ভ্রম

মিলন বনিক | শুক্রবার , ২ জুলাই, ২০২১ at ৭:৪৬ পূর্বাহ্ণ

বড় কর্তা।
আমার ইংরেজি জ্ঞানের বহর জানতে চাইলেন। তখনও সামনের সীটে বসার অনুমতি পাইনি। আমার সংকোচ হচ্ছে। কী করে বসি। যাই হোক। একজনের রেফারেন্সে বড় আশা নিয়ে এসেছি। একটা চাকরির জন্য। আমার সততা, ভদ্রতা এবং নমনীয়তা সাহেবের পছন্দ হলেই হয়তো বসার অনুমতি মিলবে। দয়া কিংবা করুণা করে একটা চাকরিও দিতে পারে। অভদ্রতা যদি সেই করুণাটুকুও কেড়ে নেয় সেটা ভেবে শংকিত ছিলাম। পাছে না ভাবে – ছেলেটা তো ভারী বেয়াদব, অসভ্য। একে চাকরি দেওয়া যাবে না।
টেবিলের উপর অবিন্যস্ত ক’টা ফাইল। কী যেন দেখছেন। সোনালী রং-এর ছোট ফুলদানীতে সাজিয়ে রাখা কিছু কাঁচা ফুল। গন্ধটা তেমন নেই। গুলিয়ে গেছে সিগারেটের ধোঁয়ায়। পাশেই বেনসন এন্ড হেজেজ। হীরক খণ্ডের মত স্বচ্ছ কাঁচের এসট্রেতে খানিকটা জল। ক’টা সিগারেটের দুই তৃতীয়াংশ পানিতে ভিজে চুপসে আছে। পানিগুলো গাঢ় তামাটে রং ধারণ করেছে।
যার সামনে বসলাম তিনি বড় কর্তা। একটা শিপিং কোম্পানীর ব্যবস্থাপনা পরিচালক। কর্তাটি প্যাকেট থেকে একটা বেনসন নিয়ে মুখে দিলেন। সুদৃশ্য লাইটারটা দু’আঙ্গুলের ফাঁকে নিয়ে বাম হাতের একটা আঙ্গুল দিয়ে একবার ঘুরিয়ে নিলেন। তারপর লাইটার জ্বালিয়ে একগাল ধোঁয়া ছেড়ে বললেন-
– নাম কী।
– অমিয় চৌধুরী।
– ইংরেজি কেমন পারো?
বলা বাহুল্য আমি সদ্য গ্রাজুয়েশান করেছি। তাও গ্রামের কলেজ থেকে। আমার একটা চাকরি খুব দরকার। পরিবারের পাঁচটা মুখ তাকিয়ে আছে আমার দিকে। গ্রামের কলেজে লেখাপড়ার যা পরিবেশ তাতে ইংরেজি দূরে থাক মাতৃভাষাটাও ঠিক মত রপ্ত করা মুশকিল। ক্লাস আর হতো কোথায়। সস্তা কিছু ইংরেজি ডায়ালগ। না মারলে কেমন বেমানান লাগে। ফার্স্ট ক্লাস সিটিজেনশীপ নেওয়াটা কেমন পণ্ডশ্রম মনে হয়। তাছাড়া হ্রস্ব-ই কার কিংবা দীর্ঘ-ঈ কারের তেমন ঝামেলাও নেই। বাংলা ভাষার বিস্তৃৃতি আর ব্যাপকতাও বুঝি সীমিত হয়ে আসছে। একটা সীমাবদ্ধ গণ্ডির মধ্যে আবদ্ধ হতে চলেছে। তাতে আর বিচিত্র কী। “ওই একটা হলেই হলো” এই মনোভাব অনেকের।
এই টানা পোড়েনে দু’দিকটাই হারালাম। না বাংলা (মাতৃভাষা) না ইংরেজি। কোনটায় মার্কেটে চলার মত রপ্ত করা হয়নি। তাই ঘুরছি। শুধু ঘুরছি। একটা চাকরির জন্য। এক বুক প্রত্যাশা নিয়ে। একের পর এক অফিস পাড়ার দরজায় কড়া নাড়ছি।
এম. ডি সাহেবের প্রশ্নের জবাবে সত্য কথাটায় বলে ফেললাম-
– স্যার একটু একটু পারি।
– পড়তে পারো।
– পারি।
– ঙঃযবৎ ঊীঢ়বৎরবহপব
– ঘড়
স্যার বিদ্রুপ করার মত সিগারেটের ধোয়াটা আমার দিকে ছুড়ে দিল। বুঝলাম স্যার খুশি হতে পারেননি। চোখ পড়ল পাশের টেবিলে। একগাদা ইংরেজি ম্যাগাজিন। চোখ বুলিয়েও কিছু বোধগম্য হলো না। অধিকাংশ ম্যাগাজিনের কভারে অর্ধনগ্ন নারীচিত্র। আমাদের মত পোড় খাওয়া সামাজিক রীতিতে কেমন বেমানান। টিউশানির সামান্য আয়। তাতে ইংরেজি ম্যাগাজিন কিনে পড়ার দুঃসাহস কখনও হয়নি। ভয় হলো না জানি আবার ইংরেজিতে কী প্রশ্ন করে বসেন। মনে মনে একটা ইংরেজি ডায়ালগ মুখস্ত করে নিলাম। যদি কাঠ-খোট্টা কোন ইংরেজী প্রশ্ন করে বসে তাহলে বলব-
ও ধস ংড়ৎৎু ংরৎ, ও পধহ্থঃ ঁহফবৎংঃধহফ ঃযরং য়ঁবংঃরড়হ. চষবধংব ধংশ ঃযব য়ঁবংঃরড়হ রহ ইবহমধষর? কিন্তু কিভাবে বলবো তা ভেবে রীতিমত হৃদকম্পন শুরু।
কথাটা বলতে পারিনি বলে, গার্মেন্টসে কিউ.সি’র চাকরিটা হলো না। আমার দুর্ভাগ্য ভাইবা বোর্ডে তৎক্ষণাৎ কথাটা আমার মনে পড়েনি। কথাগুলো সাজিয়েছি আরও অনেক পরে। পরদিন আরও কনফার্ম হলাম যখন দেখলাম রেজাল্টশীটে আমার নাম উঠেনি। অথচ ডায়ালগটা বলতে পারলে নির্ঘাত চাকরি। এই ভ্রম এর অবতারণা হতো না। একবার গিয়ে বলে আসতে চাইলাম, আমার ভ্রম হয়েছে। কিন্তু কে শুনবে আমার কথা।
এম. ডি সাহেব সদোপদেশ দিলেন। আমি মনোযোগ দিয়ে শুনলাম।
বললেন, পারলে ল্যাপটপ কিনে নাও। বিভিন্ন প্রফেশনাল কোর্স করো। কম্পিউটারে দক্ষ হতে হবে। ইংরেজি ম্যাগাজিন পড়ো তাতে অনেক কিছু শিখতে পারবে। ইংলিশ ল্যাংগুয়েজ কোর্সে ভর্তি হও, মাস্টার্সটা কমপ্লিট করো। আরও অনেক পরামর্শ দিলেন আমার ভবিষ্যৎ উন্নতির জন্য। এসব করলে আমার যাতে কোন সমস্যা না হয় সে চেষ্টাও করবেন। আমার মাথাটা একবার কৃতজ্ঞতায় নতজানু হল। আসলে বড় কর্তা এই অল্প সময়ে আমার জন্য অনেক ভেবেছেন। আমার ভবিষ্যতের কথা ভেবে বিনা পারিশ্রমিকে আমাকে কতগুলো পরামর্শ দিলেন। আমার সারা জীবন মনে থাকবে। এই পরামর্শের সাথে সম্ভবত উনার ব্যবসায়িক কোন সম্পর্ক নেই।
অথচ কোনটায় আমার পক্ষে করা সম্ভব নয়। ইচ্ছার অপমৃত্যু ঘটুক এই আমি চাই। এর বেশি কিছু হয়তো সম্ভব নয়। সবই হতো যদি একটা চাকরি হতো। সামান্য ক’টা টিউশনির টাকা, তার উপর অনেকগুলো ক্ষুধার্ত মুখ। মুখগুলো বলছে, রাখো তোমার লেখাপড়া। আগে আমাদের মুখে খাবার দাও। আমরা ক্ষুধার্ত। পরনে কাপড় দাও। নয়তো পৃথিবী লজ্জা পাবে।
তখন সমাজ ধিক্কার দেবে আমাকে। বলবে ছেলে তো লাট সাহেব। ডিগ্রি পাস করে ঘুরছে আর মা বাবা উপোষ করে মরছে, এমন ছেলে বেঁচে থাকার চেয়ে মরে যাওয়াই ভালো। ছি! ছি!! ছি!!!
ঠিক আছে আমি দেখবো বলে এম.ডি সাহেব আশ্বাস দিলেন। তবুও খুশি হলাম। আদাব কিংবা নমস্কার বলিনি। বললাম থ্যাংক ইউ স্যার। মিনতি করে বলতে চাইলাম, স্যার আমার একটা চাকরির খুব দরকার। বলা হলো না। বেরিয়ে আসতেই আর একগাল ধোঁয়া ছাড়লেন এম.ডি সাহেব। বিষাক্ত ধোঁয়াটা যেন আমাকে বার বার বলছে তুমি অপেক্ষা করো, তুমি অপেক্ষা করো।
রাস্তায় এসে দাঁড়ালাম।
বাসের অপেক্ষা। ভাবছি ইংরেজিটা কিভাবে রপ্ত করা যায়। একজন আমার হাত ধরলেন। বুড়ো লোক। বয়স কত হতে পারে। কী করে বলবো? ক্ষুধার্ত মানুষের বয়স অনুমান করা মুশকিল। পঞ্চাশ না পেরুতেই ওরা পৌঁছে যায় বার্ধ্যক্যের শেষ সীমানায়। ক্ষুধা, শুধু ক্ষুধার জন্য। তবে বয়সটা থাক। ভালো করে থাকালাম। আধা পাকা সাদা কালো চুল দাঁড়ি। গায়ে ছেড়া ময়লা ফতোয়া। পরনে ছেড়া লুঙ্গি। চোখদুটো সাদা ঘোলাটে। কর্দমাক্ত ঘোলাজলের মত। অনবরত জল আর কেতুর গড়িয়ে পড়ছে চোখ থেকে। বাম হাতে চোখটা মুছে নিল।
প্রথমেই সম্বোধন করল, মাই ডিয়ার সান, আই এ্যাম এ পুওর ম্যান..তারপর অনর্গল বলে যেতে লাগলো ইংরেজি। সঠিক এবং স্পষ্ট উচ্চারণ। বুঝতে একটুও বেগ পেতে হয়নি। বাকপটুতা দেখে আমি মুগ্ধ হলাম। শ্রদ্ধায় মাথা অবনত হয়ে গেল। বুঝলাম চোখের অপারেশন করাতে হবে। অনেকক্ষণ কথা বলল। মাঝে মাঝে চোখ মুছে নিচ্ছে।
আমি অনেক কিছুই বুঝলাম। শিক্ষিত লোক। আমার জন্মেরও আগে ডিগ্রি পাস করেছে ফার্স্ট ডিভিশনে। আজ এই অবস্থা। বুঝলাম গরীব মানুষ। ভিক্ষা চাইছে। আমিও গরীব মানুষ। দু’টাকা দিয়ে দিলেই লেটা চুকে যেত। পারলাম না। ইতিমধ্যে আমার গাড়ি এসে গেছে। উঠতে পারলাম না। আমার গ্রাজুয়েশন ভিক্ষুক হয়ে রইলো। উনার কথা মত আমার ভাবতে হচ্ছে আই কান্ট আন্ডারস্ট্যান্ড দিজ কোয়েশ্চান..। মাথা নত হলো। লজ্জিত হলাম। এম.ডি সাহেবের কথা মনে হলো। ভাবলাম এই লোকটি তো ভালো ইংরেজি জানে। নিয়ে গেলে কেমন হয়।
কিন্তু তা হবে কেন? দারোয়ান ঢুকতে দিলে তো। না জানি আবার আমাকেও গলা ধাক্কা খেতে হয়। আর সাহেব বসতেই বা দেবেন কেন। লোকটির পোশাক নেই। আয় থাকলে পোশাক থাকতো। কাজ করার ক্ষমতা থাকতো। চোখের দৃষ্টিও থাকতো। বিনা চিকিৎসায় দৃষ্টিশক্তি হারাতে হতো না।
খুশী হলাম এই ভেবে যে আমার পরিপাটি পোশাক ছিল। ইংরেজি জানা ছিল না। তবুও সাহেবের সামনে বসার যোগ্যতা পেয়েছি। একি কম সুখের কথা। এই লোকটির কাছে আমার যোগ্যতা অথৈ সমুদ্রে বালি ছিটা দেবার মত। শুধু অবাক বিস্ময়ে তাকিয়েছিলাম।
পুর্বেই বলেছি ইংরেজি জ্ঞান আমার সীমিত। ফলে ভাষা আন্দোলনের রেশ টানতে চাই না। সর্বত্র বাংলা ভাষা নাই বা চালু হল, একুশে ফেব্রুয়ারি কিংবা ৮ই ফাল্গুন তো মিথ্যা নয়। এতক্ষণ ধরে জীবনের এক বিচিত্র কাহিনী ইংরেজিতে শুনেছি। এবার বাংলায় ফিরে এলাম। জিজ্ঞাসা কললাম-
– আপনার বাড়ি?
– এবার স্পষ্ট বাংলায় বললেন, রাউজান কোয়েপাড়া। মেজ চাচা চেয়ারম্যান ছিলেন। এখনও চেয়ারম্যান বাড়ি বললে সবাই চেনে। বি.এ পাস করেছেন ১৯৬০ সালে। কথার ফাঁকে ফাঁকে ইংরেজি বললেন। ইন দ্যা ইয়ার নাইনটিন ফিফটি টু, আই ওয়াজ ইন ক্লাস সেভেন। ২১ শে ফেব্রুয়ারি রাতে শুনলাম আমার ভাইয়েরা মাতৃভাষার জন্য শহীদ হয়েছেন। ২২ তারিখে আমরা কয়েকজন মিলে স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে স্কুলে মিছিল করেছি। স্লোগান দিয়েছি “রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই”। লোকটি ডান হাতটা উঁচু করে ধরলেন। আরেকবার স্লোগান দিলেন। জয়বাংলা।
ইন দ্যা ইয়ার ১৯৭১ আমি যুদ্ধ করেছি। আমাদের গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া কর্ণফুলির পাড়ে ছিল আমাদের আস্তানা। এই রাউজানের নোয়াপাড়া গ্রামে বিপ্লবী মাষ্টারদা সুর্যসেনের জন্ম। আমার পাশ্ববর্তী গ্রাম। আমি জীবনে একবার উনাকে দেখেছি আর পা ছুঁয়ে সালাম করে পায়ের ধুলো মাথায় নিয়েছি। এ যে আমার জীবনে কতবড় পাওয়া আমি বুঝাতে পারব না। বিলিভ মি মাই সান আমি এখনও স্বপ্ন দেখি আরেকবার মাষ্টারদা’র পায়ে হাত দিয়ে তাঁর পায়ের ধুলো নেবো।
অনর্গল কথার ফাঁকে ফাঁকে বাংলা ইংরেজি মিলিয়ে কথা বলাটা বোধ হয় অভ্যাস হয়ে গেছে। কিংবা হয়তো আমার মত অর্ধশিক্ষিত, অথবা সুশিক্ষিত বা স্ব-শিক্ষিত কোনো ভদ্রলোকদের সামনে হয়তো এভাবে ইংরেজিতে বলেন। যাতে একটু দয়া হয়। দু’চার আনা বেশি পাবার আশায়। সবশেষে বললেন, রিমেমভার মাই সান, পেন ইজ মাইটার দ্যান শোর্ড। আবার চোখ মুছলেন।
আমার মতিভ্রম হলো। মাথাটা ঝিম ঝিম করছে। একবার পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করতে চাইলাম। পারলাম না। আত্ম অহংকারটা বড় বেশি। তাছাড়া লোকে কী বলবে। ডান হাতটা চলে গেলো বুক পকেটে। আবার শূন্য হাতটা ফিরে এলো। একজন অক্ষম ভিক্ষুককে করুণা করা যায়। সাহায্য করা যায়। কিন্তু একজন জ্ঞানীকে সাহায্য কিংবা করুণা কোনটায় করা যায় না। এতে নিজেকে ছোট করা হয়। অত্যন্ত হীন বলে নিজেকে ধিক্কার দেওয়া হয়।
করুণা কিংবা সাহায্যের পথ বন্ধ হলে কর্তব্যের দুয়ার খুলে যায়। আমি ক্ষুধার্ত মুখগুলির অংশ থেকে বৃদ্ধ লোকটির প্রতি সামান্য কর্তব্য পালন করলাম। বলতে পারেন দায়সারা গোছের। কারণ লোকটির সাথে দেখা না হলে আমার কখনও ভ্রম হতো না যে, লোকটি আসলে কে। ভিক্ষুক না জ্ঞানী ? বিপ্লবী না মুক্তিযোদ্ধা ? আবার জ্ঞানী না ভিক্ষুক ? এখনও হয়তো ভাবছি।
আমার আজও ভ্রম হয়। একজন মানুষ হিসাবে আর একজন মানুষের করণীয় কি কিছুই থাকতে পারে না? থাকলে ভালো হতো। পৃথিবীটা আরও সুন্দর হতো। দয়া আর করুণা দিয়ে কোন মানুষকে খাটো করা হতো না। কেননা আমরা সবাই মানুষ।
লোকটি অত্যন্ত আনন্দের সাথে আমার কর্তব্যের প্রতি সম্মান দেখিয়ে সামনে এগিয়ে গেলেন। পাশ দিয়ে বাসটা এগিয়ে যেতেই কন্ডাকটর চেঁচিয়ে উঠলেন-ঐ ব্যাটা পাগল–সর্‌–সর্‌।

পূর্ববর্তী নিবন্ধমুঘল শাহজাদা দারাশিকোহর করুণ আখ্যান
পরবর্তী নিবন্ধডাইল হিরি