ডাইল হিরি

সত্যব্রত বড়ুয়া | শুক্রবার , ২ জুলাই, ২০২১ at ৭:৪৭ পূর্বাহ্ণ

চাকরি জীবনে এক সময় আমি নোয়াখালিতে চাকরি করেছি। নিজে রান্না করে খেতাম। কিন্তু রান্না করতে ভালো লাগতো না বলে বেশিরভাগ সময়েই খেতাম হোটেলে। মাসের ১ম সপ্তাহে প্রায় প্রতিদিনই খেতাম মাংস। ২য় সপ্তাহে খেতাম মাছ। ৩য় সপ্তাহে পকেট খালি হয়ে আসতো বলে শুধু সব্জি খেতাম। ৪র্থ সপ্তাহে দুপুরের খাওয়াটা বিকেলে খেয়ে রাতে আর খেতাম না। খুঁজতাম সস্তা খাওয়ার হোটেল। খুঁজতে গিয়ে খিদেয় ক্লান্ত হয়ে পড়তাম। হাঁটতে পারছিলাম না। হঠাৎ একটা ডাক শুনলাম। হোটেলের এক কর্মচারী উঁচু স্বরে বলছে, আহেন আহেন ডাইল হিরি। প্রথমে হিরি কথাটার মানে বুঝতে না পারলেও পরে বুঝলাম যে সে ফ্রি-কেই হিরি বলছে। অর্থাৎ এই হোটেলে ডাল খাওয়ার জন্যে কোনো দাম নেওয়া হয় না। এদিক সেদিক তাকিয়ে দেখলাম কোনো পরিচিত জন আছে কিনা। টুক করে ঢুকে পড়লাম ডাইল হিরি হোটেলে। দেখি কুলি মজুরে ভর্তি। বয় আমার কাছে এসে বললো, মাছ, মাংস, সব্জি সব কিছুই আছে। আমি বললাম, আমাকে শুধু এক প্লেট ভাত আর হিরি ডাইল দাও। সে বললো, আমরা শুধু ভাতের সাথে হিরি ডাইল দিই না। কিছু একটা খেলেই তবে দেই। আমি না খেয়ে উঠে যাচ্ছিলাম। ম্যানেজার ব্যাপারটা লক্ষ্য করেছিলো। বয়কে ডেকে বললেন, ওনাকে হিরি ডাইল দিয়ে দাও। ডাল খেয়ে বুঝতে পারলাম এর রংটাই শুধু ডালের। মনে হলো এক ডেকচি পানির সাথে শুধু এক চিমটি ডাল মিশিয়ে এই হিরি ডাইল তৈরি করা হয়েছে। ছাত্র জীবনে হোস্টেলে প্রতিদিনই এধরনের পানসে ডাল খেয়েছি। এটা হিরি ডাইল ছিলো না। একবার আমার এক বিশিষ্ট ভদ্রলোকের সাথে পরিচয় ঘটেছিলো। তিনি এক সময় আসামের একটি টি গার্ডেনের ম্যানেজার ছিলেন। বাড়ি চাঁটগাতেই। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর আসাম হতে এখানে চলে এসেছেন। তাঁর মুখে টি গার্ডেনের গল্প শুনতে খুব ভালো লাগতো। সেখানে তাঁরা নাকি সব সময় ‘লেন্টিল সূপ’ খেতেন। এটা কী ধরনের সূপ তা আমি বুঝতে পারতাম না। তিনি বললেন, আজ আপনাকে আমি ‘লেন্টিল সূপ’ খাওয়াবো। আমাকে জোর করে তাঁর বাসায় নিয়ে গেলেন। ভদ্রলোকের স্ত্রী খুব যত্ন করে লেন্টিল সূপ বানালেন। খেয়ে বললাম, এত স্বাদের সূপ এর আগে আমি কখনো খাইনি। এক্স ম্যানেজারকে বললাম, লেন্টিল কথাটার অর্থ আমি বুঝতে পারিনি। তিনি বললেন, এটা মসুর ডালের তৈরি সূপ। তৈরি করা হয়েছে আদাকুচি, গোলমরিচ, এলাচি, তেজপাতা আর লেবুর রস দিয়ে। এই সূপ খেলে দেহ-মন চাঙ্গা হয়ে উঠে। কথাটা মিথ্যে নয়। তাঁরা এই সূপ খেয়ে সুস্থ রয়েছেন। এক সময় ডালকে বলা হতো গরীবের মাংস। সেদিন আমার এক আত্মীয় আমাকে নেমন্তন্ন করতে এসে বললেন, সামান্য ডাল ভাতের আয়োজন করেছি। আমি বললাম, আপনি তো দেখছি একজন অসামান্য মানুষ, কারণ ডাল এখন মহার্ঘ বস্তু। মাঝে মাঝে ভাবি আমার সেই ‘হিরি ডাইল’ জীবনের কথা।

পূর্ববর্তী নিবন্ধভ্রম
পরবর্তী নিবন্ধসীতাকুণ্ডে অস্ত্রসহ ডাকাত দলের ৩ সদস্য গ্রেপ্তার