টেকসই উন্নয়নে নৌপথকে যথাযথ গুরুত্ব দিতে হবে

রেজাউল করিম স্বপন | মঙ্গলবার , ৩১ জানুয়ারি, ২০২৩ at ৫:৪৪ পূর্বাহ্ণ

মানুষ সমাজবদ্ধ হয়ে বসবাস করার সময় থেকে জীবন জীবিকা, ব্যবসা বাণিজ্য ও দৈনন্দিন পানির প্রয়োজনে লেক, নদী বা সাগরের কাছাকাছি বসতি স্থাপন শুরু করে। তখন বিশ্বের বেশিরভাগ দেশে রাস্তা ঘাট না থাকায় যাতায়াত ও পণ্য পরিবহন ব্যবস্থা ছিলো সাগর বা নদী কেন্দ্রিক। মানুষ প্রাকৃতিক উৎসের পানি ব্যবহার করে গৃহস্থালি, দৈনন্দিন প্রয়োজন, খাদ্যশস্য উৎপাদন, কম খরচে ও পরিবেশ বান্ধব ব্যবস্থায় যাতায়াত ও পণ্য পরিবহন করতো। সে জন্য বিশ্বের অন্যান্য দেশের মত বাংলাদেশের প্রধান প্রধান হাট, বাজার, নগর, শহর ও বাণিজ্যিক কেন্দ্রগুলো নদী ও সাগরের অববাহিকায় গড়ে উঠে। তখন নদীতে প্রত্যহ জোয়ার ভাটা হতো। নদীর পানি দিয়ে মানুষ গৃহস্থালি থেকে শুরু করে চাষাবাদ পর্যন্ত সবকিছু করতো। নদীপথগুলো ছিলো দেশের প্রধান চলাচলের রুট। মানুষের চলাচল ও পণ্য পরিবহন হতো নৌকা ও জাহজের মাধ্যমে। কিন্তু কালের বিবর্তনে বিশেষ করে স্বাধীনতার পর দেশের নদীগুলোতে বাধ, স্লুইস গেট, অবৈধ দখল, অপরিকল্পিত নগরায়ন ও অদূরদর্শী পদক্ষেপের ফলে প্রায় সব নদী আজ মৃতপ্রায়। নদীগুলোর নাব্যতা হ্রাস ও স্রোতধারা ক্ষীণ হওয়ায় পানির ধারণ ক্ষমতা কমে যায়। দেশের অভ্যন্তরে অবস্থিত প্রায় প্রতিটি নদী ময়লা আবর্জনার ভাগাড়ে পরিণত হয়। ফলে অতি অল্প বৃষ্টিতে দেশের নদ নদীগুলোর পানি উপচে শহর নগর গ্রামাঞ্চল প্লাবিত হয়। বিভিন্ন নৌ কেন্দ্রিক হাট, বাজার ও শহরে নৌ রুট বন্ধ হওয়ায় সেগুলোর জৌলুস হারিয়ে ফেলে। একটু খেয়াল করলে দেখা যায়, দেশের পুরানো হাট বাজার ও গঞ্জগুলো আজ পরিত্যক্ত হওয়ার পথে। কোথাও কোথাও নদীর ক্ষীণধারা ও পানির প্রবাহ দেখে বুঝার উপায় নেই, এক সময় এইসব নদী দিয়ে বড় বড় নৌকা ও জাহাজ চলাচল করতো। নৌপথগুলো অকার্যকর হয়ে পড়ায় সড়কপথে প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি হয়।

এক সময় দেশে প্রায় ২৪ হাজার কিলোমিটার নৌপথ ছিল। বর্তমানে আছে মাত্র সাড়ে ছয় হাজার কিলোমিটার নৌপথ। তবে নৌরুট কমা বা নদীর নাব্যতা কমার পিছনে সরকারেরও দায় রয়েছে। তার প্রমাণ পাওয়া যায় সমপ্রতি প্রকাশিত বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) এর এক জরিপে। তারা দেশের প্রধান প্রধান নদীর উপর নির্মিত ৯৯টি সেতুর ওপর জরিপ চালিয়ে দেখেছে ৮৫টি সেতুর উচ্চতা কম। সেতুগুলো নিচু হওয়ায় বর্ষা মৌসুমে এসব সেতুর নিচ দিয়ে বড় নৌযান চলাচল করতে পারে না। ফলে বর্ষা মৌসুমে এসব নৌরুট কার্যত অকার্যকর হয়ে পড়ে। অথচ সাশ্রয়ী ও পরিবেশের জন্য কম ক্ষতিকর যোগাযোগ মাধ্যম হিসেবে গণ্য করা হয় নৌপথকে। গত কয়েক দশকে দেশের নৌপথের উন্নয়নে তেমন গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। কম উচ্চতার সেতু নির্মাণ করে নৌপথগুলোকে অকেজো করে দেওয়া হয়েছে। শুধু নৌপথ অকেজো নয়, সেতুর পিলারের কারণে প্রতিটি নদীতে পলি জমে চর জেগে উঠেছে। কোথাও নদীর গতিপথ পরিবর্তন হয়ে গেছে। আবার কোথাও নদী মরে ডোবার মত হয়ে যাচ্ছে। বিআইডব্লিউটিএর ঐ জরিপে দেখা যায়, ঢাকার চারপাশের নদীগুলো ছাড়াও পদ্মা, মেঘনা, ভৈরব, গোমতী, কুশিয়ারা ও তিতাসের মতো দেশের প্রধান প্রধান নদীতেও কম উচ্চতার সেতু নির্মাণ করা হয়েছে।

যেমন সিলেট বিভাগের কুশিয়ারা নদীর ওপর নির্মিত ৫টি সেতুর প্রতিটির উচ্চতাই কম। কুশিয়ারা নদীর মৌলভীবাজার অংশে নির্মাণ করা শেরপুর সেতুর উচ্চতা হওয়ার কথা ১২ দশমিক ২০ মিটার। কিন্তু সেতুটির উচ্চতা ৭ দশমিক ৮১ মিটার। পদ্মা নদীর ওপর নির্মিত লালন শাহ সেতু, মেঘনা নদীর ওপর নির্মিত কামারগাঁও সেতু, ভৈরব রেলসেতু ১ ও ২, গোমতী নদীর ওপর নির্মিত দাউদকান্দি সেতু এবং তিতাস নদীর ওপর নির্মিত হোমনা ও রামকৃষ্ণপুর সেতুর উচ্চতা নির্ধারিত মানদণ্ডের চেয়ে কম। ঢাকার চারপাশের নদী ও খালের মধ্যে ধলেশ্বরীতে ১০টি, বুড়িগঙ্গায় ২টি, তুরাগে ৫টি, টঙ্গী খালে ১০টি, বালু নদে ৫টি ও শীতলক্ষ্যায় ৪টিসহ মোট ৩৬টি সেতু নিয়েও জরিপ করে বিআইডব্লিউটিএ। এর মধ্যে বুড়িগঙ্গা নদীর ২টি, শীতলক্ষ্যা নদীর ৩টি এবং ধলেশ্বরীতে মাত্র ১টি সেতু সঠিক উচ্চতায় নির্মাণ করা হয়েছে, বাকী ৩০টির উচ্চতা কম। কম উচ্চতার সেতুর কারণে ঢাকার চারপাশ ঘিরে বৃত্তাকার নৌপথ চালু করা যায়নি। অথচ এই নৌরুটটি চালু করা গেলে দ্রুত, কম সময় ও খরচে মানুষ যাতায়াত করতে পারতো। এ নৌপথের দৈর্ঘ্য ১১০ কিলোমিটার। জরিপে পাওয়া সবচেয়ে কম উচ্চতার সেতুটি হলো তুরাগ নদের ওপর নির্মিত বীর মুক্তিযোদ্ধা আলহাজ এম এ মাজেদ সেতু (আশুলিয়া সেতু)। সেতুটির উচ্চতা শূন্য দশমিক ৬৭ মিটার। অথচ এর উচ্চতা হওয়ার প্রয়োজন ছিল ৭ দশমিক ৬২ মিটার। সেতুটি নির্মাণ করেছে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর। তবে এটির উচ্চতা কম হওয়ায় আপত্তি জানিয়েছিল বিআইডব্লিউটিএ, কিন্তু সেটি আমলে নেওয়া হয়নি। সংশ্লিষ্ট অধিদপ্তরের প্রকৌশলীরা বলেন, ১৯৮৮ সালের দিকে সেতুটি নির্মাণ করা হয়। ঢাকাআশুলিয়া উড়াল সড়ক নির্মাণের সময় সেতুটি ভেঙে ফেলা হবে।

শুধু যে আগের তৈরী করা সেতুগুলোর উচ্চতা কম তা নয়, বর্তমানে তুরাগ নদের ওপর নির্মাণাধীন টঙ্গী রেলওয়ে সেতুর উচ্চতাও কম। টঙ্গীতে কম উচ্চতায় রেলওয়ে সেতুর নির্মাণের বিষয়ে রেলওয়ের কর্মকর্তাদের ব্যাখ্যা হলো, সেতুর উচ্চতা বাড়াতে হলে পুরো রেললাইনের উচ্চতা বাড়াতে হবে। না হলে উঁচু সেতু দিয়ে ট্রেন চলতে পারবে না।

শুধু জরিপকৃত সেতুগুলো নয় দেশের প্রায় সব নদী নালা খাল কালভার্টের উপর নির্মিত সেতুর অবস্থা একই। বিআইডব্লিউটিএর তথ্য অনুযায়ী, এসব কম উচ্চতার সেতু নির্মাণ করেছে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর (সওজ), স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি), বাংলাদেশ রেলওয়ের মতো সরকারি সংস্থাগুলোই। এমনকি এখনো কম উচ্চতায় সেতু নির্মাণ চলছে। যেমন সমপ্রতি টঙ্গীতে তুরাগ নদের ওপর পুরোনো কামারপাড়া সেতুর পাশে সওজএর আরেকটি সেতু নির্মাণ করেছে, যেটি কম উচ্চতার। বিআইডব্লিউটিএর পক্ষ থেকে উচ্চতা নিয়ে আপত্তি জানানোর পরও তা আমলে নেওয়া হয়নি। ফলে দিন দিন কমছে নৌরুট এবং এতে অকার্যকর হয়ে পড়ছে নৌপথগুলো।

অন্যদিকে নদীগুলোর পানি প্রবাহ, নাব্যতা ও পানির ধারণ ক্ষমতা পর্যাপ্ত না হলে দেশে সুপেয় পানিসহ গৃহস্থালি কাজ ও শিল্প প্রতিষ্ঠানে ব্যবহারের জন্য পানির ক্রাইসিস হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। সে ক্ষেত্রে সারফেজ ওয়াটারের পরিবর্তে অত্যধিক ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলন করলে দেশে অদূর ভবিষ্যতে ভূমিধস সহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও ভুমিকম্পে ভয়াবহ অবস্থা হবে, এটি নিশ্চিত। সেজন্য বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ভূগর্ভস্থ পানির চেয়ে সারফেজ ওয়াটার ব্যবহারে বেশি মনোযোগী। তারা নতুন নতুন খাল জলাধার লেক খনন ও পুরানো নদী লেক খাল বিল জলাশয় ইত্যাদি খনন করে পানির ধারণ ক্ষমতা বাড়িয়ে চলেছে। তবে এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম হলো আমাদের দেশ। আমরা প্রাকৃতিক ভাবে সৃষ্ট জলাধার, জলাশয়, নদী, নালা, লেকগুলোও রক্ষা করতে পারছি না। যা সত্যি হতাশা ও দুঃখজনক।

বিশ্বে সাশ্রয়ী ও পরিবেশের জন্য কম ক্ষতিকর যোগাযোগ মাধ্যম হিসেবে গণ্য করা হয় নৌপথকে। অথচ আমাদের দেশে কয়েক দশক ধরে নদী ও নৌপথের উন্নয়নে যেমন গুরুত্ব দেওয়া হয়নি, তেমনি কম উচ্চতার সেতু নির্মাণ করে নৌপথকে অকেজো করে দেওয়া হয়েছে। একই পণ্য সড়ক পথের তুলনায় তিন ভাগের এক ভাগ খরচে নৌপথে পরিবহন করা যায়। মনে রাখতে হবে, টেকসই উন্নয়নে সারা বিশ্বেই সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পায় নৌপথ, এরপর রেলপথ ও সড়ক পথ। আর আমাদের দেশে নৌপথ সবচেয়ে বেশি অবহেলিত।

লেখক : প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট।

পূর্ববর্তী নিবন্ধসবুজ বনায়নে লায়ন মো. হাকিম আলী
পরবর্তী নিবন্ধভূগোলের গোল