জাতীয় শিক্ষা নীতি ও প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থা

এবিএম ফজলে করিম চৌধুরী এম.পি. | মঙ্গলবার , ২০ সেপ্টেম্বর, ২০২২ at ৬:০৮ পূর্বাহ্ণ

স্বাধীনতার প্রায় ৪০ বছরে বাংলাদেশে কোন শিক্ষা নীতি বাস্তবায়িত হয়নি। ২০০৯ সালে জাতীয় নির্বাচনে জনগণের অভূতপূর্ব সমর্থন নিয়ে জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ও মহাজোটের সরকার প্রতিষ্ঠার পর ২০১০ সালে বাংলাদেশে জাতীয় শিক্ষা নীতি-২০১০ প্রণয়ন করা হয়। যদিও স্বাধীন বাংলাদেশের মহান স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের উদ্যোগে স্বাধীন বাংলাদেশের চাহিদা অনুসারে শিক্ষানীতি প্রণীত হলেও ৭৫’র ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে স-পরিবারে হত্যার পর তা আর বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি। এর পরবর্তীতে আরও ছয়টি শিক্ষা নীতি প্রনীত হলেও তার একটিও বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি। এখনে উল্লেখ্য যে, ১৯৯৬ সালে বঙ্গবন্ধু-কন্যা দেশরত্ন শেখ হাসিনার নেতৃত্বে স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার অনুসারী সরকার একটি শিক্ষানীতি (শিক্ষানীতি-২০০০) প্রণয়ন করলেও, ২০০১ সালে সরকারের পরিবর্তন হলে বঙ্গবন্ধু-কন্যা দেশরত্ন শেখ হাসিনার সরকার কর্তৃক প্রনীত শিক্ষানীতিটি বাস্তবায়নের পরিবর্তে তা বাতিল করে দেওয়া হয়। ২০০৯ সালে বঙ্গবন্ধু-কন্যা আবার রাষ্ট্র ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হলে জাতির সামনে নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচিত হয়।
নির্বচনে দিন বদলের সনদ, ভিশন-২০২১ এবং ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার ধারণাটি জনগনের মধ্যে ব্যপক সাড়া ফেলে। সরকার দায়িত্ব গ্রহণের সাথে সাথেই অতি অল্প সময়ের মধ্যে শিক্ষানীতি প্রণয়ন করে বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া শুরু করার লক্ষ্যকে সামনে নিয়ে অগ্রসর হতে শুরু করে। সরকার জাতীয় অধ্যাপক কবীর চৌধুরীকে চেয়ারম্যান ও ড. কাজী খলিকুজ্জমান আহমদকে কো-চেয়ারম্যান করে আঠারো সদস্য বিশিষ্ট শিক্ষানীতি প্রণয়ন করে। গঠিত কমিটি মাত্র চার মাসের মধ্যে একটি খসড়া শিক্ষানীতি প্রণয়ন করে। যা পরবর্তীতে মতামত গ্রহনের জন্য ওয়েবসাইট এবং অন্যান্য প্রচার মাধ্যমে প্রকাশ/ প্রচার করা হয়। এতে সকল অংশীজনের বিপুল সাড়া পাওয়া যায়। প্রচার মাধ্যমে খসড়া শিক্ষানীতি নিয়ে ব্যাপক আলোচনা পর্যালোচনা করা হয়।শিক্ষানীতিটি চুড়ান্ত করার লক্ষ্যে শিক্ষাবিদ, শিক্ষক, শিক্ষার্থী, অভিভাবক, রাজনীতিক, আলেম-ওলামা, ব্যবসায়ী, বিনিয়োগকারী, পেশাজীবীসহ সমাজের সকল স্তরের মানুষের মতামত, সুপারিশ ও পরামর্শ গ্রহন করা হয়। অংশীজনের সুপারিশ ও পরামশ বিবেচনায় নিয়ে খসড়া শিক্ষানীতিকে আরও পরিমার্জিত করে চূড়ান্ত আকারে প্রণয়ন করা হয়। এই শিক্ষানীতিতে সবরকম বৈষম্যের অবসান ঘটিয়ে সবার জন্য শিক্ষার অধিকার ও সুযোগ নিশ্চিত করার লক্ষ্য মৌলিক ভিত্তি হিসেবে অনুসরণ করা হয়েছে। দেশের সকল শিশুর জন্য শিক্ষা অধিকার নিশ্চিত করা একটি মৌলিক বিষয়। আধুনিক প্রযুক্তি নির্ভর, যুগোপযোগী মানসম্মত শিক্ষা লাভ করে জ্ঞান-বিজ্ঞান-প্রযুক্তি আয়ত্ত করে নতুন প্রজন্ম নিজেদের দক্ষ মানবসম্পদে পরিণত করে দারিদ্র্য, নিরক্ষরতা, দুর্নীতি, সাম্প্রদায়িকতা ও পশ্চাৎপদতার অবসান ঘটিয়ে উন্নত সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ায় নিজেদের অবদান রাখতে পারে। কারিগরি, বৃত্তিমূলক ও জীবনমূখী শিক্ষার প্রসার ঘটিয়ে তরুণদের দক্ষ ও পেশাদার মানবসম্পদে রূপান্তরিত করতে হবে।
আধুনিক বিজ্ঞান মনস্ক প্রযুক্তি নির্ভর মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করা আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে একটি বড় চ্যালেঞ্জ। এর জন্য প্রয়োজন শিক্ষিত, প্রশিক্ষিত, দক্ষ ও নিবেদিতপ্রাণ শিক্ষক। বর্তমান সময়ে প্রযুক্তি জীবনের গুরুত্বপূর্ণ অনুসঙ্গ। তাই যুগের সাথে তাল মিলিয়ে শিক্ষার অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে কম্পিউটার ও তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়কে সারা বিশ্বে সর্বাধিক গুরুত্ব প্রদান করা হয়েছে। বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থায়ও বিষয়টি অগ্রাধিকার হিসেবে বিবেচনায় নিতে হবে। বাংলাদেশকে যেমন একদিকে নিরক্ষরতার অবসান ঘটিয়ে যেমন সকলের জন্য শিক্ষা নিশ্চিত করতে হবে, অপরদিকে তেমনি আমাদের উচ্চশিক্ষার মান বিশ্বমানে উন্নীত করে শিক্ষার্থীদের বিশ্ব নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে হবে।চ্যালেঞ্জ যত বড়ই হোক না কেন, জাতি হিসেবে আমাদের তা মোকাবেলা করতে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হবে। আমাদের অবিষ্ঠ লক্ষ্য অর্জনের জন্য শিক্ষাই এবং শিক্ষাই হতে পারে একমাত্র ফলপ্রসূ উপায়। নিরক্ষরতা দূরীকরণ থেকে শুরু করে সর্বাধুনিক জ্ঞান ও প্রযুক্তি শিক্ষাদান সব কিছুই আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় সমান গুরুত্ব দিতে হবে। দলমত নির্বিশেষে সমগ্র জাতির ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টায় শিক্ষানীতির সফল বাস্তবায়নের মাধ্যমে শিক্ষার লক্ষ্য অর্জনে এগিয়ে যেতে হবে। সমগ্র জাতির ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা ও কর্মপ্রয়াসই আমাদের জাতির জন্য কাংখিত সাফল্য এনে দিতে পারে।
বাংলাদেশে শিক্ষায় গুণগত পরিবর্তন বর্তমান সময়ে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ অগ্রাধিকার বিষয়। সমাজের সকল স্তরের মানুষ ভবিষ্যৎ গঠনের এই মহৎ উদ্যোগে আন্তরিকভাবে অংশগ্রহন করবেন- এই প্রত্যাশা নিয়ে প্রণীত শিক্ষানীতি বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া শুরু করতে হবে। শিক্ষায় সরকারি ও বেসরকারি সহযোগিতা ও বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। শিক্ষায় তথ্যপ্রযুক্তির ব্যাপক প্রসারের জন্য প্রচুর বিনিয়োগের প্রয়োজন রয়েছে। শিক্ষায় বিনিয়োগ প্রকুত অর্থে জাতির উজ্জ্বল ভবিষ্যত বিনির্মাণের বিনিয়োগ। শিক্ষায় আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান-প্রযুক্তি আয়ত্ত করার সাথে সাথে নতুন প্রজন্মের নৈতিক মূল্যবোধ, সততা, চরিত্র গঠন এবং জনগণ ও সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতা ও দেশপ্রেম জাগ্রত করতে হবে। আমাদের জাতীয় ঐতিহ্য, মূল্যবোধ এবং গৌরবময় ইতিহাস নতুন প্রজন্মকে সাহসী ও গৌরবান্বিত করে প্রকৃত শিক্ষায় দক্ষ, জ্ঞানী এবং দেশপ্রেমিক নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে পারে। নতুন প্রজন্মকে উদ্যোগী, সৃজনশীল এবং নিজ নিজ কর্মক্ষেত্রে নেতৃত্বদানে সক্ষম হতে হবে। সঠিক নীতিমালার ও উদ্যোগের অভাবে কোনো শিক্ষার্থীর জীবনকে একটি উদ্দেশ্যহীন গন্তব্যে ঠেলে দেয়া কোনভাবেই কাম্য হতে পারে না সাথে সাথে নূন্যতম একটি পর্যায় পর্যন্ত মানসম্মত শিক্ষা লাভ না করে মাঝ পথে কোনো শিক্ষার্থী ঝরে পড়াও তেমনি কাম্য হতে পারে না। প্রত্যেক শিক্ষার্থীর জীবনকে অর্থপূর্ণ করে তোলার লক্ষ্যে কেনো না কেনো পর্যায়ে একটি স্বীকৃত শিক্ষাগত যোগ্যতা অর্জনের ব্যবস্থা থাকতে হবে। প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে অধ্যয়নরত সকল শিক্ষার্থীর শিক্ষা জীবনের মূল্যবান সময়ের ব্যবহার যথাযথভাবে নিশ্চিত করতে হবে। জাতি হিসেবে কোনো শিক্ষার্থীই অকৃতকার্য হয়ে শিক্ষা জীবন থেকে হারিয়ে যাক, তা কাম্য হতে পারে না। পরীক্ষা পদ্ধতি বা শিক্ষার্থীর মূল্যায়ন প্রক্রিয়ার মৌলিক পরিবর্তন আনতে হবে। এ লক্ষ্যে কার্যকর শ্রেণী শিক্ষাকে নিশ্চিত করতে হবে। তথাকথিত নোট বই, প্রাইভেট টিউশনী প্রভৃতি অনাকাঙ্খিত আপদ থেকে শিক্ষার্থীদের মুক্তি দিতে হবে। পরীক্ষা হতে হবে শান্তিপূর্ণ, নিরাপদ ও স্বাভাবিক পরিবেশে। পরীক্ষাকে শিক্ষার্থীরা কোনভাবেই যেন ভীতিকর মনে না করে। বরং পরীক্ষাকে শিক্ষার্থীরা আনন্দময় উৎসব হিসেবে গ্রহণ করবে। পরীক্ষাকে পরীক্ষার্থীরা তার শিক্ষা জীবনের সার্থকতার মূল্যায়ণ ও স্বীকৃতি হিসাবে অনুসংগ ভেবে আনন্দের সাথে গ্রহণ করবে। শিক্ষার্থীর ইচ্ছার বিরুদ্ধে শিক্ষাদান নয় বরং শিশুদের শিক্ষার পরিবেশ, পাঠদান পদ্ধতি ও বিষয়বস্তু আকর্ষণীয় ও আনন্দময় করে তুলতে হবে। জাতির স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে হলে, আগামীর চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় তরুণ প্রজন্মকে প্রকৃত শিক্ষা, জ্ঞান, প্রযুক্তিতে দক্ষ একই সংগে নৈতিক মূল্যবোধ, জনগণের প্রতি শ্রদ্ধাশীল, দায়বদ্ধ এবং দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ মানব সম্পদ হিসাবে গড়ে তুলতে হবে।
জাতীয় শিক্ষা নীতি-২০১০ এ মোট ২৮ টি অধ্যায় ও ২ টি সংযোজনী রয়েছে। অধ্যায়- ২ এ প্রাক-প্রাথমিক ও প্রাথমিক শিক্ষা নীতি নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। জাতীয় শিক্ষা নীতি-২০১০ এর অধ্যায়-২ এ আলোচিত প্রাথমিক শিক্ষা সংক্রান্ত নীতি গুলো উপস্থাপন করা হলো-
প্রাথমিক শিক্ষা
উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য
জাতীয় জীবনে প্রাথমিক শিক্ষার গুরুত্ব অত্যাধিক। দেশের সব মানুষের শিক্ষার আয়োজন এবং জনসংখ্যাকে দক্ষ করে তোলার ভিত্তিমূল প্রাথমিক শিক্ষা। তাই মানসমপন্ন প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণের জন্য জাতিসত্তা, আর্থ- সামাজিক, শারীরিক-মানসিক সীমাবদ্ধতা এবং ভৌগোলিক অবস্থান নির্বিশেষে দেশের সকল শিশুর জন্য সমান সুযোগ সৃষ্টি করা হবে। একাজ করা রাষ্ট্রের সাংবিধানিক দায়িত্ব। শিক্ষার এই স্তর পরবর্তী সকল স্তরের ভিত্তি সৃষ্টি করে বলে যথাযথ মানসম্পন্ন উপযুক্ত প্রাথমিক শিক্ষার ব্যবস্থা করা অপরিহার্য। প্রাথমিক শিক্ষার পর অনেকে কর্মজীবন আরম্ভ করে বলে মানসমপন্ন প্রাথমিক শিক্ষা তাদের যথেষ্ট সহায়ক হতে পারে। প্রাথমিক শিক্ষাক্ষেত্রে স্থান ও বিদ্যালয় ভেদে সুযোগ-সুবিধার প্রকট বৈষম্য, অবকাঠামোগত সমস্যা, শিক্ষক-স্বল্পতা ও প্রশিক্ষণের দুর্বলতাসহ বিরাজমান সমস্যাসমূহ দূর করে জাতির সার্বিক শিক্ষার ভিত শক্ত করা হবে। প্রাথমিক শিক্ষা হবে সর্বজনীন, বাধ্যতামূলক, অবৈতনিক এবং সকলের জন্য একই মানের। অর্থনৈতিক, আঞ্চলিক এবং ভৌগোলিক কারণে বর্তমানে শতভাগ শিশুদের প্রাথমিক স্কুলের আওতায় আনা সম্ভব হচ্ছে না, ২০১০-১১ সালের মধ্যে প্রাথমিক স্কুলে ভর্তি ১০০ শতাংশে উন্নীত করা হবে। যে সমস্ত গ্রামে প্রাথমিক বিদ্যালয় নেই সেসকল গ্রামে ন্যূনপক্ষে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় দ্রুত প্রতিষ্ঠা করা হবে। প্রাথমিক শিক্ষার উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য নিম্নরূপ:
হ মানবিক মূল্যবোধের বিকাশ এবং দেশজ আবহ ও উপাদান ভিত্তিক শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক অনুসরণ করা। বিদ্যালয়ে আনন্দময় অনুকূল পরিবেশ তৈরি করে শিশুদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশের ব্যবস্থা করা।
হ কয়েকটি মৌলিক বিষয়ে এক ও অভিন্ন শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যসূচি সব ধরনের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পাঠদান বাধ্যতামূলক করা।
হ শিশুর মনে ন্যায়বোধ, কর্তব্যবোধ, শৃঙ্খলা, শিষ্টাচারবোধ, অসামপ্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি, মানবাধিকার, সহ-জীবনযাপনের মানসিকতা, কৌতূহল, প্রীতি, সৌহার্দ্য, অধ্যবসায় ইত্যাদি নৈতিক ও আত্মিক গুণাবলী অর্জনে সহায়তা করা এবং তাকে বিজ্ঞান ও সংস্কৃতিমনস্ক করা এবং কুসংস্কারমুক্ত মানুষ হিসেবে গড়ে উঠতে উৎসাহিত করা।
হ মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্দীপ্ত করার মাধ্যমে শিক্ষার্থীর দেশাত্মবোধের বিকাশ ও দেশগঠনমূলক কাজে তাকে উদ্বুদ্ধ করা।
হ শিক্ষার্থীর নিজ স্তরের যথাযথ মানসম্পন্ন প্রান্তিক দক্ষতা নিশ্চিত করে তাকে উচ্চতর ধাপের শিক্ষা গ্রহণে উৎসাহী এবং উপযোগী করে তোলা। এই লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় সংখ্যক উপযুক্ত শিক্ষকের ব্যবস্থা করা। এছাড়া ভৌত অবকাঠামো, সামাজিক পারিপার্শ্বিকতা, শিক্ষাদান ও শিক্ষা গ্রহণ পদ্ধতি, শিক্ষকশিক্ষার্থী সমপর্ক আকর্ষণীয় করে তোলা এবং মেয়েদের মর্যাদা সমুন্নত রাখা। ঙ শিক্ষার্থীকে জীবনযাপনের জন্য আবশ্যকীয় জ্ঞান, বিষয়ভিত্তিক দক্ষতা, জীবন-দক্ষতা, দৃষ্টিভঙ্গি, মূল্যবোধ, সামাজিক সচেতনতা অর্জনের মাধ্যমে মৌলিক শিখন চাহিদা পূরণে সমর্থ করা এবং পরবর্তী স্তরের শিক্ষা লাভের উপযোগী করে গড়ে তোলার যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা।
হ শিক্ষার্থীদের মধ্যে কায়িক শ্রমের প্রতি আগ্রহ ও মর্যাদাবোধ এবং বৃত্তিমূলক শিক্ষা সম্বন্ধে প্রাথমিক ধারণা সৃষ্টির লক্ষ্যে ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণীতে প্রাক-বৃত্তিমূলক শিক্ষার ব্যবস্থা করা।
হ প্রাথমিক শিক্ষা স্তরে আদিবাসীসহ সকল ক্ষুদ্র জাতিসত্তার জন্য স্ব স্ব মাতৃভাষা শিক্ষার ব্যবস্থা করা।
হ শিক্ষা ক্ষেত্রে পশ্চাৎপদ এলাকাসমূহে প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়নে বিশেষ নজর দেওয়া।
হ সবধরণের প্রতিবন্ধীসহ সুযোগ-সুবিধা বঞ্চিত ছেলেমেয়েদের জন্য সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করে সকল শিক্ষার্থীর জন্য সমান সুযোগ সৃষ্টির লক্ষ্যে ব্যবস্থা গ্রহণ করা।
কৌশল
রাষ্ট্রের দায়িত্ব
সকলের জন্য মৌলিক শিক্ষা নিশ্চিত করার তাগিদ সংবিধানে বিধৃত আছে। তাই প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থাপনা সমপূর্ণভাবে রাষ্ট্রের দায়িত্ব এবং রাষ্ট্রকেই এই দায়িত্ব পালন করতে হবে। প্রাথমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের জাতীয়করণ প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকবে। প্রাথমিক শিক্ষার দায়িত্ব বেসরকারি বা এনজিও খাতে হস্তান্তর করা যাবে না। কোনো ব্যক্তি বা বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বা কোনো এনজিও প্রাথমিক শিক্ষাদানকল্পে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করতে চাইলে তা যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমতি সাপেক্ষে রাষ্ট্রীয় বিধি-বিধান পালন করে করতে হবে।
প্রাথমিক শিক্ষার মেয়াদ ও বাস্তবায়ন
১. প্রাথমিক শিক্ষার মেয়াদ পাঁচ বছর থেকে বৃদ্ধি করে আট বছর অর্থাৎ অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত সম্প্রসারন করা হবে। এটি বাস্তবায়নে দু’টি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো অবকাঠামোগত আবশ্যকতা মেটানো এবং প্রয়োজনীয়সংখ্যক উপযুক্ত শিক্ষকের ব্যবস্থা করা।
২০১১-১২ অর্থ বছর থেকে প্রাথমিক শিক্ষায় ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত চালু করার জন্য অনতিবিলম্বে নিম্নলিখিত পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে:
প্রথম থেকে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত প্রাথমিক শিক্ষার নতুন শিক্ষাক্রম, পাঠ্যপুস্তক এবং শিক্ষক নির্দেশিকা প্রণয়ন করা;
প্রাথমিক পর্যায়ের সকল শিক্ষকের জন্য শিক্ষাক্রম বিস্তারসহ শিখন-শেখানো কার্যক্রমের ওপর ফলপ্রসূ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা;
শিক্ষা প্রশাসন ও ব্যবস্থাপনার প্রয়োজনীয় পুনর্বিন্যাস করা।
প্রাথমিক শিক্ষার এই পুনর্বিন্যাসের জন্য প্রাথমিক পর্যায়ের সকল বিদ্যালয়ের ভৌত সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি এবং শিক্ষকের সংখ্যা বাড়ানো হবে। যথাযথ পদ্ধতি অনুসরণ করে আট বছরব্যাপী প্রাথমিক শিক্ষা বাস্তবায়ন ২০১৮-এর মধ্যে ছেলে-মেয়ে, আর্থ-সামাজিক অবস্থা এবং জাতিসত্তা নির্বিশেষে পর্যায়ক্রমে সারা দেশের সকল শিশুর জন্য নিশ্চিত করা হবে।
বিভিন্ন ধারার সমন্বয়
২. একই পদ্ধতির মৌলিক শিক্ষা নিশ্চিত করার অঙ্গীকার বাংলাদেশের সংবিধানে ব্যক্ত করা হয়েছে। সাংবিধানিক তাগিদে বৈষম্যহীন শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করার লক্ষ্যে সমগ্র দেশে প্রাথমিক স্তরের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নির্ধারিত বিষয়সমূহে এক ও অভিন্ন শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যসূচি প্রবর্তন করা হবে। অর্থাৎ প্রাথমিক শিক্ষার বিভিন্ন ধারা যথা সরকারি ও বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, কিন্ডারগার্টেন (বাংলা ও ইংরেজি মাধ্যম), ইবতেদায়িসহ সবধরণের মাদরাসার মধ্যে সমন্বয় ঘটানোর জন্য এই ব্যবস্থা চালু করা হবে। নির্ধারিত বিষয়সমূহ ছাড়া অন্যান্য নিজস্ব কিংবা অতিরিক্ত বিষয় শিক্ষা সংশ্লিষ্ট অধিদপ্তরের অনুমতিসাপেক্ষে বিভিন্ন ধারায় সন্নিবেশ করা যাবে।
৩. শিক্ষার মান ও শিক্ষার্থীদের দক্ষতা উন্নয়নের লক্ষ্যে ইবতেদায়িসহ সবধরণের মাদরাসাসমূহ আট বছর মেয়াদি প্রাথমিক শিক্ষা চালু করবে এবং প্রাথমিক স্তরের নতুন সমন্বিত শিক্ষা কর্মসূচি বাস্তবায়ন করবে।
৪. বিভিন্ন ধরনের (কমিউনিটি বিদ্যালয়, রেজিস্ট্রিকৃত নয় এমন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, রেজিস্ট্রিকৃত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, কিন্ডারগার্টেন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, গ্রামীণ ও শহুরে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান) প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মধ্যে সুযোগ-সুবিধার যে প্রকট বৈষম্য বিরাজমান তা দূরীকরণের লক্ষ্যে পদক্ষেপ নেওয়া হবে। সাধারণ, কিন্ডারগার্টেন,ইংরেজী মাধ্যম ও সবধরণের মাদরাসা সহ সকল প্রাথমিক বিদ্যালয়কে নিয়মনীতি মেনে যথাযথ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বাধ্যতামূলকভাবে নিবন্ধন করতে হবে।
শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যসূচি
৫. প্রাথমিক স্তরে শিক্ষার ধারা নির্বিশেষে সকল শিক্ষার্থীকে নির্দিষ্ট শ্রেণীর পাঠ্যসূচি অনুযায়ী নির্ধারিত বিষয়সমূহ অর্থাৎ বাংলা, ইংরেজি, নৈতিক শিক্ষা, বাংলাদেশ স্টাডিজ, গণিত, সামাজিক পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তনের ধারণাসহ প্রাকৃতিক পরিবেশ পরিচিতি এবং তথ্যপ্রযুক্তি ও বিজ্ঞান বাধ্যতামূলকভাবে পড়তে হবে। সকল বিষয়ের শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যসূিচ প্রণয়নের জন্য একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করা হবে। উক্ত কমিটি যথাযথ পর্যালোচনার মাধ্যমে শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যসূিচ প্রণয়ন করবে। সর্বত্র অবকাঠামো তৈরি এবং কম্পিউটার সরবরাহ ও কম্পিউটার শিক্ষক নিয়োগ না দেওয়াপর্যন্ত তথ্যপ্রযুক্তি শিক্ষা ও মূল্যায়ন, তথ্যপ্রযুক্তি-সহজপাঠ ও অনুশীলন পুস্তকভিত্তিক হবে। মানসম্পন্ন ইংরেজি লিখন-কথনের লক্ষ্যে যথাযথ কার্যক্রম শুরু থেকেই গ্রহণ করা হবে এবং ক্রমান্বয়ে ওপরের শ্রেণীসমূহে প্রয়োজনানুসারে জোরদার করা হবে। প্রথম শ্রেণী থেকে সহশিক্ষাক্রম বিষয় থাকতে পারে। প্রাথমিক স্তর থেকে নিজ নিজ ধর্ম ও নৈতিক শিক্ষা বাধ্যতামুলক করা হবে। প্রাথমিক স্তরের শেষ তিন শ্রেণীতে অর্থাৎ ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের জীবন পরিবেশের উপযোগী প্রাকবৃত্তিমূলক এবং তথ্যপ্রযুক্তি শিক্ষা প্রদান করা হবে, যাতে যারা কোনো কারণে আর উচ্চতর পর্যায়ে পড়বে না এ শিক্ষার ফলে তাদের কর্মসংস্থানের সুযোগ হতে পারে।
ভর্তির বয়স
৬. বর্তমানে চালু ৬+ বছর বয়সে প্রথম শ্রেণীতে ভর্তির নিয়ম বাধ্যতামূলক করা হবে।
৭. প্রাথমিক শিক্ষায় শিক্ষক-শিক্ষার্থীর অনুপাত হবে ১ : ৩০। এ লক্ষ্য পর্যায়ক্রমে ২০১৮ সালের মধ্যে অর্জন করা হবে।
বিদ্যালয়ের পরিবেশ
৮. প্রাথমিক স্তরের শিক্ষক/শিক্ষিকার আচরণ যেন শিক্ষার্থীদের কাছে বিদ্যালয়কে আকর্ষণীয় করে তোলে সেদিকে নজর দেওয়া হবে এবং শিক্ষা পদ্ধতি হবে শিক্ষার্থীদের জন্য আনন্দদায়ক, চিত্তাকর্ষক, পঠনে আগ্রহ সৃষ্টির সহায়ক।
৯. সকল বিদ্যালয়ে শিক্ষাদান ও গ্রহণ এবং শিক্ষার্থীর সুরক্ষার অনুকুল পরিবেশ সৃষ্টি করা হবে।
শিক্ষা-সামগ্রী
১০. প্রাথমিক শিক্ষার নির্ধারিত উদ্দেশ্যাবলীর ভিত্তিতে শিক্ষাক্রম-কাঠামো অনুযায়ী জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড প্রাথমিক পর্যায়ের জন্য পৃথক বিষয়-ভিত্তিক প্রান্তিক যোগ্যতা এবং শ্রেণীগত যোগ্যতা নির্ধারণ করে বিষয়-ভিত্তিক শিক্ষা সামগ্রী যথা পাঠ্যপুস্তক এবং প্রয়োজনবোধে সম্পূরক পঠন সামগ্রী এবং অনুশীলন পুস্তক ও শিক্ষক সহায়িকা (বিশ্লেষণ, উদাহরণ ও অনুশীলন সংবলিত পুস্তক) প্রণয়ন করবে। সকল পাঠ্যপুস্তক সহজ ও সাবলীল ভাষায় রচিত, আকর্ষণীয় এবং নির্ভুল করা হবে। দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের জন্য ব্রেইল পদ্ধতিতে পাঠ্যপুস্তকের ব্যবস্থা করা হবে।
ঝরে পড়া সমস্যার সমাধান
১১. দরিদ্র ছেলেমেয়েদের জন্য উপবৃত্তি সম্প্রসারণ করা হবে।
১২. স্কুলের পরিবেশ আকর্ষণীয় ও আনন্দময় করে তোলা হবে। এই লক্ষ্যে শিক্ষার্থীদের জন্য খেলাধুলার সুব্যবস্থা, সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড, শিক্ষার্থীদের প্রতি শিক্ষকদের আগ্রহ, মমত্ববোধ ও সহানুভূতিশীল আচরণ এবং পরিচ্ছন্ন ভৌত পরিবেশসহ উল্লেখযোগ্য উপকরণের উন্নয়ন ঘটানো হবে। ছেলে-মেয়ে শিক্ষার্থীদের জন্য মানসম্পন্ন পৃথক টয়লেটের ব্যবস্থা করা হবে। শারীরিক শাস্তি সম্পূর্ণরূপে বিলুপ্ত করা হবে।
১৩. দুপুরের খাবার ব্যবস্থা করা জরুরি। পিছিয়ে পড়া এলাকাসহ গ্রামীণ সকল বিদ্যালয়ে দুপুরে খাবার ব্যবস্থা পর্যায়ক্রমে চালু করা হবে।
১৪. পাহাড়ি এলাকায় এবং দূরবর্তী ও প্রত্যন্ত অঞ্চলের ছেলেমেয়েদের জন্য বিদ্যালয়ে হোস্টেলের ব্যবস্থা করার দিকে নজর দেওয়া হবে।
১৫. হাওর, চর এবং একসঙ্গে বেশ কিছুদিন ধরে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের শিকার হয় এমন এলাকার বিদ্যালয়ে সময়সূিচ এবং ছুটির দিনসমূহের পরিবর্তন করার সুযোগ থাকবে। এ সকল বিষয়ে স্থানীয় সমাজভিত্তিক তদারকি ব্যবস্থার সুপারিশে স্থানীয় পর্যায়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে।
১৬. মেয়ে শিশুদের মধ্যে ঝরে পড়ার প্রবণতা তুলনামূলকভাবে অধিক হওয়ায় তারা যাতে ঝরে না পড়ে সেদিকে বিশেষ নজর দেওয়া হবে। মেয়ে শিক্ষার্থীরা যেন বিদ্যালয়ে কোনোভাবে উত্যক্ত না হয় তা নিশ্চিত করা হবে।
১৭. বর্তমানে পঞ্চম শ্রেণী শেষ করার আগে প্রায় অর্ধেক এবং যারা পরবর্তী পর্যায়ে যায় তাদের প্রায় ৪০ শতাংশ দশম শ্রেণী শেষ করার আগে ঝরে পড়ে। ঝরে পড়া দ্রুত কমিয়ে আনা জরুরি। ২০১৮ সালের মধ্যে সকল শিক্ষার্থী যেন অষ্টম শ্রেণী শেষ করে সেই লক্ষ্যে উপর্যুক্ত পদক্ষেপগুলোসহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা দ্রুত গ্রহণ করা হবে।
আদিবাসী শিশু
১৮. আদিবাসী শিশুরা যাতে নিজেদের ভাষা শিখতে পারে সেই লক্ষ্যে তাদের জন্য আদিবাসী শিক্ষক ও পাঠ্যপুস্তকের ব্যবস্থা করা হবে। এই কাজে, বিশেষ করে পাঠ্যপুস্তক প্রণয়নে, আদিবাসী সমাজকে সমপৃক্ত করা হবে।
১৯. আদিবাসী প্রান্তিক শিশুদের জন্য বিশেষ সহায়তার ব্যবস্থা করা হবে।
২০. আদিবাসী অধ্যুষিত (পাহাড় কিংবা সমতল) যেসকল এলাকায় প্রাথমিক বিদ্যালয় নেই সেসকল এলাকায় প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপন করা হবে। যেহেতু কোনো কোনো এলাকায় আদিবাসীদের বসতি হালকা তাই একটি বিদ্যালয়ে পর্যাপ্ত শিক্ষার্থী ভর্তি হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি করার লক্ষ্যে শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের আবাসিক ব্যবস্থার প্রয়োজন হলে সেদিকেও নজর দেওয়া হবে।
প্রতিবন্ধী শিশু
২১. সবধরণের প্রতিবন্ধীর জন্য প্রয়োজনানুসারে বিদ্যালয়গুলোতে প্রতিবন্ধীবান্ধব সুযোগ-সুবিধা, যেমন- শৌচাগার ব্যবহারসহ চলাফেরা করা ও অন্যান্য সুযোগ নিশ্চিত করা হবে।
২২. প্রতিবন্ধীদের বিশেষ প্রয়োজনকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বিশেষ বিবেচনা করা হবে।
২৩. প্রত্যেক পিটিআইতে বিভিন্ন ধরণের প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের জন্য শিক্ষাদান পদ্ধতির উপর কমপক্ষে একজন প্রশিক্ষককে প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। পথশিশু ও অন্যান্য অতিবঞ্চিত শিশু
২৪. এদেরকে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আনার এবং ধরে রাখার লক্ষ্যে বিনা খরচে ভর্তির সুযোগ, বিনামূল্যে শিক্ষা উপকরণ সরবরাহ, দুপুরের খাবার ব্যবস্থা এবং বৃত্তিদানসহ বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। বিদ্যালয়ে তাদের সুরক্ষার জন্য কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
বিভিন্ন ধরনের এবং এলাকার প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মধ্যে বিদ্যমান প্রকট বৈষম্য
২৫. এই বৈষম্য ধাপে ধাপে কমিয়ে আনা হবে। সেই লক্ষ্যে অপেক্ষাকৃত পিছিয়ে পড়া এলাকাসমূহে অবস্থিত স্কুলসহ গ্রামীণ বিদ্যালয়সমূহকে পরিকল্পিত কর্মসূচির ভিত্তিতে বিশেষ সহায়তা দেওয়া হবে, যাতে কয়েক বছরের মধ্যে বৈষম্য নিরসনে উল্লেখযোগ্য উন্নতি ঘটে।
শিক্ষণ পদ্ধতি
২৬. শিশুর সৃজনশীল চিন্তা ও দক্ষতার প্রসারের জন্য সক্রিয় শিক্ষণ-পদ্ধতি অনুসরণ করে শিক্ষার্থীকে এককভাবে বা দলগতভাবে কার্য সম্পাদনের সুযোগ দেওয়া হবে। ফলপ্রসূ শিক্ষাদান পদ্ধতি উদ্ভাবন, পরীক্ষণ ও বাস্তবায়নের জন্য গবেষণা উৎসাহিত করা হবে এবং সেজন্য সহায়তা দেওয়া হবে।
শিক্ষার্থী মূল্যায়ন
২৭. প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীতে ধারাবাহিক মূল্যায়ন এবং তৃতীয় থেকে সকল শ্রেণীতে ত্রৈমাসিক, অর্ধবার্ষিক ও বার্ষিক পরীক্ষা চালু থাকবে। পঞ্চম শ্রেণী শেষে উপজেলা/ পৌরসভা/থানা (বড় বড় শহর) পর্যায়ে সকলের জন্য অভিন্ন প্রশ্নপত্রে সমাপনী পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে। অষ্টম শ্রেণী শেষে আপাতত: জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট পরীক্ষা নামে একটি পাবলিক পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে এবং এই পরীক্ষা সংশ্লিষ্ট শিক্ষা বোর্ড দ্বারা পরিচালিত হবে।
বিদ্যালয়ের উন্নতি ও শিক্ষার মানোন্নয়নে তদারকি এবং তাতে জনসম্পৃক্ততা
২৮. বিদ্যালয়ের উন্নয়ন কর্মকান্ডে সমাজের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার জন্য যথাযথ বিবেচনার ভিত্তিতে নির্বাচিত ও পদাধিকারবলে অন্তর্ভুক্ত সদস্য সম্বলিত ব্যবস্থাপনা কমিটিকে আরো সক্রিয় করার লক্ষ্যে বিদ্যালয় ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে কমিটিকে প্রয়োজনে আরো ক্ষমতা দেওয়া হবে। তবে পাশাপাশি কমিটির জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা হবে।
২৯. সক্রিয় অভিভাবক-শিক্ষক কমিটি প্রতিষ্ঠা করে অভিভাবকদেরকে বিদ্যালয় এবং তাঁদের ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার বিষয়ে আরো উৎসাহী করার পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
শিক্ষক নিয়োগ ও শিক্ষকদের পদোন্নতি
৩০. প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণীর শিক্ষক নিয়োগের সর্বনিম্ন সাধারণ যোগ্যতা হবে দ্বিতীয় বিভাগসহ এইচএসসি বা সমমানের পরীক্ষা পাশ এবং ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণীর জন্য দ্বিতীয় বিভাগসহ স্নাতক ডিগ্রিধারী মহিলা বা পুরুষ। তবে নিচের শ্রেণীতে মহিলা শিক্ষকদের প্রাধান্য দেওয়া হবে। যোগদানের পর সর্বোচ্চ তিন বছরের মধ্যে এ সকল শিক্ষককে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করতে হবে এবং সি-ইন-এড/বি.এড অর্জন করতে হবে। প্রধান শিক্ষকের সরাসরি নিয়োগের জন্য ন্যূনতম যোগ্যতা হবে দ্বিতীয় বিভাগে স্নাতক বা সমমানের ডিগ্রি; এবং যোগদানের পর সর্বোচ্চ তিন বছরের মধ্যে সি-ইন-এড বা বি.এড (প্রাইমারি) ডিগ্রি অর্জন করতে হবে। শিক্ষকদের স্তর এবং বেতন স্কেল যথোপোযুক্ত বিন্যাস করে (যথা- সহকারী শিক্ষক, সহকারী প্রধান শিক্ষক, প্রধান শিক্ষক) তাদের পদোন্নতির সুযোগ সৃষ্টি করে শিক্ষকদের উৎসাহিত করা হবে। অর্থনৈতিক বাস্তবতা এবং জাতির ভবিষ্যৎ গঠনে শিক্ষকদের গুরুত্ব ও মর্যাদা বিবেচনায় নিয়ে তাদের বেতন-ভাতা নির্ধারণ করা হবে; পাশাপাশি তাদের জবাবদিহিতাও নিশ্চিত করা হবে।
৩১. শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের বিভিন্ন কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে এবং কর্মকালীন প্রশিক্ষণের সুযোগ সৃষ্টি করা হবে। প্রয়োজনবোধে ও সম্ভাব্যক্ষেত্রে বিদেশে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হবে। দেশে প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানগুলোর দক্ষতা ও প্রশিক্ষণ ক্ষমতা বাড়ান হবে।
৩২. শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের সঙ্গে পদোন্নতির যোগসূত্র স্থাপন করা আবশ্যক বলে উচ্চতর ডিগ্রিধারী এবং প্রশিক্ষিত যোগ্যতাসম্পন্নব্যক্তিদের সরাসরি নিয়োগ এবং ত্বরান্বিত পদোন্নতির মাধ্যমে উচ্চতর পদ পূরণের ব্যবস্থা করা হবে। প্রয়োজনে পদ উন্নীত (আপগ্রেইডিং) করা হবে। তবে এর জন্য যথাযথ বিধি-বিধান তৈরি করা হবে।
শিক্ষক নির্বাচন
৩৩. সরকারি অনুমোদন ও আর্থিক সহায়তাপ্রাপ্ত বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও ইবতেদায়ি মাদরাসা সমূহের জন্য মেধাভিত্তিক ও উপযুক্ত শিক্ষক নির্বাচনের লক্ষ্যে সরকারি কর্মকমিশনের অনুরূপ একটি বেসরকারি শিক্ষক নির্বাচন কমিশন গঠন করা হবে। এই কমিশন শিক্ষা ও প্রশাসনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গের সমন্বয়ে গঠিত হবে। যথাযথ লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষার মাধ্যমে কমিশন শিক্ষক নির্বাচন প্রক্রিয়া সম্পাদন করবে। এই নির্বাচন উপজেলা বা জেলা ভিত্তিক হবে। কমিশন দ্বারা নির্বাচিতদের মধ্য থেকে যথাযথ নিয়োগদানকারী কর্তৃপক্ষ বিভিন্ন বিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগ দেবে। বিদ্যালয়গুলোতে প্রত্যেক বছর কতজন শিক্ষক প্রয়োজন তা উপজেলা/থানা ভিত্তিক সমন্বয় করে কমিশনকে জানাবে- আর এই ভিত্তিতে এক বছরের জন্য বিষয়ওয়ারী শিক্ষক নির্বাচনের উপজেলা/থানা ভিত্তিক লক্ষ্য স্থির করা হবে। এই কমিশনকে মাধ্যমিক ও বেসরকারি (সরকারি সাহায্যপ্রাপ্ত) ডিগ্রি কলেজের শিক্ষক নির্বাচনের দায়িত্ব দেওয়া হবে।
বিদ্যালয়ে শিক্ষাদানের তত্ত্বাবধান ও পরিবীক্ষণ
৩৪. বিদ্যালয়ে অভ্যন্তরীণ তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব মূলত প্রধান শিক্ষকের ওপর; তাই এই দায়িত্ব দক্ষতার সাথে যাতে প্রধান শিক্ষকগণ পালন করতে পারেন সেজন্য তাঁদেরকে বিশেষ প্রশিক্ষণ দেওয়া প্রয়োজন। বিদ্যালয়ের বহিঃতত্ত্বাবধানের ও পরিবীক্ষণের কাজ যথাসম্ভব বিকেন্দ্রীকরণ করা আবশ্যক। একাজে নিয়োজিত কর্মকর্তাদেরকে (যেমন- এটিপিও) বাস্তবসম্মতভাবে বিদ্যালয়ের সংখ্যা নির্ধারণ করে দেওয়া হবে যাতে তাঁরা তত্ত্বাবধায়ন ও পরিবীক্ষনের দায়িত্ব সুষ্ঠুভাবে পালন করতে পারেন।
অন্যান্য
৩৫. প্রাথমিক শিক্ষার সর্বজনীন বিস্তারের জন্য প্রয়োজনীয় সংখ্যক বিদ্যালয় স্থাপন করে বিভিন্ন সুযোগসুবিধা বাড়ান হবে। কোন্‌ গ্রামে বিদ্যালয় নেই বা কোন্‌ গ্রামে আরো বিদ্যালয় প্রয়োজন তা জরিপের মাধ্যমে স্থির করে বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ব্যবস্থা করা হবে।
৩৬. ন্যাশনাল একাডেমী ফর প্রাইমারি এডুকেশন (নেপ)-কে অভীষ্ট মানের শীর্ষ পর্যায়ের জাতীয় প্রতিষ্ঠানে পরিণত করতে হবে যেন তা কার্যকরভাবে প্রাথমিক শিক্ষার মানোন্নয়নে বিভিন্ন উদ্ভাবনমূলক কার্যক্রম সম্পন্ন করতে পারে। এক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপগুলোর মধ্যে রয়েছে: পিটিআইগুলোর অ্যাকাডেমিক স্টাফদের এবং মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তা ও প্রকল্পভুক্ত অন্যান্য কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ, মৌলিক শিক্ষক প্রশিক্ষণের শিক্ষাক্রম তৈরি ও অনুমোদন, প্রশিক্ষণ তত্ত্বাবধান, প্রশিক্ষণার্থীদের পরীক্ষা পরিচালনা ও ডিপ্লোমা প্রদান করা, প্রাথমিক শিক্ষার মানোন্নয়নের লক্ষ্যে গবেষণা, কর্মশালা, সম্মেলন পরিচালনা ইত্যাদি।
৩৭. সবার জন্য মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সমগ্র জাতিকে সর্বশক্তি নিয়োজিত করতে হবে।
৩৮. শিক্ষার্থীদের মধ্যে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসংক্রান্ত প্রয়োজনীয় আচরণিক সচেতনতা (যেমন নখ কাটা, হাত ধোয়া, দাঁত পরিস্কার করা ইত্যাদি) সৃষ্টি করার ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
জাতীয় শিক্ষা নীতি-২০১০ এ প্রাথমিক শিক্ষার উদ্দেশ্য, লক্ষ্য,কৌশল, রাষ্ট্রের দায়িত্ব,প্রাথমিক শিক্ষার মেয়াদ ও বাস্তবায়ন, বিভিন্ন ধারার সমন্বয়, শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যসূচি, ভর্তির বয়স, বিদ্যালয়ের পরিবেশ, শিক্ষা-সামগ্রী, ঝরে পড়া সমস্যার সমাধান, আদিবাসী শিশু, প্রতিবন্ধী শিশু, বিভিন্ন ধরনের এবং এলাকার প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মধ্যে বিদ্যমান প্রকট বৈষম্য, শিক্ষণ পদ্ধতি, শিক্ষার্থী মূল্যায়ন, বিদ্যালয়ের উন্নতি ও শিক্ষার মানোন্নয়নে তদারকি এবং তাতে জনসম্পৃক্ততা, শিক্ষক নিয়োগ ও শিক্ষকদের পদোন্নতি, শিক্ষক নির্বাচন, বিদ্যালয়ে শিক্ষাদানের তত্ত্বাবধান ও পরিবীক্ষণ এবং অন্যান্য সকল বিষয়ে সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা প্রদান করা হয়েছে। জাতীয় শিক্ষা নীতি-২০১০ বাস্তবায়িত হলে, জাতির পিতার স্বপ্ন তরুণ প্রজন্ম প্রকৃত শিক্ষা, জ্ঞান, প্রযুক্তিতে দক্ষ একই সংগে নৈতিক মূল্যবোধ, জনগণের প্রতি শ্রদ্ধাশীল, দায়বদ্ধ এবং দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ মানব সম্পদ হিসাবে গড়ে উঠবে।
তথ্য সূত্র- জাতীয় শিক্ষা নীতি-২০১০।

লেখক : সভাপতি, রেলপথ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি, বাংলাদেশ জাতীয় সংসদ।

পূর্ববর্তী নিবন্ধবঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন ও অর্থনীতির বর্তমান স্বরূপ
পরবর্তী নিবন্ধজাতিসংঘ অধিবেশনে যোগ দিতে নিউইয়র্কে প্রধানমন্ত্রী