জাগো নারী

সালমা বিনতে শফিক | শনিবার , ১৮ সেপ্টেম্বর, ২০২১ at ৬:০০ পূর্বাহ্ণ

মার্কিন কৃষ্ণাঙ্গ নাগরিক ফ্লয়েড জর্জকে হাঁটু চাপা দিয়ে মেরে ফেলার অপরাধে শ্বেতাঙ্গ পুলিশ ডেরেক চৌভিনকে বাইশ বছরের কারাদন্ড দেয় আদালত, যদিও এ সাজা যথেষ্ট নয় বলে মিনেসোটা অঙ্গরাজ্যের অ্যাটর্নি জেনারেল মত প্রকাশ করেছেন। হত্যাকান্ডের তের মাসের মাথায় বিচার কাজ সমাধা হয়। এরই নাম আইনের শাসন। অবশ্য মার্কিন মুল্লুকে বে-আইনি কাজকর্ম একেবারে হয় না, তা নয়। তবে আমেরিকার আইনের শাসন নিয়ে রচনা লেখা এ প্রবন্ধের উদ্দেশ্য নয়। পৃথিবীর কোটি কোটি মানুষের মতো ফ্লয়েড জর্জকে হাঁটু চাপা দেওয়ার সেই পৈশাচিক দৃশ্য দেখেছিলেন ডেরেকের স্ত্রীও। তৎক্ষণাৎ সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন তিনি এই দানবের সঙ্গে ঘর করা চলে না। অতঃপর বিবাহবিচ্ছেদ।
অপরদিকে আমাদের সমাজে হত্যা, দুর্নীতি, অনৈতিকতাসহ যাবতীয় সমাজবিরোধী অপকর্মে জড়িত থেকে সম্পদের পাহাড় গড়া নাগরিকদের পাশে অবস্থান করে স্ত্রীধর্ম পালন করে যান হাজার হাজার নারী। অনেকের পক্ষে হয়তো জীবনের জটিল চক্র ভেদ করে বেরিয়ে আসা সম্ভব হয় না। তবে অনেকে কেবলমাত্র স্বাচ্ছন্দ আর উচ্চ সামাজিক মর্যাদার লোভে স্বামীর পাশে থাকে, তাকে সমর্থন দেয়, আগলে রাখে, আবার কেউ কেউ তার সকল অপকর্মের সহযোগী হয়ে নারীজনমের সার্থকতা খুঁজে পায়। ধর্ষক পুরুষ সমর্থন লাভ করে স্ত্রী, বোন এমনকি মায়ের কাছ থেকেও। নিজের সন্তানের সুখের জন্য অন্যের সন্তানের প্রাণহানির আয়োজনে অবলীলায় সায় দেয় অনেক মা! পরিবারের সমর্থন ও আশ্রয় পেয়ে অপরাধী হয়ে ওঠে দুর্বিনীত, দুর্র্ধর্ষ। আইনকে নিজের করে নিতে বাঁধে না তাদের। সমাজে তাই অপরাধীদের দোর্দন্ড প্রতাপ। তাদের ভয়ে প্রাণ হাতে পালিয়ে বেড়ায় ফরিয়াদি ও তার স্বজন।
এমনি করেই কি আমাদের সমাজে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হবে, শান্তি-শৃঙ্খলা ফিরে আসবে, আগামী প্রজন্ম স্বপ্নের সোনার বাংলার দেখা পাবে? সকল দুর্ভোগের জন্য এককভাবে পুরুষকে দায়ী করেই কি দায়মুক্ত হব আমরা? কেবল পুরুষতান্ত্রিকতা নয়, নারীজাতির অবমাননা ও সামাজিক অমর্যাদার জন্য নারীদের ভূমিকাও কম নয়। গত কয়েকদিনের খবরের কাগজে নারী শিক্ষক, নারী চিকিৎসক, নারী প্রকৌশলী, নারী আইনজীবীর অপঘাতে মৃত্যুর খবর এসেছে, একই সঙ্গে এসেছে উচ্চ শিক্ষিত নারীর হাতে গৃহকর্মী নির্যাতনের খবরও। স্ত্রী নির্যাতন ও হত্যায় অধিকাংশ পুরুষই মা-বোনের সমর্থন পেয়ে থাকে। এখন নারীশিক্ষা, নারীবাদ, নারীর ক্ষমতায়ন- পরিণত হয়েছে নিছক বিজ্ঞাপনের ভাষায়। ছুরিকাঘাতে নিহত নারী শিক্ষক, গলাকাটা চিকিৎসক, ঝুলন্ত প্রকৌশলী, রক্তাক্ত আইনজীবী, শ্বাসরুদ্ধ সংবাদকর্মীর খবর ও ছবি দেখে আমরা আজকাল খুব একটা বিচলিত হই না। অনেকটা এমন- আহারে মরেই গেল! যাক, আমি তো বেঁচে আছি। এবারেও বিবাহ বার্ষিকীটা জাঁকজমকের সঙ্গে উদযাপন করা গেল না। কতদিন শপিং-এ যাই না! পার্লারে যাওয়া বন্ধ সেই কবে থেকে! সপ্তাহান্তে রেস্তোরাঁয় খেতে যেতে পারি না। ‘বোরড’ হয়ে গেছি ঘরে থেকে থেকে। কবে যে মুক্তি মিলবে করোনা থেকে ! … এমনই প্রাণহীন হয়ে গেছে সমাজ, সেই সঙ্গে নারীরাও। যে যার ব্যক্তিগত সুখ-দুঃখের একান্ত বলয়ের পাঁকে বন্দি। একের দুঃখে অন্যের প্রাণ কাঁদে না। পৃথিবী মুমূর্ষু। আমাদের মেয়েরা আজও মেতে আছে সৌন্দর্যের অধিকারের লড়াই-এ।
এবার একটু সিনেমার কথা হোক। কারণ সিনেমাতো জীবনের কথা বলে, সমাজের কথা বলে। অমর চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়ের ‘সীমাবদ্ধ’ ছায়াছবিতে একজন মেধাবী আটপৌরে শিক্ষকের ধনবান কর্পোরেট বনে যাওয়ার গল্প। উচ্চমাধ্যমিকের গন্ডি পেরোনো নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের কন্যা শিক্ষক স্বামীর সঙ্গে সুখেই সংসার করছিল। তবে স্বামীর বিদেশি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ব্যবসা এবং সেই সূত্রে একটু একটু করে জীবনের মানোন্নয়নে কোন প্রশ্নই জাগে না তার মনে। প্রাণভরে উপভোগ করে যায় বদলে যাওয়া জীবনের স্বাচ্ছন্দ, আরাম, বিলাস। বি এ পরীক্ষা দেওয়ার কথা দু’এক বার মনের কোনে উঁকি দিলেও ‘ম্যাগাজিন’ ছাড়া অন্য বইয়ের পাতা ওলটাতে মন চায় না। শপিং, পার্টি, পার্লার নিয়েই দিন কাটে তার। একমাত্র সন্তানকে দূরের শহরের আবাসিক বিদ্যালয়ে পাঠিয়ে নিশ্চিত করে তার উন্নত ভবিষ্যৎ। লোক লাগিয়ে, নাটক সাজিয়ে কারখানার শ্রমিকের রক্ত ঝরিয়ে পদন্নোতি নিশ্চিত করে তার জ্ঞানবান, ভালমানুষ স্বামী, যিনি কোন অপকর্মের চিহ্ন রাখেন না, কাদায় নেমে নিজের হাত নোংরা করেন না। গরবিনী স্ত্রী বাড়িতে উর্দিধারী বাবুর্চি থাকা সও্েবও নিজ হাতে রান্না করে উদযাপন করে স্বামীর গৌরব। অন্তত পঞ্চাশ বছর আগে নির্মিত এই ছায়াছবির গল্প আজও এতটুকু সেকেল হয়ে যায়নি।
সত্যজিতের আরেক চলচ্চিত্র ‘মহানগর’ এ শহরতলীর এঁদো গলির এক নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের চোখ দিয়ে দেখা হয় আনন্দনগরী কলকাতার বর্ণিল রূপ। মাধ্যমিকের চৌকাঠ পেরোনো, একান্নবর্তী পরিবারের আটপৌরে গৃহিণী আরতি ব্যাংক কর্মচারী স্বামীর পাশে দাঁড়ানোর জন্য অনেক সংগ্রাম করেই একটা চাকরি খুঁজে নেয়। দুজনের আয়ে সুদিন আসবে, এমন মুহূর্তে স্বামী হন চাকরিহারা। আরতি’র চাকরিদাতার দয়ার শরীর। তার বেতন বাড়িয়ে দিতে সম্মত হন। এমনকি স্বামীর জন্য চাকরির ব্যবস্থা করে দেবার আশ্বাসও দেন। এমতাবস্থায় আরতির এক অ্যাংলো ইন্ডিয়ান সহকর্মীকে বিনা অপরাধে চাকরিচ্যুত করা হলে প্রতিবাদ জানায় আরতি। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে সেই সহকর্মীর কাছে ক্ষমা চাইতে বলে। আরতির ধৃষ্টতায় অবাক হলেও চাকরিদাতা তার দাবি মেনে নিতে অস্বীকৃতি জানায়। এক মুহূর্তও না ভেবে পদত্যাগপত্র জমা দিয়ে বের হয়ে আসে আরতি। আরতির সান্ত্বনা এই যে- এই দুঃসময়ে স্বামী তার পাশেই থাকে।
তবে আজকের সমাজে আরতিদের দেখা তেমন পাওয়া যায় না, কারণ এখন সময় মিসেস চ্যাটার্জিদের। বিবেকহীন, ভোগবিলাসে মত্ত মোহনীয় নারীরা স্বামীর পাশে থেকে সৌন্দর্য বর্ধন করেই জীবনের সার্থকতা খুঁজে পেতে চায়, যদিও শেষ অবধি সার্থকতার দেখা পায় না অনেকেই। আইনের চোখকে ফাঁকি দেওয়ার জন্য স্বামীরা অগাধ সম্পদ, টাকা-কড়ি, দালান-কোঠা, সোনা-দানা লিখে দেয় স্ত্রীদের নামে। এই প্রতারণাকে ভালবাসার দান ভেবে আত্মতৃপ্তিতে বুঁদ হয়ে থাকে, এমনই বোধবুদ্ধিহীন ও অথর্ব প্রাণীতে পরিণত হয়েছে আমাদের উঁচুতলার অনেক শিক্ষিত মেয়ে, যদিও নিজেরা তা উপলব্ধি করতে পারে না।
এখন থেকে অন্তত দেড়শ বছর আগে বেগম রোকেয়া মেয়েদের পড়তে বলেছিলেন, মেয়েদের লেখাপড়ার সুযোগ সৃষ্টি করার জন্য সমাজের সঙ্গে যুদ্ধ করেছেন, বিপ্লব ঘটিয়েছেন, সমাজপতিদের গালমন্দ হজম করেছেন। তাই তাঁকে ‘নারী জাগরনের অগ্রদূত’ বলা হয়। তাঁর তিরোধানের নয় দশক পর এই ‘জাগরণ’ কথাটাকে আমরা কতটা অর্থবহ করে তুলতে পেরেছি, সে প্রশ্ন আমাদের করতে হবে নিজেদেরকেই। তাঁর মতো সাহস, শক্তি, বুদ্ধিমত্তা, মমতা, আত্মমর্যাদাবোধ এবং কর্মনৈপুণ্য একালে এসেও আমরা অর্জন করতে পেরেছি কি? সমাজের, মেয়েদের ঘুম ভাঙাতে গিয়ে নিজের সনদ প্রাপ্তির জন্য সময় ও সুযোগ করে উঠতে পারেননি রোকেয়া, অংশ নিতে পারেননি প্রবেশিকা পরীক্ষায়। ঝলমলে একুশ শতকে এসে ভারী ভারী সনদের মালিক হয়ে তাঁর চেয়ে বেশী আধুনিক আমরা হতে পেরেছি কি?
শিক্ষা, সংস্কৃতি যদি মনের অন্ধকার দূর না করে, সোজাপথে চলতে না শেখায় তবে কেন এত আয়োজন, কেন এত সাজসজ্জা? রাজপথ সরগরম করেই নারীমুক্তি আসবে না, সমাজ ও দেশে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হবে না। আমাদের মেয়েদের শপথ নিতে হবে- শিক্ষা ও মূল্যবোধের সঙ্গে সাংঘর্ষিক কোন কর্মে লিপ্ত হওয়া চলবে না, পরিবারের কোন সদস্য অনাচারে লিপ্ত হলে তাকে প্রতিহত করতে হবে। ধ্বংস নয়, আমরা অবদান রাখব সৃষ্টিতে। আমরা মেতে উঠবো সৃষ্টিশীলতায়। আমাদের মেয়েরা শিক্ষার শক্তি, দর্শন ও সৌন্দর্যকে উপলব্ধি করতে পারলেই আসবে যথার্থ ‘নারী জাগরণ’।
নজরুলের কালজয়ী কবিতার কয়েকটি চরণ দিয়ে শেষ করছি-
ধূ ধূ জ্ব’লে ওঠ ধূমায়িত অগ্নি,
জাগো মাতা, কন্যা, বধূ, জায়া, ভগ্নী!
পতিতোদ্ধারিণী স্বর্গ-স্খলিতা
জাহ্নবী সম বেগে জাগো পদ-দলিতা,
মেঘে আনো বালা বজ্রের জ্বালা
চির-বিজয়িনী জাগো জয়ন্তিকা।
জাগো নারী জাগো বহ্নিশিখা-

পূর্ববর্তী নিবন্ধস্বল্পোন্নত দেশগুলোর আরও সহায়তা প্রণোদনা প্রয়োজন : অর্থমন্ত্রী
পরবর্তী নিবন্ধতিনি ইন্দিরা গান্ধী