই পছন্দ হয়েছিলো যে প্রথম প্রথম দিন রাত ওই ঘুড়ি নিয়েই কাটিয়েছিলো সে। দীপুর এই অনিরাময়যোগ্য অসুস্থতার পেছনেও রয়েছে এই লাল ঘুড়িটাই। ঘুড়ি ওড়ানোয় দীপু বরাবরই প্রথম আর সেদিন চলছিলো ঘুড়ি ওড়ানের প্রতিযোগিতা, মাঝে দীপুর লাল ঘুড়ি গেলো আমগাছের মগডালে আটকে। দীপু ঘুড়িটা পেড়ে আনবে বলেই গাছে উঠেছিলো, হঠাৎ পা ফসকে নীচে পড়ে গেলো। বাইরে থেকে দেখে মনে হচ্ছিলো কিছুই হয়নি গাছ থেকে পড়ে। কিন্তু ডাক্তার বললেন ইন্টার্নাল ইনজুরি। বেশ কয়েকদিন হাসপাতালে কাটিয়ে বাড়ি ফিরে এলো কিন্তু পুরোপুরি সু্‌স্থ হলো না আর কোনদিন হয়তো হবেও না। অমন ছটফটে ছেলেটা বিছানায় পড়ে রইলো জিন্দা লাশ হয়ে।

জানা গেলো মাথায় আঘাত লাগার কারণে শরীরের নার্ভে কিছু সমস্যা হয়েছে তাই একসাথে বেশ কয়েকটা অঙ্গ অবশ হয়ে গেছে। দীপু নড়াচড়া করতে পারে না। কথাও বলতে পারে না বললেই চলে। কথা বলতে চাইলে মুখ দিয়ে গোঙানির মতো হয়্‌। অনেকক্ষণ চেষ্টা করলে কিছুটা বোঝা যায়। দিন রাত বিছানায় শুয়ে থাকা ছাড়া আর কিছুই করার নেই ওর এখন। দীপু হাসপাতাল থেকে ফিরেছে দিন সাতেক হলো। বাবু প্রতি বিকেলের মতো দেখতে এসেছে,‘কি রে দীপু কথা বলছিস না যে! কি ভাবছিস এতো?’ বাবুর প্রশ্নের উত্তরে দীপু ভাঙ্গা ভাঙ্গা শব্দে বললো,‘ঘুড়ি।’ যেখানে সে শোয় তার একপাশে বড় একটা জ্বানালা আছে, সেই জ্বানালা দিয়ে বাইরের অনেককিছু চোখে পড়ে। বাবুদের বারান্দা, মানিকদের টিনের চালের কুমড়ো গাছ, বজলু মিয়ার মুদি দোকান, রাস্তা,গলির মোড়ে বসে থাকা কামাল চাচা আর আমগাছের মগডালে ঝুলে থাকা সেই লক্ষ্মীছাড়া লাল ঘুড়ি! এতোকিছু থাকতেও দীপুর চোখ আটকে আছে ঘুড়িটার গায়ে।

মাঝে বেশ ক’টা দিন পরীক্ষার জন্য ব্যাস্ততা গেলো। এর মাঝে আবার নানাবাড়িও যেতে হলো। সেখান থেকে ফিরে শুনলো দীপুর শরীর খুব খারাপ। হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। ফিরতে ফিরতে রাত হলো বলে দীপুকে আর দেখতে যাওয়া হলো না। পরদিন সকালবেলা ঘুড়িটা না দেখতে পেয়ে বুকটা হঠাৎ ধ্বক্‌্‌ করে উঠলো বাবুর। দীপুর খারাপ কিছু হয়ে গেলো নাতো!

মাঝে একদিন বাবু দীপুকে জিজ্ঞেস করেলো,‘ ছেঁড়া ঘুড়িটা আর কত দেখবি।’

সে উত্তর দিলো,‘ যতদিন দেখা যায়।’

কেন?’

একটা ঘুড়ি আমার জীবনটা পাল্টে দিয়েছে।দেখছিন না আমার প্রাণটা কেমন ঐ ঘুড়ির মতো ঝুলে আছে।ঐ ঘুড়িটা যেন আমার প্রাণ ভোমরা !’

যাহ্‌্‌ কি যে বলিস! প্রাণ ভোমরা বলে কিছু হয় নাকি?’

দেখিস , যেদিন ঐ ঘুড়িটা থাকবে না , সেদিন আমিও থাকবো না।’

ধ্যাত বাজে বকিস নাতো । কালই আমি বাবাকে বলে ছেঁড়া ঘুড়িটা গাছ থেকে নামিয়ে নেবো।’

বললেও ঘুড়িটা আর নামানো হয়নি। দীপু শুয়ে থাকে আর মাঝে মাঝে আমগাছে ঝুলে থাকা লাল ঘুড়িটা দেখে।

আর ঘুড়িটাও বেহায়া , দিনের পর দিন সে ঝুলেই রয়েছে গাছের ডালে! কত ঝড় ঝঞ্ঝা গেলো,পুরো বর্ষা কেটে গেলো তবু সে ঝুলেই রইলো। পাতলা কাগজ হলে ছিড়ে যেতো কিন্তু এটা যে চীন দেশের ওয়াটারপ্রুফ সিনথেটিক ঘুড়ি। ঝুলে ছিলো তো ছিলোই। সেটা আবার খসে পড়তে গেলো কেনো! মনের মাঝে খচখচানি নিয়ে অস্থির সময় কাটায় বাবু। এই সকালবেলা বাবা ওকে হাসপাতালে নিয়ে যাবেন না আর ওদিকে কি হচ্ছে ভেবে বাবু শান্তিও পাচ্ছে না। দীপু বাড়ি ফিরলো বেলা দশটার দিকে। এ্যাম্বুলেন্স থেকে নামানো হলো সাদা কাপড়ে ঢাকা ওর নিথর শরীর। বারান্দা থেকেই সে দৃশ্যটা দেখতে পেলো বাবু। বুকের ভেতরে খুব কষ্ট হচ্ছে ওর । ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে সে। বাবা বারান্দায় এসে ওর কাঁধে হাত রাখলেন,‘মন শক্ত করো বাবু। সবাইকে একদিন চলে যেতে হয়। আসলে দীপুর মৃত্য সংবাদটা আমরা ভোরেই পেয়েছিলাম। তোমাকে কিভাবে বলবো বুঝতে পারছিলাম না। স্যরি বাবা।’ দীপু দুহাতে চোখ মোছে। বাবা বলেন, ‘তুমি কি এখন দীপুকে দেখতে যাবে?’ ‘না, আমি আর ওকে দেখতে যাবো না। দেখে আর কি হবে…’ বলতে বলতে হাউ মাউ করে কেঁদে ওঠে বাবু। বাবা ওকে বুকে জড়িয়ে ধরেন,‘কাঁদো বাবা, আরও জোরে কাঁদো তাতে মনটা ভারমুক্ত হবে।’ বাবু আরও জোরে কেঁদে ওঠে। কান্নার সাথেই বলতে থাকে , ‘আমি ওকে কেন ঘুড়িটা দিয়েছিলাম, কেন দিয়েছিলাম…’ বাবা ঘুড়ির কথা কিছু বুঝলেন না। তিনি বলতে থাকলেন,‘কেঁদে হালকা হও বাবা, জন্ম মৃত্যু নিয়েই আমাদের জীবন বাবা। সবকিছু স্বাভাবিকভাবে নিতে হয়। চলো আমার সাথে দীপুকে শেষবারের মতো দেখবে। আমার সাথে জানাজায় যেও। এখন আমরা বরং গিয়ে দেখি ওদের কোন কিছুর দরকার হয় কিনা।’ বাবু বার বার চোখ মোছার চেষ্টা করছে কিন্তু কিছুতেই চোখের জল বাধ মানছে না। কেবলই দীপুর জন্য কষ্ট হচ্ছে!

পূর্ববর্তী নিবন্ধআলোর মশাল হয়ে
পরবর্তী নিবন্ধডিনামাইট আবিষ্কারের গল্প