বৃষ্টিতে থাইল্যান্ডের সর্বোচ্চ স্থানে

শরণার্থী, নারীবাদ এবং একজন নারী ভ্রমণকারীর গল্প

রূপা দত্ত | শনিবার , ২০ আগস্ট, ২০২২ at ৭:৪৮ পূর্বাহ্ণ

ঝুম বৃষ্টিতে কাঁধে ব্যাকপ্যাক নিয়ে পাহাড়ি পিচঢালা রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছি অনেকক্ষণ ধরে। খুব কম গাড়ি আসা যাওয়া করছে। বেশিরভাগ পর্যটকের গাড়ি। আমি দাঁড়িয়ে আছি একটা লিফট পাওয়ার আসায়। এখানে গাড়ি ছাড়া একমাত্র উপায় হাঁটা। এসেছি থাইল্যান্ডের সর্বোচ্চ স্থান ‘দই ইন্থানন’ দেখতে। ‘দই’ মানে থাই ভাষায় পর্বত, ‘দই ইন্থানন’ হল থাইল্যান্ডের সবচেয়ে উঁচু পর্বত যেটি ২৫৬৫ মিটার উঁচু। চ্যাংমাই শহর থেকে একজন পাহাড়ের পাদদেশ পর্যন্ত লিফট দিয়েছে। যেখানে আমাকে নামিয়ে দিয়েছে, সেখান থেকে হয়তো আর ১৮০০২০০০ মিটার উঠতে হতে পারে একদম চূড়ায় পৌঁছাতে। এতটা উঁচু পাহাড় হেঁটে উঠার মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে আসিনি। গাড়ি করেই পিচঢালা পথ ধরেই চূড়ায় পৌঁছে যাওয়া যায়। পরিকল্পনা ছিল হিচহাইক করেই চলে যেতে পারবো। বৃষ্টির জন্য হয়ত পর্যটকের সংখ্যা কম। তাই লিফট পাওয়া যাচ্ছে না। অনেকক্ষণ পর লিফটের জন্য অপেক্ষা না করে হাঁটা দিলাম। হেঁটে পুরো পথ উঠতে না পারলেও, কিছুটা তো ঘুরে দেখা হবে! এই ভেবেই উঠা শুরু করলাম। কিছুদূর যাওয়ার পর দেখি বাম দিকে সরু মাটির রাস্তা নেমে গেছে, পথের সামনে একটা সাইন বোর্ড বলে দিল এখানে কৃষি গবেষণা হয়। উপরের রাস্তা থেকে খুব একটা বোঝা যাচ্ছে না নিচে ঠিক কি আছে। ডান দিকের পাহাড়ের ঢালে সাদা রঙের গ্রিনহাউজ দেখা যাচ্ছে। বামদিকে নেমে কি আছে দেখার আগ্রহ হল। নিচে সমতল জায়গায় বাগানের মতো করা হয়েছে। দেখে খুব ভালো লাগলো, সাথে ক্যান্টিনের মত। কিন্তু, পর্যটক কম থাকাতে বন্ধ। কিছুক্ষণ ঘুরে ঘুরে বাগান দেখে আবার পিচের রাস্তায় উঠে এলাম। এবার আর বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হল না। একজন স্থানীয় কৃষক তার বাগানে কাজ করতে যাচ্ছে, আমাকে তার পিকআপে লিফট দিতে রাজি হলো। যদিও সে একদম চূড়ায় যাবে না, কিন্তু কাছাকাছি যাবে। আমার জন্য ওই বৃষ্টিতে সেও অনেক কিছু। আমাকে যে লিফট দিয়েছে, পাহাড়ের উপর তার পারিবারিক জায়গা আছে যেখানে তার ফলের বাগান আছে। তার ছেলে-মেয়ে স্কুলে পড়ে। ঝর্ণার কাছে ক্যাম্পিংয়ের পরিকল্পনার কথা শুনে খুব নিষেধ করল। ঝর্ণার কাছে যে কোনো সময় পাহাড়ি ঢল নামার সম্ভাবনা আছে। বেশ কিছুদিন ধরে ঝর্ণার পানি বেড়ে গেছে। এছাড়া একা ওখানে ক্যাম্প করা নাকি নিরাপদও হবে না।
পাহাড় আমাকে খুব টানে। নতুন কোথাও গেলে সেখানকার পাহাড়ে যাওয়া পরিকল্পনার মধ্যেই থাকে। নিনা আর এলিনা’র ঠিক করেছে চ্যাংরাই এর সাদা মন্দির দেখতে যাবে। আমি যেহেতু বেশ অনেকবার ওখানে গিয়েছি, তাই ওদের সাথে না গিয়ে আমি একা ঘুরতে এসেছি ‘দই ইন্থানন’এ। এর আগের দিন ওদের সাথে হিচহাইক করেছি, মোটামুটি বুঝে নিয়েছি কি করে মানুষের কাছে লিফট চাইতে হবে। তাই সাহস করে একাই হিচহাইক করে ঘুরে বেড়াবার পরিকল্পনা করে বেড়িয়ে গেছি। ইন্থানন পর্বতের এলাকাকে জাতীয় উদ্যান ঘোষণা করা হয়েছে। এর ভেতরে বেশ কিছু ঝর্ণা আছে যেখানে রাতে ক্যাম্প করে থাকা যায়। আমি রাতে থাকার পরিকল্পনা করে সাথে তাবু, স্লিপিং ব্যাগ, খাবার এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিস নিয়ে এসেছি।
আমাকে গ্র্যান্ড প্যাগোডার সামনে নামিয়ে দিল। প্যাগোডার সামনে খুব সাজানো গোছানো বাগান। এর মাঝে বৃষ্টি কিছুটা ধরে এলো। প্যাগোডার ওখানে একটি দেয়ালে টেরাকোটার মতো কাজ করা। এলাকাটা ঘুরে দেখতে দেখতেই পরিচয় হলো এক দক্ষিণ কোরিয়ার মধ্যবয়সী পর্যটক কিম এর সাথে। কিম অনেক দেশ ঘুরেছে। তবে, এডভ্যাঞ্চারের চেয়ে আরাম করে ঘুরে বেড়াতেই সে পছন্দ করে। কথায় কথায় বাংলাদেশ নিয়ে আলাপ করল। কিম জানাল, ওদের দেশ বাংলাদেশের গার্মেন্টস সেক্টরে কাজ করছে, বিনিয়োগ করছে এই বিষয়টা সে জানে। কিম ইন্ডিয়া গিয়েছিল, কিন্তু বাংলাদেশ যায়নি। এখানে কিম এসেছে আর কয়েকজন পর্যটকের সাথে একটা ট্যাম্পুর মত গাড়ি ভাড়া করে। আমি লিফট নিয়ে নিয়ে ঘুরছি জানার পর কিম নিজ থেকেই ওদের গাড়িতে করে ঘোরার প্রস্তাব দিল, আর আমিও লুফে নিলাম। আমার ইচ্ছে ছিল পাশের ‘কিউ মায়ে প্যান’ ট্রেইলে ট্রেক করার। ট্রেইলের কাছে গিয়ে দেখা গেল ট্রেইল বন্ধ। প্রবল বৃষ্টির জন্য ট্রেইলের কোনো কোনো জায়গায় নাকি পাহাড় ধস হয়েছে, তাই আপাতত ট্রেক করা বন্ধ। মন খারাপ নিয়ে চললাম পর্বতের চূড়ার দিকে। কিমদের গাড়িতে দুইজন চাইনিজ পর্যটক আর দুই জন থাই পর্যটক আছে। ভ্রমণে চাইনিজ, থাই, এবং কোরিয়ান এদের সবার একটা জায়গায় খুব মিল। ওদের প্রথম টার্গেট জনপ্রিয় জায়গায় যাওয়া, তারপর সেখানে গিয়ে ছবি তোলা। বিশেষত বেশির ভাগ চাইনিজ পর্যটকদের দেখেছি ছবি তোলা হয়ে গেলে ওরা আর ওই জায়গায় থাকতে চায় না। গ্রুপে ঘুরতে গেলে এই এক মুশকিল! যাই হোক, সর্বোচ্চ চূড়ায় পৌঁছার পর আমার চক্ষু চড়কগাছ! এত গাড়ি যে মনেই হচ্ছে না প্রাকৃতিক দুর্যোগ চলছে। শুরুতেই একটা ছোট্ট মন্দিরের মতো। এখানে নাকি এই পর্বতের দেবতাদের পূজা দেয়া হয়। এরা বড় বড় গাছগুলোকে কেটে ফেলেনি। গাছের মাঝে কাঠ দিয়ে রাস্তা করে দিয়েছি। শতবর্ষী গাছগুলোর মাঝ দিয়ে হেঁটে যেতে কেবল অন্যরকম লাগছিল। কোনো কোনো গাছের গায়ে ফার্ন জমে গেছে। কাঠের পথের শেষে গেলাম দই ইন্থানন জাদুঘরে। পুরো সময়ে কিম তার ক্যামেরা দিয়ে আমার অনেক ছবি তুলে দিল। যতই বলি আমার ছবি লাগবে না, সে কিছুতেই শুনবে না। এখন এত বছর পর কিম এর প্রতি কৃতজ্ঞ বোধ করি। সেদিন সে জোর না করলে আমার নিজের খুব একটা ছবি হয়ত তোলা হত না, আর স্মৃতিও ধরে রাখা হতো না।
কিমকে বিদায় দিলাম, আমার এখনও ইচ্ছে আছে রাতে থাকার। কিমও নিষেধ করে গেল এই আবহাওয়ায় না থাকার জন্য। এবার নিচের দিকে নামা, তাই গাড়ি না থাকলেও অসুবিধা নেই। নামতে নামতে একটা জায়গায় দেখলাম স্থানীয় ছেলেমেয়েদের জটলা। ওরা একটা গ্রুপ ঘুরতে এসেছে। যেখানে ওদের সাথে দেখা হয়েছে সেখান থেকে নাকি চ্যাংমাই এর দারুন ভিউ। এবার ওদের দলে ভীড়ে গিয়ে, আশেপাশের এলাকা ঘুরে দেখলাম। এদিকে শুরু হলো ঝোড়ো হাওয়া। ওরা জানাল, গেল বছর কয়েকজন পশ্চিমা পর্যটক ঝর্ণাতে ক্যাম্পিং করতে গিয়ে বৃষ্টিতে আটকা পড়েছিল। পরে বেশ অসুবিধা করে ওদের উদ্ধার করতে হয়েছিল।বেলাও প্রায় পড়ে এসেছে, বৃষ্টি বন্ধ হবার কোনো লক্ষণ নেই। একা ভ্রমণে নিরাপত্তার বিষয়কে গুরুত্বের সাথে নিতে হয়। অহেতুক ঝুঁকি নিয়ে, পরবর্তী ভ্রমণের আনন্দ নষ্ট করার মানে নেই। সব ভেবেচিন্তে ফিরে যাবার সিদ্ধান্ত নিলাম। এবার আর লিফট পেতে অসুবিধা হল না। এক থাই দম্পতি তাদের গাড়িতে লিফট দিয়ে এক্কেবারে আমার হোস্টের বাড়ির এলাকায় নামিয়ে দিল।
এখানে আবার বৃষ্টি থেমে গেছে। পাড়ার ভেতর দিয়ে হেঁটে বাড়ি ফিরছি। সন্ধ্যে হয়ে এসেছে। একটা স্কুটি এসে হঠাৎ পাশে দাঁড়াল। স্কুটির চালক একজন নারী। তিনি কোনো কিছু জিজ্ঞেস না করেই আমাকে উঠে বসতে বললেন। আমি বেশ অবাক হলাম, কেননা আমি ওর কাছে লিফট চাইনি। যেতে যেতে জানতে পারলাম, ওর বাড়ির কাছেই আমাদের হোস্টের বাড়ি। প্রতিদিন আমাদের আসা যাওয়া করতে দেখে। ওর নিজেরও নাকি আমাদের মতো ঘুরতে ইচ্ছে করে। কিন্তু, ঘর-সংসার সামলে আর হয়ে উঠে না। আবার একা ঘোরার সাহসও করে উঠতে পারে না। আমাকে খুব জোর করল, ওর বাড়ি যেতে। আমার ক্লান্ত শরীর তখন একটু বিশ্রাম চাইছে। বিনয়ের সঙ্গে আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করতে হল।
একা অনেক ঘুরেছি, কিন্তু অন্যের গাড়িতে লিফট নিয়ে ঝড়বৃষ্টির মধ্যে এই প্রথম ঘুরলাম। নিজের ভেতরে দারুণ উত্তেজনা। নিজেই নিজেকে বাহবা দিলাম।
নোট: ২০১৭ সালের ভ্রমণ গল্প

পূর্ববর্তী নিবন্ধআওয়ামী লীগ জনগণের শক্তিতে বলীয়ান, ভারত অকৃত্রিম বন্ধু
পরবর্তী নিবন্ধদাবিদারহীন ও পরিত্যক্ত শিশুর ঠিকানা