জুম্মার দিনের কিছু গুরুত্বপূর্ণ আমল ও বিশেষ ফজিলত

এস এম ফখরুল ইসলাম নোমানী (মোরশেদ) | শুক্রবার , ১০ সেপ্টেম্বর, ২০২১ at ৪:৫৯ পূর্বাহ্ণ

সপ্তাহের সেরা দিন শুক্রবার তথা জুম্মার দিন। এটি পৃথিবীর অন্যতম তাৎপর্যবহ দিবস। জুম্মা নামে পবিত্র কোরআনে একটি সূরা আছে। এইদিনে মহান আল্লাহতায়ালা জগৎ সৃষ্টির পূর্ণতা দান করেছিলেন। শুক্রবার দিনকে জুমার দিন বলা হয়। জুমা এটি আরবি শব্দ। বাংলায় এর আভিধানিক অর্থ একত্রিত হওয়া, সম্মিলিত হওয়া, কাতারবদ্ধ হওয়া ইত্যাদি। পরিভাষায় জুমা বলে, প্রতি সপ্তাহের শুক্রবার দিনে প্রাপ্তবয়স্ক মুসলমানরা একটি নির্দিষ্ট সময়ে মসজিদে একত্র হয়ে জামাতের সঙ্গে সেদিনের জোহর নামাজের পরিবর্তে যে নামাজ ফরজরূপে আদায় করে, সেই নামাজকে ‘জুমার নামাজ’ বলা হয়। হজরত আদম (আ.) ও হাওয়া (আ.)-কে এই দিনেই জান্নাতে একত্র করেছিলেন এবং এই দিনে মুসলিম উম্মাহ সাপ্তাহিক ঈদ ও ইবাদত উপলক্ষে মসজিদে একত্র হয় বলে দিনটাকে ইয়াওমুল জুমাআ বা জুমার দিন বলা হয়।
জুমার নামাজের গুরুত্ব :
শুক্রবারের দিন জোহরের নামাজের পরিবর্তে জুমার নামাজকে ফরজ করা হয়েছে। জুমার দুই রাকাত ফরজ নামাজ ও ইমামের খুতবাকে জোহরের চার রাকাত ফরজ নামাজের স্থলাভিষিক্ত করা হয়েছে। সপ্তাহের এদিনে জুমার খতিব উম্মতের যাবতীয় প্রয়োজনীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে কোরআন ও হাদিসের আলোকে নির্দেশনা ও সমাধানমূলক উপদেশ দেবেন তাঁর খুতবায়।
হজরত তারেক ইবনে শিহাব (রা.) থেকে একটি হাদিস বর্ণিত হয়েছে। তিনি বলেছেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ক্রীতদাস, মহিলা, নাবালেগ বাচ্চা ও অসুস্থ ব্যক্তি–এই চার প্রকার মানুষ ছাড়া সকল মুসলমানের ওপর জুমার নামাজ জামাতে আদায় করা অপরিহার্য কর্তব্য (ফরজ)।(আবু দাউদ : ১০৬৭, মুসতাদরেকে হাকেম : ১০৬২ , আস্‌-সুনানুল কাবীর : ৫৫৮৭)
হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে এ মর্মে হাদিস বর্ণিত হয়েছে যে রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, যে ব্যক্তি কোনো শরীয়তসম্মত কারণ ছাড়া জুমার নামাজ বর্জন করবে, তার নাম মুনাফিক হিসেবে এমন দপ্তরে লিপিবদ্ধ হবে, যা মুছে ফেলা হবে না এবং পরিবর্তন ও করা যাবে না। (তাফসিরে মাজহারি,খণ্ড: ৯ , পৃষ্ঠা : ২৮৩)
জুমার দিনের ফজিলতঃ
সাপ্তাহিক ঈদ হিসেবে জুমার দিনের ফজিলত অনেক বেশি। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) একটি হাদিস বর্ণনা করেছেন। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন: জুমার দিনে ফেরেশতাগণ বিশেষ রেজিস্টার নিয়ে মসজিদের প্রতিটি দরজায় দাঁড়িয়ে যান। তাঁরা মসজিদে আগমনকারী মুসল্লিদের নাম পর্যায়ক্রমে লিপিবদ্ধ করতে থাকেন। অতঃপর যখন ইমাম সাহেব এসে যান, তখন তারা রেজিস্টার বন্ধ করে খুতবা শুনতে থাকেন।
অন্যান্য নামাজ থেকে এ নামাজের ফজিলত অত্যধিক, মর্যাদাও সীমাহীন। এমনকি এই নামাজের কারণে এ দিনের সম্মান বেড়ে গেছে বহু গুণ। হাদিসে এসেছে এ দিনের শ্রেষ্ঠত্বের কথা। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত হয়েছে, যে সবার আগে মসজিদে প্রবেশ করে, সে একটি উট আল্লাহর রাস্তায় দান করার সওয়াব লাভ করে। যে দুই নম্বরে প্রবেশ করে, সে একটি গরু আল্লাহর রাস্তায় দান করার সওয়াব পায়। যে তিন নম্বরে প্রবেশ করে, সে একটি দুম্বা দান করার সওয়াব পায়। যে চার নম্বরে প্রবেশ করে, সে একটি মুরগি দান করার সওয়াব লাভ করে। আর যে পাঁচ নম্বরে প্রবেশ করে, সে একটি ডিম আল্লাহর রাস্তায় দান করার সওয়াব পায়। অতঃপর ইমাম যখন বের হয়ে এসে মিম্বরে বসেন খুতবার জন্য, তখন ফেরেশতারা লেখা বন্ধ করে খুতবা শুনতে বসে যান।-সহিহ বুখারি, হাদিস-নং ৮৮১।(মুসনাদে শাফী : ৬২,জামেলি ইবনেওহাব:২২৯,মুসনাদে হুমাইদি:৯৬৩ )
জুমাবারের ফজিলতের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দিকটি হলো, এই দিনে এমন একটা সময় আছে, যখন মুমিন বান্দা কোনো দোয়া করলে মহান আল্লাহ তাঁর দোয়া কবুল করেন। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে একটি হাদিস বর্ণিত হয়েছে। তিনি বলেছেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, জুমার দিনে একটা এমন সময় আছে, যে সময়ে কোনো মুমিন বান্দা আল্লাহর কাছে ভালো কোনো কিছু প্রার্থনা করলে, অবশ্যই আল্লাহ তাঁকে তা দান করবেন। (সহীহ মুসলিম : ৮৫২, মুসনাদে আহমাদ : ৭১৫১, আস্‌-সুনানুল কুবরা : ১০২৩৪)
চলুন জেনে নেওয়া যাক জুমার দিনের আরও বিশেষ কিছু আমল:
১. জুমার দিন ফজরের ফরজ নামাজে সুরা সাজদা ও সুরা দাহর/ইনসান তেলাওয়াত করা। ২. জুমার দিন ভালোভাবে গোসল করা। ৩. জুমার নামাজের জন্য আগেভাগে মসজিদে যাওয়া। ৪. শুক্রবার দিন সুরা কাহফ তেলাওয়াত করা। ৫. মসজিদে গিয়ে জুমার নামাজের আগে কমপক্ষে ৪ রাকাত সুন্নত আদায় করা। ৬. জুমার নামাজে ইমামের কাছাকাছি গিয়ে বসা। ৭. মনোযোগ দিয়ে খুতবা শোনা। খুতবা চলাকালে কোনো কথা না বলা। ৮.দুই খুতবার মাঝের সময়ে বেশি বেশি দোয়া করা এবং জুমার দিনের অন্য সময়ও দোয়া করা। কারণ এদিনে দোয়া কবুল হয়। ৯: জুমার নামাজের জন্য সুগন্ধি ব্যবহার করা। ১০: মিস্‌ওয়াক করা। ১১: উত্তম পোশাক পরিধান করে সাধ্যমতো সাজসজ্জা করা। ১২: মুসল্লিদের ইমামের দিকে মুখ করে বসা। ১৩: সম্ভব হলে পায়ে হেঁটে মসজিদে যাওয়া। ১৪: জুমার দিন ও জুমার রাতে বেশি বেশি দরুদ পাঠ করা। ১৫: নিজের সবকিছু চেয়ে এ দিন বেশি বেশি দোয়া করা।
অন্য একটি হাদিসে এসেছে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, যে ব্যক্তি জুমার দিন গোসল করল, আগে আগে মসজিদে গমন করল, হেঁটে মসজিদে গেল, ইমামের কাছাকাছি বসল, মনোযোগ দিয়ে খুতবা শুনল, কোনো কথা বলল না, আল্লাহ তায়ালা তাকে প্রতি কদমে এক বছরের নফল ইবাদতের সওয়াব দান করবেন। মুসনাদে আহমাদ, হাদিস-নং ৫৮১।
জুমার দিন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দিন। সপ্তাহের অন্যান্য দিনের তুলনায় জুমার দিনের ফজিলত বেশি। এই দিনের মধ্যে আল্লাহ রব্বুল আলামিন বিশেষ কিছু সওয়াব নিহিত রেখেছেন। তাই এই দিনে রয়েছে বিশেষ কিছু আমল। যাতে রয়েছে আল্লাহর পক্ষ থেকে গুনাহ মাফের সুযোগ।
জুমার দিনের একটি গুরুত্বপূর্ণ আমল সম্পর্কে হাদিসে এসেছে। হজরত আবু হুরাইরা (রা.) হতে বর্ণিত। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, যে ব্যক্তি জুমার দিন আসরের নামাজের পর না উঠে ওই স্থানে বসা অবস্থায় ৮০ বার নিম্নে উল্লেখিত দরুদ শরীফ পাঠ করবে, তার ৮০ বছরের গুনাহ মাফ হবে এবং ৮০ বছরের নফল ইবাদতের সওয়াব তার আমল নামায় লেখা হবে। দোয়াটি হলো- ‘আল্লাহুম্মা সাল্লি আলা মুহাম্মাদিনিন নাবিয়্যিল উম্মিয়্যি ওয়া আলা আলিহি ওয়াসাল্লিম তাসলিমা’। জুমার দিনের আরো কিছু আমলের মধ্যে রয়েছে, সুরা কাহাফ তিলাওয়াত করা। হাদিসে এসেছে, জুমার দিনে সুরা কাহফ তিলাওয়াত করলে কিয়ামতের দিন আকাশতুল্য একটি নূর প্রকাশ পাব। আল্লাহর হাবীবের শানের উপর বেশী বেশী দরুদ শরীফ পাঠ করি আল্লাহতায়ালা পেয়ারাহাবীবের মহব্বতের ফয়েজ আমাদের সকলের হৃদয়ে আসুক। আল্লাহ তায়ালা আমাদের সবাইকে আমল করার, জুমার দিনের হক আদায় করার তাওফিক দান করেন, আমিন।
লেখক : হেড অব ফাইন্যান্স এন্ড একাউন্টস, এপিক হেলথ কেয়ার লিমিটেড

পূর্ববর্তী নিবন্ধমানুষ জন্মও নেয় একা, মৃত্যুতেও একা
পরবর্তী নিবন্ধজুম্’আর খুতবা