জুম্’আর খুতবা

অধ্যক্ষ মাওলানা মুহাম্মদ বদিউল আলম রিজভি | শুক্রবার , ৫ নভেম্বর, ২০২১ at ৯:৩৩ পূর্বাহ্ণ

সূরা কাউসার’র ফযিলত ও বৈশিষ্ট্য

সূরা কাউসার’র পরিচিতি:
অধিকাংশ তাফসীরকারদের বর্ণনা মতে সূরাটি মাদানী, কেউ কেউ মক্কী সূরা বলে মত প্রকাশ করেছেন। এ সূরায় রুকুর সংখ্যা এক, আয়াত সংখ্যা তিন, শব্দ দশটি, বর্ণ সংখ্যা বিয়াল্লিশটি। অর্থ: (আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেছেন) ১. হে মাহবুব! নিশ্চয় আমি আপনাকে অসংখ্য গুণাবলী দান করেছি। ২. সূতরাং আপনি আপনার প্রতিপালকের জন্য নামায পড়ুন এবং কোরবানী করুন। ৩. নিশ্চয় যে আপনার শক্র সে-ই সকল কল্যাণ থেকে বঞ্চিত। (সূরা: ১০৮ কাউসার, আয়াত:৩, তরজমা: কানযুল ঈমান)
সূরার আলোচ্য বিষয়: ১. হাউজে কাউসারের আলোচনা, ২. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিন্দুকের প্রতিবাদ, ৩. নবীজির সমুন্নত মর্যাদার বর্ণনা ও সান্ত্বনা প্রদান, ৪. নামায ও কোরবানীর বিধান আলোচনা।
কাউসার অর্থ: কাউসার শব্দটি আরবিতে কাসীর শব্দের অর্থে ব্যবহৃত এর অর্থ: বেশি বা অধিক। আকসার অর্থ খুব বেশি, কিসার অর্থ খুবই বেশী, কাউসার অর্থ সীমাহীন বেশি, যা সৃষ্টি জ্ঞান গবেষণা বিবেক, বুদ্ধি ও অনুধাবনের বাইরে।
উপর্যূক্ত অর্থের আলোকে কাউসার শব্দের বহুবিধ অর্থের সন্ধান পাওয়া যায়:
১. হাউজে কাউসার: যার পরিধি ও ব্যাপ্তির প্রশস্ততা এক মাসের পথ। যেটি ইয়াকুত ও অন্যান্য মণি মুক্তার উপর প্রবাহিত। যে হাউজের তীরে অসংখ্য মুক্তার তৈরী তাঁবু স্থাপিত থাকবে। সারি সারি সুজলা সুফলা বৃক্ষ রাজিতে সুসজ্জিত থাকবে। যে হাউজে কাউসারের পান পাত্রের সংখ্যা আকাশের নক্ষত্রসম অসংখ্য অগণিত যা বর্ণনাতীত, যে কাউসারের পানি জান্নাতীরাই পান করার সুযোগ পাবে।
২.কাউসার দ্বারা হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উম্মতের আধিক্য বুঝানো হয়েছে যে সংখ্যা সকল সম্মানিত নবীদের উম্মতকে ছাড়িয়ে যাবে, হুযুরের অগণিত উম্মত যারা পৃথিবীর সর্বত্র দিগ দিগন্তে বিস্ততৃভাবে ছড়িয়ে আছেন।
৩. হুযুর করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সীমাহীন জ্ঞান। (তিনি সর্বকালের সর্বযুগের সর্ব শ্রেষ্ঠ মহাজ্ঞানী)
৪. হুযুরের অসংখ্য গুণাবলী যা বর্ণনাতীত ও প্রশংসা (তিনি তাঁর প্রভূ কর্তৃক অধিকভাবে প্রশংসিত)
৫. অথবা কাউসার দ্বারা শাফায়াতে কুবরা বৃহত্তম সুপারিশের ক্ষমতা বুঝানো হয়েছে। (তাফসীরে আযীযী, তাফসীরে নুরুল ইরফান)
হাদীস শরীফে এরশাদ হয়েছে, “হযরত আনাস ইবন মালিক রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, আমার শাফাআত আমার উম্মতের কবীরা গুনাহকারী উম্মতের জন্য। (মুসনাদে আহমদ, আবু দাউদ ও তিরমিযী শরীফ)
হাদীস শরীফে আরো এরশাদ হয়েছে, “হযরত আনাস ইবন মালিক রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, আমি প্রথম ব্যক্তি যে জান্নাত সম্পর্কে আল্লাহর নিকট শাফাআত করব, নবীগণের মধ্যে আমার অনুসারীর সংখ্যাই হবে সবচেয়ে বেশী। (মুসলিম শরীফ)
সূরার শানে নুযুল: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ছাহেবজাদা হযরত কাসেম রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু মক্কা মুকাররমায় ইন্তেকাল করেন এবং অপর ছাহেবজাদা হযরত ইবরাহীম রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু মদীনা মুনাওয়ারায় ইন্তেকাল করেন। উভয়ের ইন্তেকালের পর আস ইবনে ওয়াইল প্রমূখ, কাফির বললো হুযুর “আবতার” নির্বংশ হয়ে গেলেন, তাঁর বংশ আর বাকী থাকলনা তাঁর পরে না তাঁর নাম থাকবে না তাঁর ধর্মের নাম থাকবে। তাঁর মৃত্যু হয়ে গেলে তাঁর নাম উচ্চারণ করারও কেউ থাকবেনা। (নাউজুবিল্লাহ) নবীজির প্রতি কাফিরদের এ ধৃষ্টতা প্রদর্শনের প্রতিবাদ ও তাদের ভ্রান্ত ধারণার খন্ডনে মহান আল্লাহ তাঁর প্রিয় হাবীবকে সান্ত্বনা দানে সূরা কাউসার নাযিল করেন। (তাফসীর রুহুল বয়ান, ইবনে কাসীর, মাযহারী, তাফসীর নুরুল ইরফান)
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, কাউসার মানে অজস্র কল্যাণ, বহু কল্যাণ যা আল্লাহ তা’আলা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে দান করেছেন। (বুখারী শরীফ)
তাফসীরে হযরত সদরুল আফাযীল আল্লামা সৈয়দ নঈমুদ্দিন মুরাদাবাদী রাহমাতুল্লাহ আলাইহি কাউসার’র বর্ণনা প্রসঙ্গে বলেন, আল্লাহ তা’আলা নবীজিকে অসংখ্য ফযীলত দান করে সৃষ্টিকূলের উপর সর্বোত্তম মর্যাদা মন্ডিত ও মহিমান্বিত করেছেন। নবীজির বাহ্যিক সৌন্দর্য, অভ্যন্তরীণ সৌন্দর্য, পবিত্র বংশ মর্যাদা, নবুওয়ত ও রিসালতের সর্বোচ্চ মর্যাদা, মহাগ্রন্থ আল কুরআন নবীজির উপর অবতরণ, অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যতের সকল প্রকার খোদা প্রদত্ত জ্ঞানের আঁধার হিসেবে নবীজিকে শ্রেষ্ঠত্ব প্রদান। মাকামে মাহমুদ তথা শাফা’আতে কুবরার সুমহান প্রশংসিত স্থানে নবীজির অধিষ্ঠান। ইসলামের শত্রুদের উপর নবীজিকে বিজয় দান ইসলামকে পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ বিজয়ী ধর্ম হিসেবে ঘোষণা, এ ছাড়াও অগণিত ফযীলত, নিয়ামত, মর্যাদা ও শ্রেষ্ঠত্ব নবীজিকে দান করেছেন। যে গুলোর পরিসংখ্যান বর্ণনা সৃষ্টিকুলের ক্ষমতা ও সাধ্যের বাইরে যে গুণাবলীর অন্ত নেই। তিনি মহান আল্লাহর অতুলনীয় অদ্বিতীয় সৃষ্টি রাহমাতুল্লীল আলামীন সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম।
হাউজে কাউসারের পরিধি: হাউজে কাউসারের পরিধি বিস্তৃতি ও প্রশস্ততা কত দূর পর্যন্ত হবে এ প্রসঙ্গে হাদীস শরীফের বিভিন্ন কিতাবে অসংখ্য বর্ণনা পাওয়া যায়। এক বর্ণনায় রয়েছে কাউসার আইলা ইসরাঈলের বর্তমান সামুদ্রিক বন্দর আইলাত হতে ইয়ামেনের রাজধানী “সানয়া” পর্যন্ত অথবা আইলা হতে এডেন অথবা আম্মান হতে এডেন পর্যন্ত দীর্ঘ হবে। আর আইলা হতে হুজফা পর্যন্ত যতটা দূরত্ব কাউসার ততটা চওড়া হবে। (বুখারী, মুসলিম, তিরমিযী, ইবন মাযাহ ও মুসনাদে আহমদ)
হাউজে কাউসার’র অবস্থান: হাউজে কাউসার’র অবস্থান সম্পর্কে প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, “আমার গৃহ ও মসজিদের মিম্বরের মাঝে জান্নাতের বাগানসমূহের একটি বাগান রয়েছে। আমার মিম্বর রয়েছে আমার হাউজে কাউসারের উপর। (বুখারী শরীফ)
প্রিয় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কর্তৃক কাউসার অবলোকন: নবীজি এরশাদ করেছেন, “আমি তোমাদের সকলের আগেই হাউজে কাউসারে উপস্থিত থাকব। (বুখারী, মুসলিম)
নবীজি আরো এরশাদ করেছেন, “আমি তোমাদের আগেই কাউসারের নিকট পৌছব ও তোমাদের ব্যাপারে সাক্ষ্য দিব। আল্লাহর কসম আমি এখন আমার হাউজ দেখতে পাচ্ছি। (বুখারী শরীফ)
নবীজির নূরানী দৃষ্টি শক্তির প্রসারতার প্রতি লাখো সালাম। হাউসে কাউসার’র চার প্রান্তে চার খলিফা থাকবেন। “তাফসীরে ফুয়ুজুর রহমান” প্রণেতা আল্লামা ফয়েজ আহমদ ওয়েসী (র.) বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, হাউজে কাউসার’র চার প্রান্তে আমার চার সাহাবী থাকবেন। এক প্রান্তে হযরত আবু বকর (রা.) দ্বিতীয় প্রান্তে হযরত ওমর (রা.), তৃতীয় প্রান্তে হযরত উসমান (রা.), চতুর্থ প্রান্তে হযরত আলী (রা.) থাকবেন, যে ব্যক্তি চারজনের যে কারো সাথে বিদ্বেষ পোষণ করবে তাকে কেউ হাউজে কাউসার’র পানি পান করাবেন না। (তাফসীর ফুয়ুজুর রহমান, ৩০ তম পারা, পৃ: ১০৭৮)
হাউজে কাউসার’র বর্ণনা প্রসঙ্গে প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরো এরশাদ করেছেন, কাউসার’র পানি দুগ্ধ অপেক্ষাও ধবধবে সাদা হবে। কোন বর্ণনায় রৌপ্য কোন বর্ণনায় বরফ অপেক্ষা অধিক ধবধবে সাদা হবে। আকাশের তারকাসম তার পাশে পান পাত্র থাকবে। যে উহার পানি পান করবে সে আর কখনো পিপাসার্ত হবে না। যে বঞ্চিত হবে তার পিপাসা কখনও নিবৃত্ত হবেনা। (বুখারী, মুসলিম)
ইবাদত ও কোরবানীর নির্দেশ: আল্লাহ তা’আলা সূরা কাউসার’র প্রথম আয়াতে রাসূলুল্লাহর প্রতি অশেষ কল্যাণ, প্রাচুর্য অতুলনীয় মর্যাদা অনুগ্রহ ও সর্বোচ্চ মর্যাদা প্রদানের ঘোষণার পর বিনিময়ে আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশের নিমিত্তে আল্লাহর ইবাদত এবং আল্লাহরই নামে কোরবানী করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এ প্রসঙ্গে প্রখ্যাত তাফসীরকার হাকীমুল উম্মত মুফতি আহমদ ইয়ার খান নাঈমী (র.) প্রণীত তাফসীরে নূরুল ইরফানে বর্ণিত হয়েছে, পঞ্চেগানা নামায নিয়মিতভাবে সম্পন্ন করুন। অথবা নফল নামায আদায় করুন, অথবা ঈদুল আযহার ওয়াজিব নামায আদায় করুন। নামাযের পর কোরবানী করুন। কোরবানী হিজরতের পর ওয়াজিব হয়েছে এ কারণে সূরাটি মাদানী।
দুশমনে রাসূলের প্রতি আল্লাহর অভিশাপ ও সতর্কবাণী: প্রিয় রাসূলের পুত্র সন্তান শিশু বয়সে ইন্তেকাল করার কারণে নবীজির প্রতি বিদ্বেষ প্রসূত: নবীজিকে শেকড়হীন আটকুড়ে নির্বংশ মন্তব্য করেছিল, তারাই আজ নির্বংশ হয়েছে, ইতিহাসে তাদের স্মরণ নাম নিশানাও নেই। এসব দুশমনে রাসূল ইসলামের শক্ররা যুুগে যুগে ধিকৃত, নিন্দিত, পর্যুদস্ত পরাস্ত ও নিশ্চিহ্ন হয়েছে, নবীজির শত্রুরাই নির্বংশ হয়েছে। নবীজির পবিত্র বংশধারা আজো অব্যাহত আছে কিয়ামত পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে। নবীজির গুণগান শানমান মর্যাদা ও শ্রেষ্ঠত্বের পতাকাকে আল্লাহ তা’আলা সমুন্বত করেছেন। মহান আল্লাহ আমাদেরকে তাঁর প্রিয় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সমুন্নত আদর্শ অনুসরণ করার তাওফিক নসীব করুন। আমীন।
লেখক : অধ্যক্ষ, মাদরাসা-এ তৈয়্যবিয়া ইসলামিয়া সুন্নিয়া ফাযিল (ডিগ্রী); খতীব,
কদম মোবারক শাহী জামে মসজিদ।
মুহাম্মদ রিদওয়ানুল হক
গাছবাড়ীয়া, হাশিমপুর, চন্দনাইশ, চট্টগ্রাম।

পূর্ববর্তী নিবন্ধইসলামী অর্থব্যবস্থার মূল ভিত্তি, স্বরূপ-পরিচয় ও বৈশিষ্ট্যসমূহ
পরবর্তী নিবন্ধদূরের দুরবিনে