জিনজিরায় তৈরি পণ্যের জন্য প্রয়োজন সরকারের আর্থিক ও নৈতিক সমর্থন

রেজাউল করিম স্বপন | শুক্রবার , ৫ মার্চ, ২০২১ at ৫:২৫ পূর্বাহ্ণ

একসময় চায়না পণ্যের নাম শুনলে বিশ্বের সবদেশের মানুষ ভ্রু কুঁচকাতো। কালের বিবর্তনে সে অবস্থা আর নেই। গত কয়েক দশকে চায়না পৃথিবীর অন্যতম অর্থনৈতিক শক্তিতে পরিণত হয়েছে। বর্তমানে হেন কোনো পণ্য নেই যা তারা তৈরি করে না। আলপিন হতে শুরু করে যুদ্ধ বিমান, সাবমেরিন সবকিছুই তারা তৈরি করে এবং সেটা দেশ ও দাম ভেদে ভিন্ন ভিন্ন কোয়ালিটির। এক্ষেত্রে রাষ্ট্র তাদের ইন্ডাস্ট্রিকে সবচেয়ে বেশি সহযোগিতা করেছে। সেজন্য মেশিনারিজ বা তৈরী পণ্য তৈরির ক্ষেত্রে চায়না এখন বিশ্বে সবচেয়ে বেশি এগিয়ে। বলা হয়ে থাকে, আগামী দশকে চায়না হবে পৃথিবীর সেরা অর্থনৈতিক শক্তি এবং তারাই পৃথিবীকে ডোমিনেট করবে। চায়নার এই যে অভূতপূর্ব সাফল্য তার পিছনে রয়েছে রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতা। রাষ্ট্র তাদের কারখানাগুলোকে পৃষ্ঠপোষকতা করেছে বলেই চায়না আজ পৃথিবীর সর্ববৃহৎ অর্থনৈতিক শক্তি। বাংলাদেশেও এই ধরনের একটি এলাকা রয়েছে, যারা গত ৭০ বছরেরও অধিক সময় ধরে বিভিন্ন রকমের প্রকৌশল যন্ত্রপাতি তৈরি করে আসছে। পিঠ চুলকানির প্লাস্টিকের হাতল থেকে শুরু করে সমুদ্রগামী জাহাজ আবার প্লাস্টিকের বিভিন্ন পণ্য তৈরীর ছাঁচ কিংবা পাটকল বস্ত্র কলের ভারী যন্ত্রপাতি সবই এখানে তৈরী হয়। সেই জায়গাটি হচ্ছে ঢাকার জিনজিরা।
একসময় দেশে শিল্পের যন্ত্রপাতির জন্য পুরোপুরি বিদেশ নির্ভর ছিলো। বর্তমানে জিনজিরার কারিগরেরা কৃষি, খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ, তৈরি পোশাক, বস্ত্র, গাড়ি, রেলওয়েসহ বিভিন্ন খাতের যন্ত্র ও যন্ত্রাংশ তৈরি করে। কেবল যন্ত্রাংশ নয়, যন্ত্রাংশ তৈরীর মেশিনও তারা তৈরি করেন। বর্তমানে সারাদেশে ব্যবহৃত অধিকাংশ যন্ত্রাংশ হলো জিনজিরার তৈরি। যদিও এর কারিগরদের কোন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নেই এবং অনেক ক্ষেত্রে তারা একেবারেই নিরক্ষর। শুধু দেখে দেখে তারা হুবহু একই পণ্য তৈরি করে ফেলে যা সত্যি বিস্ময়কর। বলা যায় স্বাধীনতার পর থেকে তারা দেশের হালকা প্রকৌশল খাতে রীতিমতো বিল্পব ঘটিয়ে ফেলেছেন। ওখানকার কারিগরের দক্ষতা এমন পর্যায়ে পৌছেছে যে, শুধু স্যাম্পল বা ভিডিও দেখলেই, ঠিক হুবহু জিনিস বানিয়ে দিতে পারে।
১৯৪৭ এর দেশ বিভাগের পর থেকে ধোলাইখালে অবাঙালি উদ্যোক্তাদের মাধ্যমে প্রথম হালকা প্রকৌশল শিল্পের যাত্রা শুরু হয়। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর অনেক অবাঙালি দেশ ছেড়ে চলে গেলে কারখানাগুলোর হাল ধরেন স্থানীয় কারিগরেরা। তারাই পরে জিনজিরাসহ বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়ে। তখনই ‘মেড ইন জিনজিরা’ কথাটি চালু হয়েছিলো। তবে তা নেতিবাচক অর্থে, অর্থাৎ নকল ও মানহীন পণ্য মানেই মেড ইন জিনজিরা এমন প্রচারণা ছিলো। সময়ের সাথে সাথে এই সব কারিগরের নামের পাশে অলিখিতভাবে ইঞ্জিনিয়ার শব্দ যোগ হয়েছে।এই বিষয়ে এসএমই ফাউন্ডেশন সারাদেশে ১৭৭টি শিল্পগুচ্ছ(ক্লাস্টার) এলাকা চিহ্নিত করেছে। এর মধ্যে ধোলাইখাল গুচ্ছ এলাকা হলো লালবাগ, শ্যামপুর, গেন্ডারিয়া, সূত্রাপুর, পোস্তাগোলা, হাজারীবাগ, টিপু সুলতান রোডসহ আশেপাশের এলাকা। উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা ইউএসএআইডি ২০১৯ সালের এক সমীক্ষা অনুযায়ী, বাংলাদেশে হালকা প্রকৌশল শিল্পে বছরে প্রায় ২৬ হাজার কোটি টাকা লেনদেন হয় এবং এই খাতে কাজ করেন প্রায় আট লাখ মানুষ। এই শিল্পের ২০% কারখানা ঢাকায়। ধোলাইখালের বড় কারখানাগুলো মাসে ২৫-৩০ লাখ টাকা লেনদেন করে ও ছোট কারখানাগুলো করে ৪-৫ লাখ টাকা। তবে উদ্ভাবন, কর্মসংস্থান ও অর্থনৈতিক অবদানের তুলনায় ধোলাইখাল ও কেরানীগঞ্জের উদ্যোক্তরা সবসময় অবহেলিত। এদের কোন সরকারি সমর্থন ও সহায়তা নেই বললেই চলে। তবে যতটুকু জানা যায়, ১৯৮০ দশকে বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প কর্পোরেশন (বিসিক) ধোলাইখাল ও জিনজিরার হালকা প্রকৌশল শিল্পের উন্নয়ন ও সক্ষমতা বাড়াতে ৫ কোটি টাকার একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছিলো। মূলত তখনই দেশে জিনজিরার নাম ছড়িয়ে পড়ে। এরপরে ধোলাইখাল ও জিনজিরার মডেল সারা দেশে ছড়িয়ে দিতে আরো ১৫কোটি টাকা বরাদ্দ রেখে আরও একটি প্রকল্প হাতে নেয় বিসিক।যদিও তা আলোর মুখ দেখেনি। অন্যদিকে বাংলাদেশ শিল্প কারিগরি সহায়তা কেন্দ্র (বিটাক) হালকা প্রকৌশল শিল্পের উন্নয়নে টুল ইনস্টিটিউট স্থাপনের প্রকল্প নেয় ২০১৬ সালে। এই প্রকল্প নিয়ে টুল ইনস্টিটিউট প্রকল্পের পরিচালক বলেন, জিনজিরা ধোলাইখাল পণ্যের মান নিয়ে যেসব অপবাদ আছে, ইনস্টিটিউট পুরোদমে চালু হলে তা দূর করা যাবে। ইনস্টিটিউটে গবেষণা, উদ্ভাবন, নকশা তৈরির পাশাপাশি প্রশিক্ষণের উপর জোর দেওয়া হবে।এজন্য তেজগাঁওএ টুল ইনস্টিটিউটের ১০ তলা একটি ভবন তৈরি হচ্ছে। ইতিমধ্যে কয়েক তলা নিয়ে কাজ শুরু হয়েছে। যেখানে পণ্যের গুণগত মান পরীক্ষার সুযোগ পাবেন উদ্যোক্তারা। সেখানে সিএনসি যন্ত্র বসানো হয়েছে, যেখানে নিদিষ্ট ফি দিয়ে ব্যবহার করতে পারবে হালকা প্রকৌশল কারখানাগুলো।
অন্যদিকে বিশ্বব্যাংক ও জিনজিরা, ধোলাইখালের সম্ভাবনা নিয়ে কাজ করছে। এখন দরকার এসব এলাকাকে কেন্দ্র বা হাব তৈরি করে বিজনেস মডেল প্রতিষ্ঠা করা। এই জন্য প্রয়োজন সরকারের পূর্ণ সমর্থন। সরকার যদি এই এলাকার শিল্পের পর্যাপ্ত আর্থিক সমর্থন দেয়, তবে অদূর ভবিষ্যতে এই খান থেকে তৈরি পণ্য বিদেশে রপ্তানি করে দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করা সম্ভব। কারণ বিশ্বে হালকা প্রকৌশল শিল্পে এখানকার তৈরি পণ্য দামের দিক দিয়ে চায়না হতেও অনেক কম ও টেকসই। তাই সরকারকে এই এলাকার শিল্পের জন্য একটি থোক বরাদ্দ দিয়ে ক্রাস প্রোগ্রাম নেয়া উচিত। এ প্রসঙ্গে কয়েকটি আমদানিকৃত পণ্যের দাম তুলনা করা যায়। যেমন রিপিট তৈরির একটি স্বয়ংক্রিয় যন্ত্র জাপান হতে আমদানি করতে লাগে ১৬-১৭ লাখ টাকা।একই যন্ত্র চায়না হতে আমদানি করতে লাগে ১২ লাখ টাকা আর জিনজিরার একই যন্ত্র পাওয়া যায় মাত্র ২.৫-৩ লাখ টাকায়।
বর্তমানে সরকার রপ্তানিমুখী শিল্প স্থাপনের জন্য বিভিন্ন এলাকায় ইপিজেড ও ইকোনমিক জোন স্থাপন করছে। যাতে হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করছে। অথচ হাতের কাছে জিনজিরাকে নিয়ে তেমন কোন পরিকল্পনা চোখে পড়ছে না। তবে যদি বুয়েটের বিশেষজ্ঞদের নিয়ে এই এলাকার কারিগরদের সঠিক প্রশিক্ষণ ও দিক নির্দেশনা দেওয়া যায় এবং সরকার তাদের পর্যাপ্ত আর্থিক সহযোগিতা করে তবে অচিরেই জিনজিরা হতে পারে বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে বড় রপ্তানি এলাকা এবং এই এলাকার রপ্তানি যোগ্য মেশিনারিজের মাধ্যমে বিশ্বে বাংলাদেশ পরিণত হতে পারে একটি মেশিনারিজ রপ্তানি জাতিতে এবং এতে করে তারা তাদের তৈরী পণ্যের ব্যান্ডিং করে দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করতে পারবে। স্বাধীনতা পঞ্চাশ বছর পূর্তিতে সময় এসেছে এই এলাকাকে নিয়ে নতুন করে ভাবনার। সেই প্রত্যাশা আমরা করতেই পারি।
লেখক : প্রাবন্ধিক, সংগঠক

পূর্ববর্তী নিবন্ধবৈষম্য
পরবর্তী নিবন্ধজুম্‌’আর খুতবা