তবুও মাস্ক পরায় অনীহা

আজাদী প্রতিবেদন | শুক্রবার , ২৫ জুন, ২০২১ at ৬:৪২ পূর্বাহ্ণ

করোনার তৃতীয় ঢেউ শুরু হয়েছে চট্টগ্রামেও। সংক্রমণ ও মৃত্যুর সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। চাপ বাড়ছে হাসপাতালগুলোতেও। বিশেষ করে আইসিইউতে ঠাঁই নেই অবস্থা। ভাইরাসের সংক্রমণ এখনই ঠেকানো না গেলে করোনা পরিস্থিতি আগের তুলনায় আরো ভয়াবহ হতে পারে বলে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন চিকিৎসক, জনস্বাস্থ্যবিদ ও স্বাস্থ্য বিভাগ সংশ্লিষ্টরা। এমন আশঙ্কাজনক পরিস্থিতিতেও স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলায় সাধারণের মাঝে চরম অনীহা লক্ষ্যণীয়। শারীরিক বা সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা তো দূরের কথা অধিকাংশের মুখে মাস্কটিও চোখে পড়ছে না। অথচ, করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ থেকে বাঁচতে ঘন ঘন সাবান-পানি দিয়ে হাত ধোঁয়া ও সামাজিক দূরত্ব মেনে চলার পাশাপাশি মুখে মাস্ক পরার উপর গুরুত্ব দিয়ে আসছেন বিশেষজ্ঞরা। কিন্তু সাধারণ মানুষ এসব স্বাস্থ্যবিধি মানতে তেমন একটা আগ্রহী নয়।
যার কারণে ৩ থেকে ৬ ফুটের সামাজিক/শারীরিক দূরত্ব এখন অনেকটা কিতাবের বিষয়। রাস্তাঘাটে, গণপরিবহনে কিংবা হাট-বাজারের চিত্র যেন স্বাভাবিক। সাধারণের চলাফেরায় দেশে করোনার অস্তিত্ব বলতে কিছু আছে, এমনটাও বুঝার উপায় নেই। সামাজিক দূরত্ব মেনে চলার এমন হাল দেখে অন্তত মাস্ক পরা নিশ্চিতে জোর দিয়েছেন চিকিৎসকরা। সরকারের পক্ষ থেকেও বিভিন্ন আদেশ-নির্দেশ জারি করা হয়েছে। সময়ে সময়ে চালানো হয়েছে ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযানও। এরপরও রাস্তা-ঘাটে, গ্রামে-গঞ্জে কোথাও যেন মাস্ক পরা নিশ্চিত করা যাচ্ছে না। একজন মাস্ক পরছেন তো, পাশের জনের নেই। কেউ কেউ মাস্ক পরলেও তা মুখের পরিবর্তে ঝুলতে দেখা যায় থুতনিতে। আবার কেউ মাস্ক সাথে রাখলেও তা জায়গা করে নেয় পকেটে। রাস্তা-ঘাট, গণপরিবহন, মার্কেট সবখানেই এটাই যেন এখন স্বাভাবিক চিত্র। ব্যতিক্রম নয় অফিসেও। অফিসগুলোতে কয়েকজনের মুখে সঠিক নিয়মে মাস্ক দেখা গেলেও পাশাপাশি বসা অধিকাংশ সহকর্মীর মাস্ক দেখা যায় থুতনিতে। কারো আবার পকেটে। এর মাধ্যমে নিজে তো বটেই, পাশের মানুষটিকেও সংক্রমণের ঝুঁকিতে ফেলা হচ্ছে বলে মনে করেন কঙবাজার মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ ডা. অনুপম বড়ুয়া। মেডিসিনের এই অধ্যাপক বলেন, সংক্রমণ ঠেকাতে হলে মাস্ক সঠিক নিয়মে পরা জরুরি। মাস্ক দিয়ে নাক-মুখ ঢেকে রাখতে হবে। থুতনিতে নামিয়ে রাখলে সংক্রমণ কোনোভাবে ঠেকানো যাবে না। বরং তাতে সংক্রমণের ঝুঁকিটা বেশি। ব্যবহার করা মাস্কটি হাতে স্পর্শ করা থেকে বিরত থাকতে হবে। পকেটেও রাখা যাবে না। ব্যবহার করা মাস্ক স্পর্শ করলে কিংবা একবার পকেটে আবার মুখে, এমন করলে সংক্রমণের ঝুঁকিটা বেড়ে যায়। তাই মাস্ক পরায় সবাইকে আরো সচেতন হওয়ার অনুরোধ জানান কঙবাজার মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ ডা. অনুপম বড়ুয়া।
চিকিৎসকরা বলছেন, ঘরে-বাইরে শারীরিক দূরত্ব বজায় রেখে চলাফেরা করছেন, এমন দৃশ্য খুব বিরল বলা চলে। সাধারণ মানুষের চলাফেরায় মনে হয় করোনার অস্তিত্বই যেন নেই। যার ফলে দিন দিন সংক্রমণ বেড়েই চলছে। সংক্রমণের এই ঊর্ধ্বগতি এখনই থামানো না গেলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে। তাই সংক্রমণ থেকে রক্ষা পেতে হলে সঠিক নিয়মে মুখে মুখে মাস্ক পরানো নিশ্চিত করাটা জরুরি। কিন্তু সাধারণ মানুষকে মাস্ক পরানোই এখন বড় চ্যালেঞ্জ।
গতকাল বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার বেশ কয়জনের সাথে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। যাদের মুখে মাস্ক দেখা যায়নি। মাস্ক না পরার কারণ জানতে চাইলে একেক জন একেক ধরণের অজুহাত দেখিয়েছেন। কেউ বলছেন, বেশিক্ষণ মাস্ক পরে থাকলে এক প্রকার অস্বস্তি কাজ করে। আর কেউ বলছেন, নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হয়। ‘করোনা আমাকে ধরবেনা’ বলেও ঠাট্টা করেছেন কেউ কেউ। সবমিলিয়ে বেশির ভাগ মানুষের মাঝে মাস্ক পরা ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার প্রবণতা অনুপস্থিত।
মুখে মাস্ক ছাড়াই বেচা-বিক্রি করছিলেন বহদ্দারহাটের মুদি দোকানি অলি আহমদ। মাস্ক না পরার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘মাস্ক আছে। ক্যাশ বাঙে ঢুকিয়ে রেখেছি। মাস্ক পরলে এক ধরণের অস্বস্তি লাগে। বেশ কিছুদিন পরার পর এখন আর পরতে ইচ্ছে হয় না।’ একই ধরণের কথা শোনা যায় ওষুধের দোকানি সানির মুখেও। কথার ফাঁকে মাস্কটি খুলে রাখার পর আর পরতে মনে ছিল না বলে জানান ফার্মেসিতে বসা এই ওষুধ বিক্রেতার।
মুখের পরিবর্তে মাস্কটি থুতনিতে ঝুলতে দেখা যায় চেরাগী পাহাড় এলাকার আরিফের। কথা বলার জন্য মাস্কটি নামানোর পর আর মুখে দেয়ার কথা মনে নেই বলে জানান। মুখের পরিবর্তে মাস্কটি পকেটে রাখার বিষয়ে জানতে চাইলে বেশিক্ষণ মাস্ক পরে থাকলে নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হয় বলেও জানান কেউ কেউ।

একদিকে ভয়াবহ পরিস্থিতির শঙ্কা আর অন্যদিকে মানুষের মাঝে মাস্ক পরতে অনীহা, এমন পরিস্থিতিতে সাধারণ মানুষের মাঝে সচেতনতা বাড়াতে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলার তাগিদ দিয়েছেন চট্টগ্রাম মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রফেসর ডা. মো. ইসমাইল খান ও জনস্বাস্থ্য অধিকার রক্ষা কমিটির আহ্বায়ক বীর মুক্তিযোদ্ধা ডা. মাহফুজুর রহমান। প্রফেসর ডা. মো. ইসমাইল খান মনে করেন, করোনার হাত থেকে রক্ষা করতে হলে সাধারণ মানুষকে মাস্ক পরানোর বিকল্প নেই। কিন্তু সাধারণ মানুষ এ বিষয়ে সচেতন নয়। তাই সাধারণ মানুষের মাঝে সচেতনতা বাড়াতে সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোকে কাজে লাগিয়ে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে।
প্রয়োজনে ১৫ দিনের কর্মসূচি হাতে নেয়া যায়। এসময়ে সামাজিক সংগঠনগুলোর সদস্যরা নিজেদের এলাকায়-মহল্লায় সাধারণ মানুষের মুখে মাস্ক পরানো নিশ্চিত করবেন। এজন্য সরকারের পক্ষ থেকে মাস্ক সরবরাহের উদ্যোগ নিতে হবে। সামাজিক সংগঠনগুলোর সদস্যরা নিজেদের এলাকায়-মহল্লায় ঘুরে ঘুরে মানুষের মাঝে মাস্ক সরবরাহ করবেন এবং মাস্ক পরতে মানুষকে সচেতন করে তুলবেন। এভাবে ১৫ দিনের কর্মসূচি নিলে অনেকটা ইতিবাচক সুফল পাওয়া যাবে বলে আশা প্রকাশ করেন চট্টগ্রাম মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রফেসর ডা. মো. ইসমাইল খান।
সহমত পোষণ করে প্রবীণ চিকিৎসক ডা. মাহফুজুর রহমান বলেন, এখন স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা বা মাস্ক পরার ক্ষেত্রে অনেকটা আদেশ-নির্দেশ পালনের বিষয় দাঁড়িয়ে গেছে। এভাবে কিন্তু সাধারণ মানুষকে বাধ্য করা যাচ্ছে না। তাই তাদের সচেতন করার দিকেই মনোযোগ দিতে হবে। সেক্ষেত্রে কমিউনিটিকে এ কাজে সম্পৃত্ত করতে হবে। প্রয়োজনে গ্রাম পর্যায়ে প্রতি ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে আর শহরে মহল্লায়-মহল্লায় একটি করে কমিটি করা যেতে পারে। ওই কমিটির সদস্যরা সচেতনতা সৃষ্টিতে কাজ করবেন। এভাবে কমিউনিটিকে সম্পৃত্ত করতে পারলে সাধারণ মানুষের মুখে মুখে মাস্ক পরানো অনেকটা নিশ্চিত করা সম্ভব। আর মাস্ক পরানো নিশ্চিত করতে পারলে সংক্রমণের হাত থেকে অনেকটাই রক্ষা পাওয়া সম্ভব।
করোনা ছাড়াও সংক্রামক ও বায়ুবাহিত অন্যান্য রোগ থেকেও সুরক্ষা দেয় মাস্ক :
সঠিক নিয়মে মাস্ক পরলে করোনা ছাড়াও সংক্রামক ও বায়ুবাহিত অন্যান্য রোগ থেকেও সুরক্ষা পাওয়া যায় বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা। চিকিৎসকরা বলছেন- বাতাসে ধুলা-বালির মাধ্যমে বিভিন্ন রোগের জীবাণু মানুষের শরীরে প্রবেশ করে। বায়ুবাহিত এসব রোগের মধ্যে সর্দি জ্বর, হাম, বসন্ত, ইনফ্লুয়েঞ্জা, শ্বাসতন্ত্রের রোগ, হাঁপানি ও ফুসফুসে দীর্ঘস্থায়ী রোগ অন্যতম। এ ধরণের রোগে আক্রান্তদের কফ, থুথু, হাঁচি-কাশি ইত্যাদির মাধ্যমেও এসব রোগের জীবাণু ছড়ায়। যক্ষ্মা রোগের জীবাণুও একইভাবে ছড়ায়। সুস্থ কেউ এসব রোগীর আশেপাশে থাকলে শ্বাস নেওয়ার সময় বাতাসের সঙ্গে ওই রোগের জীবাণু সুস্থ মানুষটির শরীরে প্রবেশ করে। তবে মুখে সঠিক নিয়মে মাস্ক পড়া থাকলে এসব জীবাণুর সংক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। তাই সমাজের সব স্তরের সকল বয়সীদের মাস্ক পড়া নিশ্চিত করা অতিশয় জরুরি বলছেন কঙবাজার মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. অনুপম বড়ুয়া। অবশ্য পরিধেয় মাস্কটি কোথায় ছুঁড়ে ফেলা হচ্ছে, সে বিষয়টিও গুরুত্বসহকারে দেখার পরামর্শ এই চিকিৎসকের। ডা. অনুপম বড়ুয়ার মতে- মাস্ক কেবল পরলেই হবে না। পরিধেয় মাস্কটি ফেলার জন্য একটি ডাস্টবিন বা যথাযথ জায়গা সুনির্দিষ্ট করা দরকার। যাতে করে পরিধেয় এসব মাস্ক সেখানে (নির্দিষ্ট ডাস্টবিনে) ফেলার পর পুড়িয়ে ফেলা যায়। পরিধেয় মাস্কটি যেখানে-সেখানে ছুঁড়ে ফেলা হলে করোনা সংক্রমণ আরো বাড়তে পারে বলেও সতর্ক করেছেন ডা. অনুপম বড়ুয়া।

পূর্ববর্তী নিবন্ধকর হার বাড়বে না : মেয়র
পরবর্তী নিবন্ধবাদীর পরিচয় নিশ্চিতে হাই কোর্টের পাঁচ নির্দেশনা