নারীর জন্য আইনসমূহ

রিমঝিম আহমেদ | শনিবার , ৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ at ৫:৩৯ পূর্বাহ্ণ

স্বাধীনতার ৫০ বছরে অর্থনীতির সকল সূচকে, মানবিক ও সামাজিক সূচকে বাংলাদেশের বিস্ময়কর সাফল্যের পেছনে নারীদের ভূূমিকা ও অবদান অবিস্মরণীয়।

সাংবিধানিকভাবে নারী পুরুষের সমান অধিকার নিশ্চিত করা, নারী শিক্ষা ও নারীর ক্ষমতায়নে বর্তমানে বাংলাদেশ বিশ্বের রোল মডেল।

দেশের কৃষি, গ্রামীণ অর্থনীতি, পোশাক শিল্প, সার্বিকভাবে উন্নয়ন অগ্রগতিসহ দেশের অর্থনৈতিক অবস্থানের নারীর ঈর্ষণীয় সাফল্য লক্ষ্যণীয়।

কিন্তু, দুঃখজনক হলেও সত্য, নারীদের সর্বত্র সাহসী বিচরণ সত্ত্বেও নারী ও শিশুর উপর নির্যাতন, সহিংসতার ঘটনায় নারীর অগ্রযাত্রা যেন মসৃণ না হয়ে নারীর এগিয়ে যাওয়ার পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে।

ঘরে, বাইরে সামাজিক, রাষ্ট্রীয় মর্যাদার জায়গায় নারীর অবস্থান আশানুরূপভাবে পাল্টায়নি; অথচ পাল্টানোর কথা ছিল। পাল্টায়নি নারীর প্রতি সমাজের এক শ্রেণির মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি। সমাজে নারীপুরুষের সহাবস্থান, অধিকার, প্রাপ্তির ন্যায্যতা এই সমস্ত বোঝাপড়ার যথেষ্ট অভাব। এখনো সমাজ কাঠামোয় নারী পুরুষের অধীন। অধিকাংশের চিন্তায় নারীকে পণ্য পরিগণিত করা, ধর্ষণ ও ইভটিজিংএ নারীর পোশাককে দায়ী করা হয়। যার ফলে নারী ও শিশু উভয়ই নানা ধরনের সহিংসতার শিকার হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে রক্তের কিংবা মানবিক সম্পর্ক, এমনকি বয়সও নির্যাতনের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে না। শিশু থেকে বৃদ্ধা সবাই সহিংসতার শিকার।

নারীর অধিকারকে কেন্দ্র করে প্রণীত রাষ্ট্রীয় আইন, নীতিমালা, সাংবিধানিক দায় ও আন্তর্জাতিক কনভেনশন কম নেই। এইসব আইন যেন কেবল থাকার জন্যই থাকা। আইনের বিধান আর সামাজিক বাস্তবতা দুটোর কোনও মিল নেই। নিত্য নতুন আইন মলাটবন্দি হয়ে আছে। বেশিরভাগ মানুষই জানে না এসব আইন সম্পর্কে। ফলত, এসব আইন ও বিধিমালা আদতে নারী ও শিশুদের কতটুকু স্বাধীনতা ও সুরক্ষা নিশ্চিত করতে পেরেছে তা বিরাট এক প্রশ্ন হয়ে দাঁড়ায় আমাদের সামনে।

বলছি না আইনের দরকার নেই। সমাজের শৃঙ্খলা ও ভারসাম্য রক্ষার্থে আইনের দরকার অতি অবশ্যই আছে। মানুষের অধিকারকে স্বীকৃতি দেয় এইসব প্রচলিত আইনসমূহ। কিন্তু শুধু আইন প্রণয়ন করেই থেমে থাকা চলে না। সে সাথে দরকার আইনের সুষ্ঠু প্রয়োগ, প্রযোজ্য ক্ষেত্রে সঠিক বাস্তবায়ন।

নারী শিশু নির্যাতন, বাল্যবিয়ে, নারীর প্রতি সহিংসতা রোধে রয়েছে বেশ কয়েকটি আইন। অনেক সময় জনসচেতনতার অভাবে, দারিদ্র্যের কারণে, আবার কখনো কখনো লোকলজ্জার ভয়ে, কখনো প্রতিপক্ষ প্রভাবশালী হওয়ায় আইনী প্রতিকার পাওয়ার ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দেখা দেয়। আবার কখনো আইন প্রয়োগের জন্য প্রয়োজনীয় বিধিমালা না থাকায় বিচার প্রাপ্তিতে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। আইন করার পর ‘রিভিউ’ বা ‘প্রিভিউ’ করার ক্ষেত্রে অস্পষ্টতা, আইন সম্পর্কে ধারণার অভাবের কারণে নারীরা অনেক ক্ষেত্রে অধিকার পাচ্ছে না।

মূলতঃ আইন বিষয়ে অজ্ঞতার কারণে অনেক নারী প্রতিনিয়ত শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হলেও পারিবারিক সহিংসতা (প্রতিরক্ষা ও সুরক্ষা) আইন, ২০১০এর কাছে যাচ্ছে না। আবার এআইনের কয়েকটি ধারায় অভিযোগ প্রমাণ করতে গেলে সামাজিক প্রেক্ষাপটে নারীকেই ভোগান্তি পোহাতে হয়।

এই চিত্র অশিক্ষিতশিক্ষিত সব নারীদের মধ্যেই বিদ্যমান।

অনেক নারী বুঝতেই পারেন না যে, তিনি নির্যাতিত হচ্ছেন। কেবল মারধোর, অন্যান্য শারীরিক আঘাতকে নির্যাতন হিসেবে ধরে নেয়। নির্যাতনের ধরণ সম্পর্কে জানতেও অনেক নারীকে গোটা একটা জীবন পার করে দিতে হয়। আইন বিষয়ে সচেতনতা তো আরও বহু দূরের কথা।

নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে দেশে বেশ কিছু আইন প্রণয়ন করা হয়েছে। যেমন নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০ (সংশোধিত ২০০৩); যৌতুক নিরোধ আইন, ১৯৮০; নারী ও শিশু নির্যাতন বিশেষ বিধান আইন, ১৯৯৫; অ্যাসিড অপরাধ দমন আইন, ২০০২; ভ্রাম্যমাণ আদালত আইন, ২০০৯; পর্নোগ্রাফি নিয়ন্ত্রণ আইন, ২০১২; মানব পাচার প্রতিরোধ ও দমন আইন, ২০১২ এবং পারিবারিক সহিংসতা (প্রতিরোধ ও সুরক্ষা) আইন২০১০, জাতীয় শিশু নীতি ২০১১, শিশু আইন ২০১৩ (সংশোধিত ২০১৮) ইত্যাদি।

সেই সাথে আছে সার্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণাপত্র ১৯৪৮, নারীর প্রতি সকল প্রকার বৈষম্য বিলোপ সনদ (সিডো)

নারী ও পুরুষের মাঝে বিদ্যমান সকল প্রকার বৈষম্য দূর করে সমাজে সমঅধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ১৯৭৯ সালের ১৮ ডিসেম্বর জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে সর্বসম্মতিক্রমে ‘নারীর প্রতি সকল প্রকার বৈষম্য বিলোপ সনদ’টি গৃহিত হয়। যেটাকে ইংরেজিতে Convention on the Elimination of All Forms of Discrimination Against Women যা সংক্ষেপে CEDAW (সিডো) নামে পরিচিত।

১৯৮০ সালের ১ মার্চ এই সনদে স্বাক্ষর শুরু হয় এবং ১৯৮১ সালে ৩ সেপ্টেম্বর থেকে সনদটি কার্যকর হয়। ১৯৯৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত মোট ১৬৫টি দেশ এই সনদ অনুমোদন করে স্বাক্ষর করে।

বাংলাদেশ সরকার ২, ১৩ () এবং ১৬.() () ধারাগুলোতে আপত্তি রেখে এই দলিলে স্বাক্ষর করে ১৯৮৪ সালের ৬ নভেম্বর। পরবর্তীতে রিভিউ কমিটির সুপারিশক্রমে ১৯৯৭ সালে ২৪ জুলাই ১৩ () ও ১৬.() ধারাগুলো থেকে আপত্তি প্রত্যাহার করে কিন্তু ধারা ২ এবং ১৬.() থেকে আপত্তি প্রত্যাহারের বিষয়টি এখনো প্রক্রিয়াধীন।

সিডো দলিলের মূল মর্মবাণী হল, সমাজ ও সভ্যতার ক্রমবিকাশে যুগ যুগ ধরে নারী যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে, সেই ভূমিকার যথাযথ স্বীকৃতি দান, সমাজ ও রাষ্ট্রের সকল ক্ষেত্রে নারীপুরুষের মধ্যে সমতা স্থাপন এবং মানুষ হিসেবে নারীর বিকাশ ও উন্নয়নের সার্বিক অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি।

এই সনদে ৩০টি ধারা রয়েছে। ধারা ১ থেকে ১৬ নারীপুরুষের সমতা সংক্রান্ত, ধারা ১৭ থেকে ২২ সিডো এর বাস্তবায়ন সংক্রান্ত এবং ধারা ২৩ থেকে ৩০ প্রশাসন সংক্রান্ত।

এই সনদে স্বাক্ষরকারী রাষ্ট্রসমূহ সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও নাগরিক নির্বিশেষে সকল ক্ষেত্রে নারীপুরুষের মধ্যে সমতা প্রতিষ্ঠার জন্য অঙ্গীকারবদ্ধ। এটাকে লক্ষ্য করে রাষ্ট্রসমূহে প্রচলিত আইন, রাষ্ট্রব্যবস্থা, সামাজিকসাংস্কৃতিক প্রথা, যা নারীপুরুষের মধ্যে বৈষম্য সৃষ্টি করে তা বিলোপ বা পরিবর্তন করবে এবং প্রয়োজনে নতুন আইন প্রণয়ন করবে। এছাড়াও আইনের যথাযথ বাস্তবায়নের জন্য রাষ্ট্রসমূহ সকল প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।

নিজ দেশে কোনো নির্যাতিত নারী বিচার লাভে ব্যর্থ হলে প্রতিবিধান স্বরূপ প্রটোকলের আওতায় সরাসরি জাতিসংঘে অভিযোগ উত্থাপন করতে পারে অপশনাল। অভিযোগ প্রাপ্তির পর সিডো কমিটির নিজস্ব উৎসর মাধ্যমে বিষয়টি তদন্ত করে এবং সংশ্লিষ্ট দেশে নতুন করে ওই ঘটনা তদন্তের জন্য সিডো কমিটির গাইডলাইন অনুযায়ী রিপোর্ট সংগ্রহ করে। সিডর অপশনাল প্রটোকলে মূলত দুটি প্রক্রিয়া রয়েছে। ১. যোগাযোগ অথবা আবেদন করার প্রক্রিয়া ২. তদন্ত করার প্রক্রিয়া। বাংলাদেশ সরকার ২০০০ সালের ৬ সেপ্টেম্বর অপশনাল প্রটোকলের দুটি ধারায় সংরক্ষণ আরোপ করে অপশনাল প্রটোকলে স্বাক্ষর করেছে।

নারীর মানবাধিকার সংরক্ষণের অপশনাল প্রটোকল একটি কার্যকর প্রক্রিয়া হিসেবে জাতিসংঘের যেসব সদস্য রাষ্ট্র প্রটোকল স্বাক্ষর করেছে, সেসব রাষ্ট্রের ওপর দায়বদ্ধতার চাপ অব্যাহত রাখার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

৯টি আন্তর্জাতিক সনদের মধ্যে অন্যতম সিডও সনদ, যাকে বলা হয় Women’s Bill of Rights. শিশু অধিকার সনদের পর এটি সর্বাধিক দেশে অনুমোদনপ্রাপ্ত সনদ।

পূর্ববর্তী নিবন্ধচট্টগ্রাম জেলা পরিষদের নবনির্বাচিত নেতৃবৃন্দকে সংবর্ধনা
পরবর্তী নিবন্ধতুমিই তোমার কর্তা