দাবিদারহীন ও পরিত্যক্ত শিশুর ঠিকানা

মোহাম্মদ শাহী নেওয়াজ | শনিবার , ২০ আগস্ট, ২০২২ at ৭:৫১ পূর্বাহ্ণ

শিশুরা নিষ্পাপ ও নিষ্ককলঙ্ক। একটি সুন্দর আগামীর বার্তা নিয়ে এ-জগতে প্রত্যেক মানব শিশুর জন্ম। জাতি, ধর্ম, বর্ণ, গোষ্ঠী, শ্রেণি যেখানেই শিশুর জন্ম হোক না কেন মানব সত্তা হিসেবে তার আছে বেঁচে থাকার অধিকার। নবজাতক কেনো অবস্থাতেই অবহেলা, অনাদর ও পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে থাকার কথা নয়। একটি নবজাতক মাতা-পিতার অতি আদরের ধন। ভালবাসার প্রতীক। পারিবারিক স্নেহ-মমতায় বেড়ে উঠবে একটি শিশু। মাতৃকোল-ই নবজাতক শিশুর শারীরিক, মানসিক ও সামাজিক বিকাশের অনন্য ক্ষেত্র। কিন্তু আমরা কী দেখছি! নবজাতক শিশুকে লোকচক্ষুর অন্তরালে রাস্তাঘাটে, নর্দমায় কিংবা ডাস্টবিনে ফেলে চলে যাচ্ছে প্রিয় মা-বাবা। সংবাদ মাধ্যমের আলোচিত খবর, হাসপাতালে প্রসবের পর প্রসবকারী মাতার নিরুদ্দেশ। আরো শোনা যায় হারিয়ে যাওয়া, কুড়িয়ে পাওয়া ও পাচারের শিকার শিশুর কথা। এসব দাবীদারহীন, ঠিকানাহীন ও কুড়িয়ে পাওয়া শিশুরাই সমাজে পরিত্যক্ত (Abandoned) শিশু হিসেবে গণ্য।
পরিত্যক্ত শিশু কারা, কী তাদের ভবিষ্যৎ? পিতা-মাতা নিজ ঔরশজাত সন্তানকে সামাজিক পরিচয় প্রদানে অনাগ্রহী কেন ? পরিত্যক্ত নবজাতকেরা হতে পারে, অপরিণত কিংবা সমাজ অস্বীকৃত যৌন সম্পর্কের বহিঃপ্রকাশ। নয়তো বা ভোগপ্রিয়, কু-চারিত্রিক ও অসংলগ্ন ব্যক্তির যৌনচারের ফসল। শূন্য বয়সেই একটি নবজাতক পরিচয়হীন ও অধিকারহীন! যা আমাদের সামাজিক অবক্ষয়ের নগ্ন-রূপ। পরিত্যক্ত শিশুরা নির্মম ভাগ্যের শিকার। পরিচয় প্রদান বা দায়িত্ব পালনে তাদের পিতা-মাতার অস্বীকৃতি। এসব অভিভাবকগণ স্বেচ্ছায় ও স্বজ্ঞানে নিখোঁজ। তাদের মুখোশ বা পরিচয় উদঘাটন বড়ই দুরূহ। সমাজের এসব বর্ণচোরা ব্যক্তিরা আপন সন্তানের দায়িত্ব এড়িয়ে পালিয়ে বেড়ায়। পরিচয়হীন বা ঠিকানাহীন নবজাতক শিশুরা থানার জিডি, সংবাদকর্মীর তথ্য বা হৃদয়বান ব্যক্তির হস্তক্ষেপের বদৌলতে সরকারি হেফাজতে লালিত হয়। সমাজসেবা অধিদফতর পরিচালিত ‘ছোটমনি নিবাস’ তাদের ঠিকানা।
প্রাচীনকাল হতে ইউরোপে কুড়িয়ে বা পরিত্যক্ত শিশুদের পরিচর্যার জন্য আশ্রয় কেন্দ্র (Founding asylum) প্রতিষ্ঠা করার কথা জানা যায়। এমন একটা সময় ছিল ইউরোপের কোনো কোনো জায়গায় অপ্রত্যাশিত শিশু ও প্রতিবন্ধী শিশুদের হয় মেরে ফেলা হ’তো বা পরিত্যক্ত অবস্থায় ফেলে দেওয়া হ’তো। যাতে ঐ শিশু শেষ পর্যন্ত মারা যায়। ৭৮৭ সালের দিকে ইতালির মিলানে ফেলে দেওয়া শিশুদের দেখভাল করার জন্য চার্চের উদ্যোগে আশ্রয় কেন্দ্র চালু করার কথা জানা যায়। ইতালিতে পরিত্যক্ত শিশুদের আশ্রয় প্রদানের জন্য প্রথম প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগ গ্রহণ করা হয় ১৯৪৫ সালের দিকে। শান্তা মারিয় ডেগল ইনোসেন্টি নামের আশ্রয় কেন্দ্র চালু করার মাধ্যমে। ১৪৮৪ সালের মধ্যে এ-প্রতিষ্ঠান ১ হাজার পরিত্যক্ত শিশুর আশ্রয় কেন্দ্রে পরিণত হয়। ইউনিসেফ কর্তৃক ২০১৭ সালে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, সমগ্র বিশ্বের ১৪০ টি দেশের ২.৭ মিলিয়ন পরিত্যক্ত শিশু বিভিন্ন পরিচর্যা কেন্দ্রে বসবাস করছে। পূর্ব ইউরোপে এ সংখ্যা অনেক বেশী। সেখানে প্রতি ১০০০ শিশুর মধ্যে ৬৬৬ জন শিশু বিভিন্ন পরিচর্যা কেন্দ্রে বসবাস করছে।
বাংলার কিশোর কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য্য। ১৯৪৮ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ ‘ছাড়পত্র’। এ কাব্যগ্রন্থের ‘ছাড়পত্র’ কবিতার মাধ্যমে কবি পৃথিবীকে নবজাতকের বাসযোগ্য করে গড়ে তোলার আহ্বান জানান। যা শিশু সুরক্ষায় উদ্দীপ্ত করেছে আমাদের সমাজকে। এ আহ্বান শিশুর অধিকার প্রতিষ্ঠায় বাঙালির অনুপ্রেরণার উৎস। বিশ্বসমাজ শিশু অধিকার প্রতিষ্ঠায় অঙ্গীকার করেছেন ‘জাতিসংঘ শিশু অধিকার সনদ’ এর মাধ্যমে। ১৯৮৯ সালের ২০ নভেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের সভায় সর্বসম্মতিক্রমে এ সনদ গৃহীত ও অনুমোদিত হয়। বাংলাদেশ এ-সনদে স্বাক্ষরকারী ও অনুসমর্থনকারী অন্যতম রাষ্ট্র। এ ধারবাহিকতায় দেশের সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের অধিকার সুরক্ষায় প্রণীত হয়েছে ‘শিশু আইন-২০১৩’। এ-আইনের ৮৪ নং ধারায় দেশের সুবিধাবঞ্চিত শিশু এবং আইনের সংস্পর্শে আসা শিশু যাদের বিশেষ সুরক্ষা, যত্ন-পরিচর্যা ও উন্নয়ন নিশ্চিতের প্রয়োজনীয়তার কথা বলা হয়েছে। এ ধারায় উক্ত শিশুদের পারিবারিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, আর্থিক, নৃতাত্ত্বিক, মনস্তাত্বিক ও শিক্ষাগত পটভূমি বিবেচনাপূর্বক শিশুর সর্বোত্তম স্বার্থ বিবেচনায় বিকল্প পরিচর্যার (Alternative Care) উদ্যোগ গ্রহণের কথা বলা হয়েছে। বিকল্প পরিচর্যার উপায় ও ধরণ নির্ধারণের পূর্বে পিতা-মাতার সহিত পুনঃএকীকরণের (Re- integration) কে অগ্রাধিকার প্রদান করতে হবে। যদি সম্ভব না হয় তবে বর্ধিত পরিবারের সাথে পুনঃএকীকরণের উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। অন্যথায়, সমাজভিত্তিক একীকরণের (Community Based Integration)উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। সর্বশেষ পন্থা হিসেবে সরকারি-বেসরকাররি ব্যবস্থাপনায় প্রত্যায়িত প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে পরিচর্যার উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।
আমরা প্রায় শুনি ‘ছোটমণি নিবাস’ এর কথা। সংবাদ মাধ্যমে প্রায় প্রচার হয় ‘ডাস্টবিনে কুড়িয়ে পাওয়া বা হাসপাতালের পরিত্যক্ত নবজাতকের ঠাঁই হলো ছোটমণি নিবাসে’। সম্প্রতি ময়মনসিংহের ত্রিশাল উপজেলায় ঢাকা-ময়মনসিংহ সড়কে জাহাঙ্গীর আলম, তার অন্তঃসত্তা স্ত্রী রত্না বেগম ও চার বছরের কন্যা সানজিদা সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যায়। ট্রাক চাপায় মায়ের মৃত্যুর আগ-মুহূর্তে সড়কে জন্ম নেয় একটি শিশু। মর্মান্তিক এ-সংবাদ ছড়িয়ে পড়ে সমগ্র দেশে। মিরাকেল বেবি হিসেবে জন্ম নেওয়া শিশুটিরও ঠাঁই হয়েছে ঢাকার ছোটমণি নিবাসে। এ প্রতিষ্ঠান সমাজসেবা অধিদফতর পরিচালিত একটি অন্যতম শিশু সুরক্ষা কেন্দ্র। যেসব শিশুদের মাতা-পিতা, বর্ধিত-পরিবারকেন্দ্রিক পরিচর্যা বা অপ্রাতিষ্ঠানিক পরিচর্যা নিশ্চিত করা যাবে না এ-নিবাস তাদের ঠিকানা। ‘ছোটমণি নিবাস’ সমাজের জন্মের পর থেকে ৭ বছর বয়সী এতিম, পরিত্যক্ত, অবহেলিত ও অবাঞ্চিত নবজাতকের আশ্রয়স্থল। এখানে শিশুদের মাতৃস্নেহে প্রতিপালন, রক্ষণাবেক্ষণ, খেলাধুলা ও সাধারণ শিক্ষা প্রদান করা হয়। ঢাকার আজিমপুরে ১৯৬২ সালে প্রথম ছোটমণি নিবাস স্থাপিত হয়। বর্তমানে সমগ্র দেশে ৬টি ছোটমণি নিবাস আছে এবং মোট আসন সংখ্যা ৬ শত। এখানে ঠাঁই পাওয়া নিবাসীদের শিশু আদালত ও শিশু কল্যাণ বোর্ড (শিশু আইন-২০১৩ এর আওতায়) এর মাধ্যমে পুনর্বাসনের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। সমাজসেবা অধিদফতরের মহাপরিচালক ছোটমণি নিবাসে বসবাসকারীদের অভিভাবক ও সংরক্ষকের দায়িত্ব পালন করে।
শিশুরা জাতির ভবিষ্যত। দাবিদারহীন ও পরিত্যক্ত শিশুরা এদেশেরই নাগরিক। তারা সামাজিক অবক্ষয় কিংবা ভাগ্যের নির্মমতার শিকার। সমাজ বা রাষ্ট্রই হবে অভিভাবকহীন শিশুদের অভিভাবক। সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জাতি হিসেবে মানব মর্যাদা নিয়ে বেঁচে থাকার অধিকার তাদেরও আছে। মানবিক দায়িত্ববোধ থেকে পরিত্যক্ত শিশুদের কল্যাণে এগিয়ে আসতে হবে সকলকে। অবাঞ্চিত ও পরিত্যক্ত শিশুর সুরক্ষায় কোনো অবজ্ঞা নয়। কোনো বৈষম্য নয়। ঠিকানাহীন, অবহেলিত ও বিপন্ন শিশুর সুরক্ষাই হোক, আমাদের অঙ্গীকার।

পূর্ববর্তী নিবন্ধবৃষ্টিতে থাইল্যান্ডের সর্বোচ্চ স্থানে
পরবর্তী নিবন্ধমামলার হুমকিকে ‘ষড়যন্ত্র’ হিসেবে দেখছেন অনন্ত জলিল