ঢাকা আইসিডি ও পানগাঁও টার্মিনালের মাধ্যমে আমদানি হচ্ছে চট্টগ্রামের পণ্য

শুল্ক ফাঁকি দিয়ে আসছে পুরনো ইঞ্জিন ও মোটর পার্টস, জড়িত চক্র

হাসান আকবর | রবিবার , ১ অক্টোবর, ২০২৩ at ৪:৩৫ পূর্বাহ্ণ

চট্টগ্রামের পণ্য ঢাকা আইসিডি ও পানগাঁও টার্মিনালের মাধ্যমে আমদানি হচ্ছে। আমদানি নিষিদ্ধ কোটি কোটি টাকার পণ্যও নিয়ে আসা হচ্ছে। চট্টগ্রামে কড়াকড়ি শুরু হওয়ায় সংঘবদ্ধ চক্র পুরনো ইঞ্জিন ও মোটর পার্টস গতিপথ পাল্টে চট্টগ্রামে নিয়ে আসছে। মিথ্যা ঘোষণাসহ নানা গোঁজামিলে তারা সরকারের কোটি কোটি টাকার রাজস্ব ফাঁকি দিচ্ছে। দীর্ঘ পথ ঘুরে চট্টগ্রামে আনা পণ্যগুলো এখানকার বিভিন্ন গুদামে রাখা হয়েছে। চট্টগ্রামের চিহ্নিত কয়েকজন ইঞ্জিন ব্যবসায়ীর গুদামে শুল্ক ফাঁকি দিয়ে আনা কয়েকশ কোটি টাকার পুরনো ইঞ্জিন এবং গাড়ির ‘হাফ কাট’ রয়েছে। এর মধ্যে বিপুল পরিমাণ পণ্য আবার আমদানি নিষিদ্ধ বলে সূত্র জানিয়েছে। বিদেশ থেকে আনা চট্টগ্রামের পণ্য ঢাকা ঘুরিয়ে কেন আনা হচ্ছে তা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। পাশাপাশি চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছে।

সূত্র জানিয়েছে, বাংলাদেশে পুরনো ইঞ্জিনের বাজার কয়েক হাজার কোটি টাকার। দেশের মোটরযান সেক্টর ও নৌযানের ইঞ্জিনের বড় অংশ আমদানি করা পুরনো ইঞ্জিন দিয়ে যোগান দেওয়া হয়। মাছ ধরা এবং যাত্রী বহনে নিয়োজিত হাজার হাজার ছোট নৌযান পুরোপুরিভাবে আমদানিকৃত পুরনো ইঞ্জিন দিয়ে চালানো হয়। মোটরযানের ইঞ্জিনেরও চাহিদা রয়েছে। রিকন্ডিশন্ড বা নতুন গাড়ির সাথে আসা ইঞ্জিন বছর কয়েক চলার পরই পাল্টে ফেলা হয়। আর এই ইঞ্জিন পাল্টানো পুরোপুরিভাবেই আমদানিকৃত পুরনো ইঞ্জিনের ওপর নির্ভরশীল।

দেশে বহু বছর ধরে পুরনো ইঞ্জিন আমদানি করা হয়। প্রচলিত নিয়ম কানুন অনুসরণ করে সাত বছর পর্যন্ত পুরনো ইঞ্জিন আমদানি করার সুযোগ রয়েছে। সাত বছরের বেশি পুরনো ইঞ্জিন আমদানি করা নিষিদ্ধ। আবার ইঞ্জিন আমদানি হলেও কোনো অবস্থাতেই চেসিসসহ কেবিন, টায়ার, ব্যাটারি আমদানির সুযোগ নেই। আবার জাপানি ইঞ্জিন আমদানির সুযোগ থাকলেও চীন এবং তাইওয়ানের ইঞ্জিন আমদানি কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। কিন্তু চট্টগ্রামে গড়ে ওঠা সংঘবদ্ধ একটি চক্র আমদানি নিষিদ্ধ চীন ও তাইওয়ানের ইঞ্জিন নিয়ে আসে।

একইভাবে ‘হাফ কাট’ নিষিদ্ধ হলেও চক্রটি হরদম হাফ কাট নিয়ে আসছে। চট্টগ্রামে অঙিজেন মোড়, চান্দগাঁও আবাসিক এলাকা, ধনিয়ালাপাড়া, দেওয়ানহাট, হালিশহরসহ বিভিন্ন এলাকায় গড়ে ওঠা গুদামে কোটি কোটি টাকার আমদানি নিষিদ্ধ ইঞ্জিন এবং হাফ কাট রয়েছে। চট্টগ্রামের কয়েকজন আমদানিকারক আমদানি নিষিদ্ধ ইঞ্জিন এবং হাফ কাট আনার পুরো কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ করেন। কাগজপত্রে নানা গোঁজামিল দিয়ে তারা এসব পণ্য দেশে নিয়ে আসে। চীন ও তাইওয়ানের ইঞ্জিনের পাশাপাশি চেসিসসহ কেবিন নিয়ে আসার ঘটনা প্রাত্যহিক বলে উল্লেখ করে সংশ্লিষ্ট সূত্র বলেছে, বিদেশে পুরনো গাড়ি কিনে কেটে দুই টুকরা করে নিয়ে আসা হচ্ছে। এখানে এসে জোড়া দিয়ে এসব গাড়ি অনায়াসে রাস্তায় নামানো হচ্ছে। যাতে সরকারের কোটি কোটি টাকার রাজস্ব ফাঁকি দেওয়া হচ্ছে।

শুধু হাফ কাট বা আমদানি নিষিদ্ধ ইঞ্জিন নয়, বৈধ ইঞ্জিনের অবৈধ আমদানির রমরমা বাণিজ্য চলছে এই সেক্টরে। সংঘবদ্ধ চক্রটি ইঞ্জিনের সিসি গোপন করার পাশাপাশি ডিজেল অকটেনেও গোঁজামিল দেয়। আর এই গোঁজামিলে কালো টাকার পাহাড় গড়ছেন চট্টগ্রামের ইঞ্জিন ব্যবসায়ীদের অনেকে। চক্রটির সাথে টিকতে না পেরে বৈধ আমদানিকারকদের অনেকে ব্যবসা গুটাতে বাধ্য হয়েছেন।

সূত্রে জানা যায়, ঢাকা ও চট্টগ্রামের শ’খানেক আমদানিকারক ইঞ্জিন আমদানির সাথে জড়িত হলেও দেড় হাজারের মতো দোকানে এসব ইঞ্জিনের ব্যবসা চলে। দেশে কার, ট্রাক, কাভার্ড ভ্যান, জিপসহ বিভিন্ন গাড়ির ইঞ্জিন আমদানি করা হয়। পুরাতন গাড়ির ইঞ্জিনের মধ্যে চার সিলিন্ডার, ছয় সিলিন্ডার, আট সিলিন্ডার এবং সর্বোচ্চ দশ সিলিন্ডারের ইঞ্জিন আমদানি করা হয়। ইঞ্জিনের শুল্ক আদায় করা হয় সিলিন্ডারের ওপর। ইঞ্জিনের সিলিন্ডার বাড়ার সাথে সাথে শুল্কের পরিমাণও বাড়তে থাকে। প্রচলিত শুল্কনীতি অনুযায়ী, বর্তমানে ডিজেল ইঞ্জিনের ক্ষেত্রে চার সিলিন্ডারের একটি পুরনো ইঞ্জিনের দাম ৪০০ ডলার নির্ধারণ করে সর্বমোট ট্যাঙ আদায় করা হয় ২৮ হাজার টাকা। ছয় সিলিন্ডারের ক্ষেত্রে দর ৭০৪ ডলার নির্ধারণ করে ট্যাঙ আদায় করা হয় ৩৯ হাজার টাকা। আট সিলিন্ডারের একটি পুরাতন ডিজেল ইঞ্জিনের দর ১৩শ থেকে ১৬শ ডলার নির্ধারণ করে ট্যাঙ আদায় করা হয় ৭৮ হাজার টাকা এবং দশ সিলিন্ডারের একটি ইঞ্জিনের দাম ১৬শ ডলার থেকে ২১শ ডলার নির্ধারণ করে শুল্ক আদায় করা হয় ১ লাখ দশ হাজার টাকা।

অপরদিকে পেট্রোল ইঞ্জিন হয় শুধুমাত্র চার সিলিন্ডারের। চার সিলিন্ডারের একটি পেট্রোল ইঞ্জিনের মূল্য ২০০ ডলার নির্ধারণ করে শুল্ক নেওয়া হয় ৯ হাজার ৯০০ টাকা। আমদানিকারকেরা ডিজেল ইঞ্জিন এবং বেশি সিলিন্ডারের ইঞ্জিন এনে ৪ বা ৬ সিলিন্ডার ঘোষণা দিয়ে খালাস করে নিচ্ছে। এতে সরকার কোটি কোটি টাকার রাজস্ব হারাচ্ছে। ৮ বা ১০ সিলিন্ডারের একটি ইঞ্জিনকে ৬ সিলিন্ডার ঘোষণা দিয়ে খালাস করলেই ফাঁকি দেওয়া সম্ভব হয় গড়ে প্রায় ষাট হাজার টাকা। আবার ডিজেল ইঞ্জিনকে পেট্রোল ইঞ্জিন ঘোষণা দিলেই ফাঁকি দেওয়া সম্ভব হয় কমপক্ষে ২০ হাজার টাকা। একেকটি কন্টেনারে ২৮ টন পর্যন্ত ওজনের পণ্য বোঝাই করা হয়। এতে ৪ সিলিন্ডার হলে এক কন্টেনারে কমপক্ষে ৮০টি, ৬ সিলিন্ডার হলে ২৬টি এবং ৮ বা ১০ সিলিন্ডার হলে ১২/১৩টি পুরনো ইঞ্জিন এবং সাথে অন্যান্য পার্টস বোঝাই করা হয়।

পুরনো ইঞ্জিন আমদানির আড়ালে কোটি কোটি টাকা শুল্ক ফাঁকির ব্যাপারে আজাদীসহ বিভিন্ন পত্রিকায় ব্যাপক লেখালেখি শুরু হলে চট্টগ্রাম কাস্টমস এবং বন্দরে ব্যাপক কড়াকড়ি আরোপ করা হয়। আর এর ফলে সংঘবদ্ধ চক্রটি চট্টগ্রামের পরিবর্তে ঢাকার কমলাপুর আইসিডি এবং পানগাঁও কন্টেনার টার্মিনালের মাধ্যমে পণ্য খালাস শুরু করে। ইতোমধ্যে কয়েকটি কন্টেনার কমলাপুর আইসিডি এবং পানগাঁও টার্মিনাল দিয়ে খালাস করা হয়েছে। বিদেশ থেকে আনা আরো বেশ কয়েকটি কন্টেনার পানগাঁও এবং ঢাকা আইসিডিতে রয়েছে বলে উল্লেখ করে সূত্র জানিয়েছে, কন্টেনারগুলোতে মিথ্যা ঘোষণায় আনা কোটি কোটি টাকার পণ্য রয়েছে।

শুধুমাত্র শুল্ক ফাঁকি দেওয়ার জন্যই চট্টগ্রামের পণ্যগুলো ঢাকা ঘুরিয়ে আনা হচ্ছে। এসব পণ্য জাপান কিংবা দুবাই থেকে জাহাজে চট্টগ্রাম বন্দরে নেমেছে। এখান থেকে ট্রেনে কিংবা জাহাজে আবার কমলাপুর আইসিডি কিংবা পানগাঁও টার্মিনালে গেছে। ওখান থেকে আবার সড়কপথে চট্টগ্রামে আনা হচ্ছে। এতে খরচ বাড়লেও সংঘবদ্ধ চোরাকারবারি চক্র সরকারের রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে সেই খরচ পুষিয়ে নিচ্ছে।

এ বিষয়ে গতকাল ঢাকা আইসিডির দায়িত্বশীল একজন কর্মকর্তা বলেন, আইসিডিতে অনেক কন্টেনার আছে। এগুলো আমদানিকারকেরা কেন এখানে এনেছে বা এখান থেকে খালাস করে কোথায় নিয়ে যাবে সেই তথ্য আমাদের জানা নেই। কাস্টমসের শুল্কায়নের পর আমাদের এখান থেকে কন্টেনার খালাস করে নেওয়া হয়। সেই কন্টেনার গেটের বাইরে গেলে কোথায় যায় সেই তথ্য আমাদের কাছে নেই। এখানে বিশেষ কোনো সুবিধা দেওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। আমদানিকারকেরা নিজেদের সুবিধার কথা চিন্তা করেই পণ্য খালাস করেন। এর সাথে আইসিডির কোনো সম্পর্ক নেই।

পূর্ববর্তী নিবন্ধবিআরটিএকে দালালমুক্ত করতে চাই
পরবর্তী নিবন্ধবিএনপির ৮৫ জনের নামে মামলা