ইসলামী অর্থব্যবস্থার মূল ভিত্তি, স্বরূপ-পরিচয় ও বৈশিষ্ট্যসমূহ

এস এম ফখরুল ইসলাম নোমানী (মোরশেদ ) | শুক্রবার , ৫ নভেম্বর, ২০২১ at ৯:২৮ পূর্বাহ্ণ

বর্তমান যুগে অর্থনৈতিক শক্তি একটি বিশ্ব নিয়ন্ত্রক শক্তিতে পরিণত হয়েছে। অর্থনৈতিক শক্তিকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হচ্ছে বৈশ্বিক রাজনীতি। উন্নতি অবনতির মাপকাঠি ধরা হচ্ছে অর্থনৈতিক শক্তিকে। যার ফলে প্রতিটি দেশ-সম্পদ উপার্জনের অঘোষিত যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছে। প্রতিটি মানুষের মাঝে কাজ করছে সম্পদশালী হওয়ার অন্তহীন আকাঙ্ক্ষা। ফলে মানুষ সম্পদের পেছনে পড়ে বিসর্জন দিচ্ছে নিজের নৈতিক মূল্যবোধ।
আর এ প্রয়োজন পূরণ করতে পারে একমাত্র ইসলামী অর্থব্যবস্থা। বস্তুত ইসলামী অর্থব্যবস্থা এমন এক সুষম অর্থব্যবস্থা,যা একদিকে মানুষকে অর্থনৈতিক বৈষম্য থেকে মুক্তি দেয় অপরদিকে সম্পদশালী হতেও বাধা দেয় না।
ইসলাম ইহকাল ও পরকালের সমন্বয়ে পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা। মানব জীবনের সকল কর্মকান্ডের দিক নির্দেশনা ইসলামে বিদ্যমান আছে। আর মানব জীবনে একটি বড় অংশ জুড়ে আছে অর্থনৈতিক কর্মকান্ড। ইসলাম কল্যাণময় বৈজ্ঞানিক এবং ভারসম্যপূর্ণ একটি অর্থব্যবস্থার নির্দেশনা দিয়েছে। আল্লাহ তায়ালা অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে নিয়োজিত হওয়ার নির্দেশ দিয়ে বলেন-সালাত সমাপ্ত হয়ে গেলে তোমরা পৃথিবীতে জমিনে ছড়িয়ে পড় এবং আল্লাহর অনুগ্রহরাজি সন্ধান কর,(সূরা জুমআ,১০)।
ইসলামী অর্থব্যবস্থার পরিচয় : ইসলামী জীবনবোধ ও ইসলামী দর্শন থেকে ইসলামী অর্থব্যবস্থার উদ্ভব হয়েছে। ইসলামী অর্থব্যবস্থা জীবন-দর্শন, কৃষ্টি ও সভ্যতার সাথে একই সূত্রে গাঁথা। এর মৌলিক নীতিগুলো পবিত্র কুরআন ও সুন্নাহ হতে গৃহিত হয়েছে। সুতরাং যে অর্থনীতি (অর্থব্যবস্থা) ইসলামী বিধি-বিধান তথা কুরআন ও সুন্নাহর ভিত্তিতে পরিচালিত হয় তাকে ইসলামী অর্থব্যবস্থা বলে। ইসলামী অর্থব্যবস্থায় সৃষ্টি জীবের সর্বাধিক কল্যাণের লক্ষ্যে উৎপাদন, সুষম বণ্টন ও ন্যায়সঙ্গত ভোগ বিশ্লেষণ করা হয়। সাধারণ অর্থব্যবস্থার মত ইসলামী অর্থব্যবস্থায়ও অর্থসম্পদ সম্পর্কীয় ব্যবস্থাপনা ও নির্দেশনা রয়েছে। তবে প্রচলিত অর্থব্যবস্থার মত মানবরচিত আদর্শের পরিবর্তে এখানে আল্লাহর দেয়া বিধান ও নীতিমালা সক্রিয় থাকে।
ইসলামী অর্থব্যবস্থার মূল ভিত্তি হলো কুরআন-সুন্নাহ থেকে উদ্ভাবিত বিধি-বিধান তথা ইসলামী শরিয়ত। এ হিসেবে ইসলামী অর্থব্যবস্থার সংক্ষিপ্ত পরিচিতি এভাবে দেয়া যায়-ইসলামী শরিয়ত মুতাবেক যে অর্থব্যবস্থা পরিচালিত ও নিয়ন্ত্রিত হয়,তাকে ইসলামী অর্থব্যবস্থা বলে।
ইসলামী অর্থব্যবস্থার স্বরূপ : ইসলামী অর্থব্যবস্থা একটি আদর্শিক অর্থব্যবস্থা। এর আদর্শিক চেতনা এ অর্থব্যবস্থাকে মানুষের কল্যাণে নিয়োজিত রাখে। ইসলামী অর্থব্যবস্থা মানুষের সকল প্রকার সমস্যার সুষ্ঠু সমাধান ও স্থায়ী কল্যাণ সাধন করে থাকে। কেননা এ অর্থব্যবস্থায় মানুষের জাগতিক কাজকর্ম, জীবন ধারণ, আয়-ব্যায়, উৎপাদন, বিনিয়োগ, ভোগ, ব্যবস্থাপনা, ব্যবসা-বাণিজ্য, লেন-দেন, বণ্টন, সঞ্চয় সবকিছুর সমাধান দেয়া হয়েছে।
আধুনিক অর্থব্যবস্থা বিনিময় বা বিনিময় যোগ্যতা নিয়ে আলোচনা করে। আর ইসলামী অর্থব্যবস্থা বিনিময় অযোগ্য জিনিস নিয়েও আলোচনা করে। এখানে নৈতিক মূল্যবোধ ও চরিত্রের বিষয়টিও বিবেচনা করা হয়।
ইসলামী অর্থব্যবস্থার বিষয়বস্তু সম্পর্কে ড. এম. এ. মান্নান বলেন, ইসলামী অর্থব্যবস্থার বিষয়বস্তু হচ্ছে গণমানুষের যাবতীয় অর্থনৈতিক সমস্যা যা ইসলামের আলোকে সমাধান যোগ্য।
ইসলামী অর্থব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য: ইসলামী অর্থব্যবস্থা এক আদর্শিক অর্থব্যবস্থা। এ অর্থব্যবস্থা মানব রচিত অন্যান্য অর্থব্যবস্থা থেকে আলাদা বৈশিষ্ট্যময়। নিচের আলোচনা হতে তার স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যাবে।
১. ইসলামী শরীয়া ভিত্তিক পরিচালিত : ইসলামী অর্থব্যবস্থা সম্পূর্ণভাবে ইসলামী শরীয়ার উপর প্রতিষ্ঠিত। কুরআন ও হাদীস এর মূল উৎস। কুরআন ও হাদীসের নীতিমালার আলোকে কিয়াস দ্বারা এর ব্যবস্থাপনার রীতিনীতি গতিশীল হয়েছে। আর ইজমার মাধ্যমে এ অর্থব্যবস্থার বিধানসমূহ সুদূঢ় হয়েছে। এ জন্য ইসলামী অর্থব্যবস্থা মূলত ইসলামী শরীয়া ভিত্তিক ব্যবস্থা।
২. সম্পদের মালিকানা : ইসলামী অর্থব্যবস্থায় সম্পদের মূল মালিকানা আল্লাহ তাআলার। মানুষ মালিক নয়। বরং আল্লাহর পক্ষে নিয়োজিত তত্ত্বাবধায়ক, সংরক্ষক, প্রতিনিধি।
৩. নিয়ন্ত্রিত ব্যক্তি মালিকানা : এ অর্থ ব্যবস্থায় ব্যক্তি-মালিকানা আছে। তবে তা পুঁজিবাদের মত অবাধ এবং স্বেচ্ছাচারী নয়। আবার সমাজবাদের মত সামষ্টিক মালিকানাও নয়। বরং এ অর্থব্যবস্থা আল্লাহ তায়ালার বিধান দ্বারা নিয়ন্ত্রিত সুনির্দিষ্ট ব্যক্তি-মালিকানা।
৪. বণ্টননীতি : এ ব্যবস্থায় সম্পদের সুষম ও ভারসম্যপূর্ণ বণ্টননীতি অনুসৃত হয়। এখানে কেউ যেমন সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলতে পারে না, তেমনি কারো পক্ষে নি:স্ব থাকাও সম্ভব না। এ ব্যবস্থায় ধনীর সম্পদে গরীবের অধিকার দেয়া আছে। আল্লাহ তাআলা বলেন, আর তাদের (ধনীদের) সম্পদের প্রার্থনাকারী ও বঞ্চিতদের অধিকার রয়েছে, (সূরা জারিয়াহ, ১৯)।
৫. যাকাত ভিত্তিক : ইসলামী অর্থব্যবস্থা যাকাতভিত্তিক অর্থব্যবস্থা। এখানে যে মুসলিম ব্যক্তির কাছে তার প্রয়োজনীয় ব্যায়ের পর সাড়ে সাত তোলা সোনা বা সাড়ে বায়ান্ন তোলা রূপা কিংবা এর সমপরিমাণ অর্থ পূর্ণ এক বছর অতিরিক্তি থাকে তাকে ২.৫% হারে যাকাত আদায় করেতে হয়। আল্লাহ তায়ালা বলেন, তোমরা সালাত কায়েম কর এবং যাকাত আদায় কর, (সূরা বাকারাহ, ৮৩)।
৬. সুদমুক্ত : ইসলামী অর্থব্যবস্থায় সব লেনদেন সুদ-মুক্ত। এ ব্যবস্থায় কোন ক্ষেত্রেই সুদের লেনদেন হালাল রাখা হয়নি। সুদ নিষিদ্ধ করে শোষণের পথ বন্ধ করা হয়েছে। আল্লাহ তাআলা বলেন-আর আল্লাহ তাআলা ব্যবসা হালাল করেছেন এবং সুদ হারাম করেছেন, (সূরা বাকারাহ, ২৭৫)। ইসলামী অর্থব্যবস্থায় সুদের প্রচলন নেই। রাসূল (সা.) সুদ সংশ্লিষ্ট সবার জন্য আল্লাহর অভিসম্পাত কামনা করেছেন।
৭. উৎপাদন ও উপার্জননীতি : ইসলামী অর্থব্যবস্থায় যা খুশি উৎপাদন করা যায় না, যেভাবে খুশি উপার্জনও করা যায় না। জনস্বাস্থ্য ও স্বাথের্র জন্য হুমকি এমন সব কিছুর উৎপদন ইসলামে নিষিদ্ধ। এ ব্যবস্থায় আল্লাহ তাআলা হারাম করেছেন এমন কোন কিছুর উৎপাদন বৈধ নয়। উপার্জনের ক্ষেত্রেও হালাল উপার্জন বাধ্যতামূলক। রাসূল (সা.) বলেছেন- হালাল উপার্জন করা ফরজের চেয়েও ফরজ (বায়হাকী, ৮৪৮২)। এজন্য লাভজনক মনে হলেও ইসলামী অর্থব্যবস্থায় মাদক দ্রব্য উৎপাদনের সুযোগ নেই। সুদ, ঘুষ, চুরি বা সম্পদ আত্মসাতের মাধ্যমেও এ ব্যবস্থায় উপার্জন নিষিদ্ধ।
৮. ব্যয়নীতি : ইসলামী অর্থব্যবস্থায় যেমন খুশি তেমনভাবে অর্থ ব্যয়ের সুযোগ নেই। কেবল হালাল পথে ব্যয় করা যাবে। হারাম বস্তু কেনা বা হারাম কাজ সম্পাদনে সম্পদ ব্যয়ের অনুমতি ইসলাম দেয়নি। ব্যক্তি প্রয়োজন অনুসারে সম্পদ ব্যয় করবে। অপব্যয় বা অপচয় করা ইসলামে পুরোপুরি নিষিদ্ধ। আল্লাহ তায়ালা বলেন-তোমরা খাও এবং পান কর কিন্তু অপচয় করোনা, নিশ্চয় আল্লাহ অপচয়কারীদের ভালবাসেন না, (সূরা আরাফ, ৩১)। ইসলামী অর্থব্যবস্থায় অপচয়-অপব্যয়ের সুযোগ নেই, তেমনি এ ব্যবস্থায় কৃপণতারও অবকাশ নেই।
৯. সঞ্চয়নীতি : প্রয়োজনীয় অর্থ সঞ্চয়ে ইসলামে কোন নিষেধাজ্ঞা নেই। কিন্তু বিত্ত-বৈভব ও ঐশ্বর্যের পাহাড় গড়ে তুলে সঞ্চয় করা কিংবা নিকটাত্মীয় ও প্রতিবেশীদের অনটনে রেখে সম্পদ সঞ্চয় করা ইসলামে হালাল মনে করা হয় নি। বরং নিঃস্ব ও দুস্থদের প্রয়োজনে সঞ্চিত সম্পদ দান না করার ব্যাপারে আল্লাহ তাআলা কঠোর হুশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন। আল্লাহ তায়ালা বলেন- যারা সোনা ও রূপা জমাকরে কিন্তু তা থেকে আল্লাহর পথে ব্যয় করে না তাদেরকে যন্ত্রণায়ক শাস্তির সংবাদ দিন, (সূরা তাওবা, ৩৪)।
১০. বায়তুলমাল ভিত্তিক : ইসলামী অর্থব্যবস্থা বায়তুলমাল ভিত্তিক। এ ব্যবস্থার কেন্দ্রীয় অর্থ প্রশাসন হল বায়তুল মাল। রাষ্ট্রের সব আয় বায়তুল মালে জমা হয়। লোকের দীনি দায়িত্বানুভূতি নিয়ে যাকাতসহ সব অনিবার্য ও ঐচ্ছিক দান বায়তুলমালে জমা দেয়। এ অর্থব্যবস্থায় বায়তুলমাল কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দায়িত্ব পালন করে।
মোদ্দাকথা, আজকের এ অশান্ত পৃথিবীতে অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর করতে, মানুষের মাঝে নৈতিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠা করতে এবং ন্যায়ভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থা চালু করে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর কল্যাণ সাধনে ইসলামী অর্থব্যবস্থার বিকল্প নেই। আল্লাহতা’আলা আমাদেরকে এই সত্য উপলব্ধি করার এবং পৃথিবীতে ইসলামী অর্থব্যবস্থা চালু করার তাওফিক দান করুন। আমীন।
লেখক : হেড অব ফাইন্যান্স এন্ড একাউন্টস,
এপিক হেলথ কেয়ার লিমিটেড

পূর্ববর্তী নিবন্ধসুনিয়ন্ত্রিত চলন, সমৃদ্ধ জীবন
পরবর্তী নিবন্ধজুম্’আর খুতবা