জুম্‌’আর খুতবা

অধ্যক্ষ মাওলানা মুহাম্মদ বদিউল আলম রিজভি | শুক্রবার , ৫ মার্চ, ২০২১ at ৫:২৭ পূর্বাহ্ণ

কুরআন ও হাদীসের আলোকে মিরাজুন্নবী
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র গুরুত্ব
পবিত্র কুরআনের আলোকে মি’রাজ: মহামহিম স্রষ্টা আল্লাহ তা’আলা তাঁর সৃষ্টিরাজির অসংখ্য কুদরতী নিদর্শনাদী অবলোকন করানোর জন্য সর্বোপরি সপ্ত আসমান পরিভ্রমণ, জান্নাত জাহান্নাম পরিদর্শন, সিদরাতুল মুনতাহায় অবতরণ। একান্ত সান্নিধ্যে প্রিয় মাহবুবের সাথে কথোপকথন সরাসরি প্রিয় হাবীবকে দীদার দানে ধন্য করার জন্য মিরাজ দান করেছেন। আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেছেন, “পবিত্রতা মহান সত্তার যিনি তাঁর প্রিয় বান্দাকে রাতের একাংশে মসজিদে হারাম থেকে মসজিদে আকসা পর্যন্ত পরিভ্রমণ করালেন যে মসজিদে আকসার চতুষ্পর্শে আমি বরকতময় করেছি। (এই ভ্রমণের উদ্দেশ্য হলো) আমি আমার কুদরতের নিদর্শনাদি তাঁকে দেখাতে নিশ্চয় তিনি সর্বশ্রোতা সর্বদ্রষ্টা।” (আল কুরআন, সূরা: বনী ইসরাঈল, আয়াত: ১)
মিরাজ’এর সংজ্ঞা: মিরাজ শব্দটি “উরূজুন” শব্দ থেকে নির্গত, এর অর্থ ঊর্ধ্বে আরোহণের যন্ত্র বিশেষ বা সিঁড়ি। ইসলামী শরীয়তের পরিভাষায়, “আল্লাহর ইচ্ছায় তাঁর সান্নিধ্যে উর্ধ্বাকাশে পরিভ্রমণের নাম মিরাজ। ইমাম আবু জাফর ত্বাহাবী (র.) বর্ণনা করেন, মিরাজ সত্য, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে রজনীতে ভ্রমণ করানো হয়েছিল, তাঁকে শারীরিক ভাবে জাগ্রত অবস্থায় আকাশ পানে ঊর্ধ্বারোহণ করা হয়েছিল। অত:পর ঊর্ধ্ব জগতের যেথায় আল্লাহ নিয়ে যেতে ইচ্ছা করেছিলেন সেখানে তাঁকে নিয়ে গেছেন। আল্লাহ তাঁকে যা দিয়ে সম্মান জানাতে চেয়েছেন তা দিয়ে সম্মান করেছেন এবং তাঁর প্রতি যা ওহী করার তা ওহী করেছেন। (আল আক্বিদাতুত ত্বাহাবীয়া, পৃ: ১৫২)
মিরাজ ছিল জাগ্রতাবস্থায় সশরীরে:
মিরাজ অস্বীকার কারীদের মতে ঊর্ধ্বজগতে পরিভ্রমণ ও মূহর্তের মধ্যে ফিরে আসাটা ছিল অসম্ভব ও অবিশ্বাস্য। যিনি স্রষ্টা তিনি সকল প্রকার অপারগতা অক্ষমতা ও দুর্বলতা থেকে পুত:পবিত্র সত্তা। নবীজির জন্য বিস্ময়কর সফর মিরাজের ঘটনা বর্ণনার সূচনাতে “সুবহানা” শব্দের উল্লেখ করে অভিযোগকারীদের জবাব দিয়েছেন। “আসরা” শব্দ উল্লেখ করে দৈহিকভাবে রাত্রিকালীন ভ্রমণকে বুঝানো হয়েছে। “আসরা” শব্দের ব্যবহার শারীরিক ভাবে জাগ্রতাবস্থায় মিরাজ সংগঠিত হওয়ার প্রমাণ বহন করে।
মিরাজের সূচনা, সন, মাস, তারিখ:
হযরত ইবনে হাজর (র.)’র বর্ণনা মতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত উম্মে হানী (রা.)’র গৃহ থেকে মিরাজের যাত্রা সূচনা করেন। (সীরতে হালভী, পৃ: ৪০৫, তাফসীরে ইবনে কাসীর, খন্ড ২, পৃ: ২৫৪)
সোমবার রজনীতে মিরাজ হয়েছে, সোমবারে নবীজি পৃথিবীতে শুভাগমন, সোমবার ওফাত বরণ সোমবারে নবুওয়াতের ঘোষণা, সোমবারে মক্কা থেকে মদীনায় হিজরত, সোমবারেই মদীনা মুনাওয়ারায় প্রবেশ করেন। (সিরতে হালভী, পৃ: ৪০৫)
মিরাজের সন সম্পর্কে সহীহ বুখারী শরীফের ব্যাখ্যাগ্রন্থ “ফাতহুল বারী” এর বর্ণনামতে মিরাজের সন নির্ণয়ে দশটি মত পাওয়া যায়। ১. হিজরতের ছয় মাস পূর্বে, ২. হিজরতের আট মাস পূর্বে, ৩. হিজরতের এক বছর পূর্বে, ৪. হিজরতের এগার মাস পূর্বে, ৫. হিজরতের এক বছর দু’মাস পূর্বে, ৬. হিজরতের এক বছর তিন মাস পূর্বে, ৭. হিজরতের এক বছর পাঁচ মাস পূর্বে, ৮. হিজরতের এক বছর নয় মাস পূর্বে, ৯. হিজরতের তিন বছর পূর্বে, ১০. হিজরতের পাঁচ বছর পূর্বে। বিশুদ্ধতম মতানুসারে নবুওয়তের দশম সনের পর একাদশ সনে মিরাজ সংঘটিত হয়েছে। (সীরাতুল মুস্তফা, ১ম খন্ড, পৃ: ২৮৭), প্রসিদ্ধমতানুসারে ২৭ শে রজব সোমবার রজনীতে মিরাজ সংঘটিত। এটা সর্বাধিক উল্লেখযোগ্য ও বিশুদ্ধমত। (মিরাজুন্নবী কৃত: আল্লামা আহমদ সাঈদ কাযেমী (র.), রুহুল বয়ান, খন্ড ৫, পৃ: ১০৩)
লায়লাতুল মিরাজের ইবাদত:
হযরত আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, রজবের সাতাশতম রজনীতে ঈবাদতকারীকে আল্লাহ তা’আলা একশত বৎসর ইবাদত করার সমতুল্য সওয়াব দান করবেন। এ রাতে বার রাকাত নফল নামায পড়বেন প্রতি রাকাতে সূরা ফাতেহার পর যে কোন সূরা পাঠ করে দু’রাকাত পর পর তাশাহুদ ও দরুদ পাঠের পর সালাম ফিরাবেন, এভাবে বার রাকাত পড়ার পর একশত বার কলেমা তামজীদ অত:পর ইস্তিগফার “আস্তাগফিরুল্লাহ’ ও একশতবার দরুদ শরীফ পাঠ করবে। এবং পরদিন নফল রোজা রাখবে। নি:সন্দেহে আল্লাহ তাঁর সকল বৈধ প্রার্থনা কবুল করবেন। (এয়াহিয়াউল উলুম, খন্ড ২, পৃ: ৩৭৩, আনোয়ারুল বায়ান, খন্ড ২, পৃ: ৪৪৯)
মিরাজের ঘটনা:
হযরত আনাস বিন মালেক (রা.) থেকে বর্ণিত, প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, “আমার সম্মুখে বোরাক উপস্থিত করা হলো তা শ্বেত বর্ণের জন্তু। গাধার চেয়ে বড় ও খচ্চর অপেক্ষা ছোট, তার দৃষ্টি যতদূর যেতো সেখানো পা রাখতো, আমি বোরাকে আরোহণ করে বায়তুল মোকাদ্দাস পৌঁছি। অন্যান্য নবীগণ যেখানে বাহন বাঁধতেন আমিও সেখানে আমার বাহন বাঁধলাম। অত:পর আমি বায়তুল মোকাদ্দাস মসজিদে প্রবেশ করে দুরাকাত নামায আদায় করলাম, অত:পর মসজিদ হতে বেরিয়ে আসি, তখন জিবরাঈল (আ:) একটি শরাবের পাত্র ও একটি দুধের পাত্র নিয়ে আমার নিকট আসেন। আমি দুধের পাত্র গ্রহণ করলাম তখন জিবরাঈল (আ:) বললেন আপনি স্বভাবধর্ম ইসলাম গ্রহণ করেছেন, অত:পর হযরত জিবরাঈল (আ:) আমাকে নিয়ে ঊর্ধ্বাকাশে যাত্রা করেন। নিকটতম আসমানে পৌছে দরজা খুলতে বললেন, জিজ্ঞেস করা হয় আপনি কে? তিনি বললেন আমি জিবরাঈল (আ)। আবার জিজ্ঞেস করা হলো আপনার সাথে কে রয়েছেন? তিনি বললেন হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। পুনরায় জিজ্ঞেস করা হলো তাঁকে কী ডেকে পাঠানো হয়েছে? তিনি বললেন হ্যাঁ তারপর দরজা খুলে দেয়া হয়। আমি ভেতরে পৌঁছলে হযরত আদম (আ:) এর সাথে আমার সাক্ষাত হয় তিনি আমাকে স্বাগত জানান এবং আমার জন্য কল্যাণের দুআ করেন।
অত:পর দ্বিতীয় আসমানে প্রবেশ করলাম। সেখানে হযরত ঈসা (আ:) ও হযরত ইয়াহইয়া (আ:) কে দেখতে পেলাম তাঁরা উভয় আমাকে সম্ভাষণ জানান। অত:পর তৃতীয় আসমানে প্রবেশ করলাম সেখানে হযরত ইউসূফ (আ:) কে দেখতে পেলাম। তিনি আমাকে অভিনন্দন জ্ঞাপন করেন অত:পর জিবরাঈল (আ:) আমাকে নিয়ে চতুর্থ আসমানে উঠেন, সেখানে হযরত ইদ্রিস (আ:)’র সাথে সাক্ষাৎ হয়। তিনিও আমাকে স্বাগত জানান। অত:পর পঞ্চম আসমানে প্রবেশ করলাম সেখানে হযরত হারুন (আ:)’র সাথে সাক্ষাৎ হয়। তিনিও আমাকে অভিনন্দন জানিয়ে নেক দোয়া করেন। অত:পর জিবরাঈল (আ:) ষষ্ঠ আসমানে আমাকে সঙ্গে নিয়ে যান সেখানে মুসা (আ:) এর সাথে সাক্ষাৎ হয়, তিনিও আমাকে সাদর সম্ভাষণ জানান ও নেক দুয়া করেন। অত:পর সপ্তম আসমানে প্রবেশ করলাম সেখানে হযরত ইবরাহীম (আ:) কে দেখতে পেলাম। তিনি বায়তুল মামুরের সাথে হেলান দিয়ে বসে আছেন দৈনিক সত্তর হাজার ফিরিশতা সে গৃহে প্রবেশ করেন যারা একবার বের হয়ে যান তারা পূনরায় প্রবেশ করার সুযোগ পাননা। অত:পর জিবরাঈল (আ:) আমাকে সিদরাতুল মুনতাহার দিকে নিয়ে যান এমন একটি বৃক্ষ যার পাতাগুলো হাতির কানের মতো ফলগুলো মটকার মতো। উক্ত বৃক্ষের উপর আল্লাহর নূরের তজল্লী পতিত হয়। ( সহীহ মুসলিম শরীফ ১ম খন্ড, পৃ: ১৪৫)
সম্মানিত নবীগণের সাক্ষাৎ:
জিবরাঈল (আ:) বোরাক নিয়ে আগমন করলেন, প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বোরাকে আরোহণ করানো হল, দ্রুত গতিতে মসজিদে আকসায় নিয়ে যাওয়া হল, সেখানে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামার সম্মানার্থে সকল নবীগণ অপেক্ষামান, হযরত জিবরাঈল (আ:) আজান দিলেন ইমামুল আম্বিয়া প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইমামতি করলেন এবং দু’রাকাত নামাজ পড়ালেন। পুনরায় বোরাকে আরোহণ করে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর আকাশ ভ্রমণ শুরু হল।
প্রথম আকাশে হযরত আদম (আ:) এর সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়। দ্বিতীয় আকাশে হযরত ঈসা (আ:) ও হযরত ইয়াহিয়া (আ:) এর সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়। তৃতীয় আকাশে হযরত ইউছুফ (আ:) এর সঙ্গে, চতুর্থ আকাশে হযরত ইদরিস (আ:) এর, পঞ্চম আকাশে হযরত হারুন (আ:) এর, ষষ্ঠ আকাশে হযরত মুসা (আ:) এর এবং সপ্তম আকাশে হযরত ইব্রাহীম (আ:) এর সাথে সাক্ষাৎ হয়। এরপর প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সিদরাতুল মুনতাহার দিকে অগ্রসন হন। এরপর আরশে মুয়াল্লায় গমন করেন এবং আল্লাহ পাকের একান্ত সান্নিধ্য লাভে ধন্য হন। আল্লাহ পাক তাঁর প্রিয় হাবীবকে কি দিয়েছেন, নবীয়ে পাক কি নিয়েছেন আল্লাহ পাক কি বলেছেন, নবীয়ে পাক কি শুনেছেন, দাতা এবং গ্রহীতা হাবীব এবং মাহ্‌বুবই এর বাস্তব রহস্য সম্পর্কে অবগত। স্বয়ং কুরআন মজীদেও এ রহস্য উদঘাটন করা হয়নি। মিরাজই প্রিয়নবীর শ্রেষ্ঠত্ব ও সমুন্নত মর্যাদার পরিচায়ক। সর্বোপরি মেরাজ স্রষ্টার অপরিসীম ক্ষমতার বহিঃপ্রকাশ এবং বিশ্বনবী রাহমতুল্লীল আলামীনের শ্রেষ্ঠত্বের প্রতীক। আল্লাহপাক আমাদেরকে প্রিয় হাবীবের শ্রেষ্ঠত্ব অনুধাবনের তৌফিক দান করুন। আমিন বেহুরমতে সৈয়্যদিল মুরছালীন।
লেখক : অধ্যক্ষ, মাদরাসা-এ তৈয়্যবিয়া ইসলামিয়া সুন্নিয়া ফাযিল (ডিগ্রী),
বন্দর, চট্টগ্রাম, খতীব, কদম মোবারক শাহী জামে মসজিদ।

পূর্ববর্তী নিবন্ধজিনজিরায় তৈরি পণ্যের জন্য প্রয়োজন সরকারের আর্থিক ও নৈতিক সমর্থন
পরবর্তী নিবন্ধদুরের দুরবিনে