দূরের দুরবিনে

অজয় দাশগুপ্ত | শুক্রবার , ৫ নভেম্বর, ২০২১ at ৯:৩৪ পূর্বাহ্ণ

গত ক দিন দেশের বাইরে সংখ্যালঘু নামে পরিচিত বিশেষত হিন্দু সমপ্রদায়ের মানুষজন প্রতিবাদ মুখর। দেশে ঘটে যাওয়া ঘটনার বিরুদ্ধে তাদের প্রতিবাদ সঙ্গত। সাথে দায়বোধ ও আজ প্রশ্ন তুলছে। বিশেষ করে বাংলাদেশ যখন শেখ হাসিনার নেতৃত্বে অগ্রগতির রথে। এই অগ্রযাত্রার বিরুদ্ধে কারা এবং কাদের চক্রান্ত আর উস্কানিতে এসব ঘটে মানুষ জানলেও বিষয়গুলো পরিষ্কার না। বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রীর কথার পরও অনেকে যখন ভিন্ন সুরে কথা বলে সমাধানের পথে কাঁটা হয়ে দাঁড়াতে চাইছেন। অথচ এসব কূটতর্কের সময় এখন না। এখন সময় সমঝোতা আর শান্তির পথ খুলে দেয়ার। এতোবছরে যে বিশ্বাস আর ঐক্য তা এবার পড়েছে ঘোর সংকটের মুখে। সে সংকট কাটাতেই হবে। দেশের জন্য সামাজিক প্রগতির জন্য এখন এটা জরুরি। বাংলাদেশের অর্জন আর বিসর্জনের পাল্লা দেখলেই বোঝা যাবে আমরা কোথায় এগিয়ে।
৫০ বছরে বাংলাদেশের অর্জন কি কি? সুবর্ণজয়ন্তী কথাটা শুনতে যেমন মধুর তেমনি এই সময়কালও কম কিছু না। বাঙালির এক সময় গড় আয়ু ছিলো ৫০ এর কম। সে অর্থে আমাদের দেশ আজ প্রৌঢ়। তার এই বয়স হাজার হোক, হোক অনন্ত অসীম। যতোবার আমরা তার জন্মলগ্ন বা জন্মানোর ইতিহাসের দিকে ফিরবো ততোবার আমাদের মনে পড়বে এই দেশ এই মাটি রক্ত অশ্রুজল আর বেদনার সৌধ। এতো ত্যাগ আর কষ্ট খুব কম জাতি ই করেছে তার স্বাধীনতার জন্য। কিন্তু আমাদের বড় পাওয়া এটাই সব ত্যাগ আর সংগ্রামে আমরা অর্জন করেছি বাংলাদেশ।
পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী চলে গেছে। বিতাড়িত হয়েছে পাকি শাসন। পরাজিত হয়েছে দানবের দল। কিন্তু রেখে গেছে তাদের রক্তবীজ। সে রক্তবীজ যে কতো ভয়ানক আর ভয়ংকর তার প্রমাণ মিলেছে স্বাধীনতার পর। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব যতোবড় দেশপ্রেমিক আর ক্যারিশমেটিক লিডার ছিলেন তাঁর হাতে সময় ছিলো ততো কম। দেশ শাসনের বিপুল অভিজ্ঞতা আর প্রজ্ঞা অর্জনের আগেই তাঁকে নিহত হতে হয়েছিল মর্মান্তিক ভাবে। ঘাতকেরা সেখানেই শেষ করে নি। তারা আমাদের রাজনীতির অভিভাবক চার নেতা বিশেষত তাজউদ্দীনের মতো নেতাকে সরিয়ে প্রমাণ করেছিল এদেশের মাটি থেকে বেঈমান আর ঘাতক শেষ হয়ে যায় নি। সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় এদের রাজনৈতিক পরোধা ছিলো আওয়ামী লীগের তখনকার ডাকসাইটের নেতা খন্দকার মোশতাক। স্বাধীনতার পর বিশেষত পঁচাত্তরের পর আমরা অবিরল মোশতাকের জন্ম হতে দেখেছি। আর দেশ জুড়ে গড়ে উঠেছিল বিএনপি জামাতের জোট আমলের নামে প্রচ্ছন্ন স্বাধীনতা বিরোধী ভাবধারার শাসন। যে দেশের জন্মলগ্নে সেক্টর কমান্ডারেরা জান বাজী রেখে লড়াই করার কথা তাঁদের ই একজন মেজর জিয়াউর রহমানের নেটরত্বে পুনর্বাসিত হলো ইতিহাসে পরিত্যক্ত ঘাতকের দল। পাকিদের রেখে যাওয়া দালালেরা চলে এলো দেশশাসনে।
অতঃপর জেনারেল এরশাদের শাসন তারপর আবারো জোট সরকার। সে আমলগুলোতে আমরা পার করেছি আমাদের যৌবনের শ্রেষ্ঠ সময়। কাছ থেকে দেখেছি একের পর এক আদর্শ আর উজ্জ্বলতার নিস্প্রভ হয়ে যাওয়া। একসময় মনে হচ্ছিল এই বুঝি শেষ। এক ধরনের নোংরা আপোসকামিতা আর দালালতন্ত্রের ভেতর দিয়েই চবে বাংলাদেশ প্রয়াত হুমায়ূন আজাদ যার নাম দিয়েছিলেন বাংলাস্তান। কিন্তু ইতিহাস জানে জানতো কি করতে হবে। যে সময়কালে এতো মুজিবকোট ছিলো না যে সময়কালে আওয়ামী লীগ মানে ত্যাগী আর সত্যিকারের আদর্শের মানুষ বা নেতা তখন তারা রাজপথে ব্যস্ত। ভোটের রাজনীতির মেরুকরণে তাদের করতে হয়েছিল বহু হিসেব নিকেশ। কিন্তু সময় তো বসে থাকার না। সে জানে তার কি করতে হবে। সময় তখন ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির মাধ্যমে মাঠে নিয়ে এসেছিল রক্ত ত্যাগ রা সম্ভ্রম হারানোর বেদনা। মানুষকে জাগিয়ে তুলেছিল রাজাকারদের বিচার করবে বলে। প্রায় অসম্ভব আর দুঃসাধ্য মনে হতে থাকা সে কাজটির পুরোধা ছিলেন এক নারী। অসীম সাহসী এক শহীদ জননী। ক্যানসারের মতো কঠিন রোগ নিয়ে ও যিনি লড়াই করে গণ আদালতে হাজির করিয়েছিলেন লাখো মানুষ। সে সংগ্রাম সে আদালতের রায় আর ধারাবাহিকতায় শাহবাগ গড়ে না উঠলে আওয়ামী লীগের সরকার কি আসলেই বিচার ও শাস্তি নিশ্চিত করতে পারতো? বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা তা করে বাংলাদেশের ইতিহাসকে কলংকমুক্ত করেছেন। আর এই অর্জন অর্থনৈতিক অর্জনের পাশাপাশি বাংলাদেশের ৫০ বছরের সেরা অর্জন বলে মনে করি।
কিন্তু এ কথা মনে রাখা দরকার ফাঁসি বা বিচারের পেছনে যে রাজনৈতিক ইচ্ছা তার সাথে আদর্শের যোগ খুব একটা থাকে না। আদর্শ বিষয়টা সারাজীবন ধরে রাখার। আজকের বাংলাদেশের দেশ শাসনে যারা তারা যে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দানকারী দল এটা মেনেও বলি বাংলাদেশের সামপ্রতিক ঘটনা প্রবাহে মনে হয় না ৫০ বছর পর দেশ মুক্তিযুদ্ধের আদর্শে অটল। তাই ৫০ বছরে অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নতি একসাথে একযোগে সামনে এগুতে না পারলে এ দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে আশাবাদ থাকবে কিন্তু শংকাও যাবে না। আমি মনে করি তাই ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির নির্মূল অভিযানের দিকটির গতিপথ বদলে এখন সামাজিক সামপ্রদায়িকতা আর মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী পাঠ্যক্রম বাতিলের দিকে ধাবিত হওয়া উচিত। এই কাজটি করার তাগিদ আজ দোরগোড়ায়। এবং এটা নিশ্চিত মৃতপ্রায় সংস্কৃতি আর উগ্র সমাজে ঘাতক দালাল নির্মূল বা এমন আদর্শের সংগঠন ছাড়া আর কেউ এ কাজে এগিয়ে আসতে সাহস পাবে না। বিদেশের শাখাগুলো ও এখন এমন সব কাজে যুক্ত হোক এই প্রত্যাশা করি।
সামাজিক সংগঠনগুলোকে আবার চাঙ্গা করা জরুরি। আরো জরুরি পাঠক্রমসহ সব বিষয়ে প্রগতিশীলতা ফিরিয়ে আনা। এসব কাজ যতো তাড়াতাড়ি শুরু হবে ততো মঙ্গল। একটি দেশের আর্থিক উন্নতি টেকসই হয় তার সমাজের উন্নতিতে। সে কথাটা আবারো মনে করিয়ে দিয়েছে সমাজের বিশৃঙ্খলা, দেশের শান্তি ও সমৃদ্ধির জন্য মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের বিকল্প নাই। একথা বারেবারে প্রমাণিত হয়েছে। কিন্তু কোন গোপনে আমাদের সব চুরি হয়ে যাচ্ছে তা কি আমরা টের পাচ্ছি?
অসামপ্রদায়িকতা এ দেশের সমাজের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। সে কথা নদীর টানে ফুলের প্রাণে পাখির গানে থাকার পরও যারা তা কেটে টুকরো করতে চায় তাদের জন্য করুণা ছাড়া আর কি থাকতে পারে? তবে এবার তাদের দমন করতেই হবে। আর সেখানেই আছে বাংলাদেশের সোনালী ভবিষ্যতের সম্ভাবনা। এর কোন বিকল্প নাই। বাংলাদেশ সময়মতো ঠিক ই রুখে দাঁড়াতে জানে। তবে বিশ্বাস আর ভালোবাসা যেন জেগে থাকে আজীবন। নয়তো দেশ এগুতে পারবে না। বাংলাদেশের অগ্রগতি আর সম্ভাবনা যাদের চোখে ভালো ঠেকে না তারা দেশের দুশমন। আর দেশের সব প্রগতিশীল মানুষই তার শক্তি। সে শক্তি আবার ঘুরে দাঁড়াক। জীবনের এই বেলায় আমরা এর বেশী আর কি চাইতে পারি? জয় হোক স্বদেশের।
লেখক : সিডনি প্রবাসী কবি, প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট

পূর্ববর্তী নিবন্ধজুম্’আর খুতবা
পরবর্তী নিবন্ধনাটক ‘অবশেষে একা’