তুমিই তোমার কর্তা

মাহমুদা খানম | শনিবার , ৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ at ৫:৩৯ পূর্বাহ্ণ

সামপ্রতিক আদমশুমারী (জুন ২০২২) অনুযায়ী আমাদের দেশের জনসংখ্যার অর্ধেকের চাইতে সামান্য বেশি শতাংশই নারী এবং এই নারীদের মধ্যে সাাক্ষরতার হার প্রায় ৭৩ শতাংশ, এক্ষেত্রে পুরুষরা মাত্র তিন শতাশং এগিয়ে অর্থাৎ ৭৬ শতাংশ।

উপরের তথ্যটি এই জন্য এখানে উপস্থাপন করা কারণ বর্তমান প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশে নারীর সর্বাত্মক অংশগ্রহণ ও অবদান অনস্বীকার্য। অথচ অন্ধকার যুগ পেরিয়ে এই সেদিনও অবস্থাটা এমন ছিল না। হাজার বছর ধরে কন্যা সন্তানকে সংসার ও সমাজ জীবনের জন্য বোঝা মনে করা হতো। অবহেলা, অযোগ্য ও অবজ্ঞার দৃষ্টিতে দেখা হতো। বিংশ শতাব্দিতে এসেও যে সেই দৃষ্টিভঙ্গি পুরোপুরি পাল্টে গেছে বা লোপ পেয়েছে তা জোর গলায় বলা যাচ্ছে না। তবুও এসবের মধ্যেই সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নারীদের প্রতি পরিবার ও সমাজের নেতিবাচক ধারণা ধীরে ধীরে পাল্টাচ্ছে। নারীরাই তাদের ধ্যান, জ্ঞান ও কর্মপ্রতিভা দিয়ে ধারণা পাল্টাতে বাধ্য করছে; সংসারে, সমাজে, রাষ্ট্রে নারী তার যোগ্যতা ও দক্ষতা প্রমাণ করে নিজের গ্রহণযোগ্যতা সৃষ্টি করতে পারছে।

কিন্তু এই অর্জন যে খুব সহজেই অর্জিত হয়েছে তা একদমই নয়। নারীকে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের বহুবিধ বাধা অতিক্রম করে আজকের এই পর্যায়ে আসতে হয়েছে। লড়তে হয়েছে নিজের সঙ্গে, সময়ের সঙ্গে, বিরূপ পরিবেশ ও প্রতিক্রিয়ার সঙ্গে। লড়তে হয়েছে বহু শাসন, বাধা আর নিয়ম শৃঙ্খলের বিরুদ্ধে। বারবার তার স্বাধীন, সুন্দর, সুস্থ ও যৌক্তিক চিন্তার পথ আটকে দেয়া হয়েছে। তবু নানা বাধা বিপত্তি অতিক্রম করে নারীরা এগিয়ে যাচ্ছেন। ঘর গৃহস্থালি থেকে শুরু করে কৃষিখাতে, শিল্পউদ্যোগে, অফিস, আদালত, ব্যবসা, শিল্পসাহিত্যএমনকি রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে আজ নারী তার স্বমহিমায় আসীন। অথচ, অনেক ক্ষেত্রেই নারীর এই যোগ্যতাকে যথাযথ স্বীকৃতি দেয়া হয় না। নারী ও পুরুষের সমান অধিকারের প্রশ্ন এলেই এক শ্রেণির জ্ঞানপাপীরা বলার চেষ্টা করেন যে, নারীপুরুষের সমান অধিকার কী করে সম্ভব হবে? যে গুরুভার পুরুষ নিতে পারে তা কি নারীর পক্ষে নেয়া সম্ভব? তারা বোঝানোর চেষ্টা করে প্রকৃতিগতভাবেই নারী পুরুষের চেয়ে শারীরিকভাবে দুর্বল। তাছাড়া পুরুষ ও নারীর শারীরিক বৈশিষ্ট্যের কারণে পুরুষ যা পারে তার সবকিছুই নারীর পক্ষে পেরে ওঠা সম্ভব নয়। তারা কিছুতেই বোঝার চেষ্টা করে না যে, সমান অধিকার মানেই নারীকে পুরুষের সমান ওজনের বোঝা মাথায় নিয়ে পুরুষের সমান যোগ্য প্রমাণ করার ব্যাপার নয়।

সমান অধিকার মানে পরিবার, সমাজ এবং রাষ্ট্রে পুরুষ যেসব সুযোগ ও সুবিধাসমূহ সহজেই ভোগ করতে পারে, সেইগুলো নারীর ক্ষেত্রেও যেন বাধাহীন হয়। কোনো বাধা বিপত্তি এসে নারীর ন্যায্য অধিকার ভোগে কোনো অরাজকতা সৃষ্টি না করে। নারীকে যেন মানুষ হিসেবে গণ্য করা হয়। তা ভিন্ন শারীরিক বৈশিষ্ট্যের কারণে নারী যেন অবজ্ঞা, অবহেলার শিকার না হয়। নারীকে পণ্য হিসেবে গণ্য করে তার স্বাভাবিক জীবনযাপনকে যেন ব্যাহত করা না হয়। পরিবারে ও সমাজে পুরুষের মতো নারীও যেন একজন মানুষের মর্যাদা পায়। কিন্তু কিছু নিম্ন মানসিকতার পুরুষ ও ধর্মান্ধ ব্যক্তি ধর্মের অপব্যাখ্যা দিয়ে নারীর ন্যায্য প্রাপ্তি এবং সার্বিক উন্নয়নের পথে যুগে যুগে বাধা সৃষ্টির পাঁয়তারায় লিপ্ত থেকেছে, এখনো তারা লিপ্ত রয়েছে। নারীকে ক্রমাগত আর্থিক, মানসিক ও শারীরিকভাবে ঠকিয়েই তাদের যত আত্মতৃপ্তি। এর ব্যত্যয় ঘটলেই নারী তাদের দৃষ্টিতে অগ্রহণযোগ্য কোনো কিট হয়ে দেখা দেয়। নারী কলঙ্কিত হয়ে পড়ে।

তবুও, আমরা দেখতে পাই পদে পদে বাধাগ্রস্ত হয়েও পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্রের সর্বত্র নারীর সমান অংশগ্রহণ ও পদচারণা। এমন কোনো ক্ষেত্র নেই যেখানে নারী তার মেধা ও যোগ্যতার স্বাক্ষর রাখেনি। শিক্ষিত, অশিক্ষিত কিংবা স্বল্পশিক্ষিত প্রতিটি নারী নিজ নিজ যোগ্যতানুসারে দেশের অগ্রগতিতে তার অসামান্য অবদান রেখে যাচ্ছে। কৃষি কাজে নারী যেমন তার শ্রম দিতে পিছিয়ে নেই, তেমনি পিছিয়ে নেই আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর কর্মক্ষেত্রেও। বর্তমানে ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ায় নারীর ব্যাপক অংশগ্রহণ প্রমাণ করে যে, পুরুষের চেয়ে নারী কোনো ক্ষেত্রেই এতটুকু পিছিয়ে নেই। নারীকে অবহেলা, অবজ্ঞা করার আর কোনো সুযোগ নেই। বর্তমানে বহির্বিশ্বে আমাদের দেশের পোশাকের বিশাল বাজার তৈরি হয়েছে এবং এই শিল্পের মাধ্যমে সরকার বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করতে পারছে। এ অর্জনের পেছনে এ দেশের অসংখ্য দরিদ্র, অবহেলিত ও বঞ্চিত নারীর অক্লান্ত পরিশ্রম ও একাগ্রতার অবদান কোনোভাবেই অস্বীকার করা যাবে না। মেধা বিচারেও পুরুষের চেয়ে নারী অনেক এগিয়ে আছে।

গত কয়েক বছরের এসএসসি ও এইচএসসির ফলাফলগুলোর দিকে লক্ষ্য করলেই সহজে এর প্রমাণ পাওয়া যায়। এই অগ্রগতি শুধু শহরকেন্দ্রিক নয়। মফস্বল ও প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলের দারিদ্র্যপীড়িত ও নাগরিক সুবিধাবঞ্চিত নারী তার অসীম ধৈর্য ও সহনশীলতা দিয়ে শিক্ষার ক্ষেত্রে তাদের যোগ্যতার পরিচয় দিচ্ছে। এজন্য তারা প্রশংসিতও হচ্ছে। নারীর এই স্বীকৃতি নারীকে তার অগ্রগতির পথে একটু একটু করে এগিয়ে যাচ্ছে। তিন দশক যাবত রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার শীর্ষে রয়েছে নারী। রাষ্ট্র পরিচালনার মতো কঠিন দায়িত্ব পালনেও নারী কোনোভাবেই পিছিয়ে নেই। বর্তমানেও আমাদের দেশের প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেত্রী, স্পিকার নারী এবং তারা দেশ ও জাতির উন্নয়নে অসামান্য অবদান রেখে চলেছেন। নারীর এই অর্জন একদিনে বা খুব সহজে অর্জিত হয়নি। বহু কাঠখড় পুড়িয়ে নারীকে তার কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছতে হয়েছে। প্রত্যেককেই তাদের যোগ্যতার পরীক্ষায় সফলভাবে উত্তীর্ণ হয়েই আজকের এই অর্জন পেতে হয়েছে। রাজনীতির মাঠে যে কোনো দাবি আদায় ও গণতান্ত্রিক আন্দোলনে নারীর উল্লেখযোগ্য অংশগ্রহণ এখন আর নতুন কিছু নয়। বর্তমানে চরম প্রতিযোগিতার যুগে ব্যাংক, বীমা সরকারিবেসরকারি অফিসে পুরুষের সঙ্গে সমান পাল্লা দিয়ে জায়গা করে নিচ্ছে নারী আর অত্যন্ত আন্তরিকতা, সততা ও বিশ্বস্ততার প্রতীক হয়ে উঠছে।

কর্মক্ষেত্রে কাজের প্রতি নারীর আগ্রহ, সততা ও দায়িত্বশীলতা তাদের আরো বেশি গ্রহণযোগ্য করে তুলছে। বর্তমান সময়ে ইলেকট্রনিক ও প্রিন্টিং মিডিয়ার দিকে তাকালেও একই চিত্র দেখা যায়। ক্যামেরার সামনে ও পেছনে নারী তার মেধার সর্বোচ্চ ঢেলে দিচ্ছে। খবরের খোঁজে কিংবা জনগণকে বিভিন্ন বিষয়ে জরুরি তথ্য উপাত্ত ও বিনোদন দিতে দেশবিদেশের এ প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ছুটে উপকরণ সংগ্রহ করে আনতে পিছিয়ে নেই তারা। তাদের এই স্বতঃস্ফূর্ত ও জড়তাহীন অংশগ্রহণ মিডিয়া জগৎকে দিন দিন সমৃদ্ধ করছে।

শেষ করব আশাবাদ ব্যক্ত করে যে, নারীর অগ্রযাত্রাকে বাধাগ্রস্ত করতে অতীতে কম চেষ্টা হয়নি, এখনো সেই চেষ্টা অব্যাহত আছে। এমনকি সামনের দিনগুলোতেও তা একেবারে লোপ পাবে এমনটি ভাবা কষ্টকর। কিন্তু এসব বাধাবিপত্তির পাহাড় ভেদ করে নারী তার মুক্তির পথ খুঁজে নিচ্ছে এটাই আশাব্যঞ্জক। নারী যত নিজের সম্মান ও পরিবারে, সমাজে তার প্রয়োজনীয়তা প্রমাণ করতে পারবে, তাদের অগ্রযাত্রা ও সার্বিক উন্নয়ন তত বেশি বেগবান হবে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধনারীর জন্য আইনসমূহ
পরবর্তী নিবন্ধসুফিবাদীদের প্রাণশক্তি আল্লামা আজিজুল হক ইমাম শেরে বাংলা (রহ.)