তিনি ইন্দিরা গান্ধী

কাজী রুনু বিলকিস | শনিবার , ১৮ সেপ্টেম্বর, ২০২১ at ৬:০০ পূর্বাহ্ণ

ইন্দিরা গান্ধী আমাদের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের সাথে জড়িয়ে থাকা অবিস্মরণীয় একটি নাম। পুপুল জয়কর একজন ভারতীয় লেখক ও বিভিন্ন সময়ে সরকারের অনেক গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করেছেন। সবচেয়ে বড় পরিচয় তিনি ছিলেন ইন্দিরা গান্ধীর বন্ধু। তাঁকে দায়িত্ব দিয়েছিলেন ইন্ধিরা গান্ধী স্বয়ং তাঁর জীবনী লেখার জন্য। স্বাভাবিকভাবে বইটি বেশ বড়সড়। পুপুল জয়কর এই বই সম্পর্কে বলেছেন ‘এটা ছিল বিংশ শতাব্দীর সত্তর দশক। প্রথমত ইন্দিরা আমাকে তাঁর জীবনী লিখতে বলেন। তিনি শুধু আমাকে সাহায্য করার জন্য প্রস্তুত ছিলেন না বরং আমার সাথে সময় কাটাতেও প্রস্তুত ছিলেন। একজন প্রধানমন্ত্রীর সময় আমাকে বৈপরীত্যগুলো অনুধাবনে সক্ষম করেছিল যা তাঁর জীবনকে করেছিল দুর্বোধ্য ও জটিল। আমি তাঁকে বলতে ইতস্তত করছিলাম যে একজন বন্ধু অধিকন্তু প্রধানমন্ত্রীর জীবনী লেখা একটা অসম্ভব ব্যাপার এবং এটা বন্ধুত্বহানির দিকে চলে যাবে অনিবার্যভাবে। বছরের পর বছর অতিবাহিত হেেলা। তাঁর মৃত্যুর এক সপ্তাহ আগে তাঁকে পরিপক্ক, হাসিখুশী ও প্রফুল্ল মেজাজে দেখতে পেয়েছি। আমি তাঁকে প্রস্তাব করি তার বাচনিক জীবন শুরু করার জন্য। তিনি দ্রুত প্রত্যুত্তর করেন ক্ষিপ্রতার সাথে যা আমাকে অবাক করেছিল।’
ইন্দিরা গান্ধীর জীবন একটি শতাব্দীর দুই তৃতীয়াংশ জুড়েই ব্যাপ্ত ছিল। তাঁর শৈশব একরকম অস্থিরতার মধ্যে কেটেছে। অভিজাত, ধনী ও উদার রাজনৈতিক পরিবারের সন্তান হলেও তাঁর পারিবারিক পরিবেশ ছিল আমাদের অতি পরিচিত সেই সনাতন ঘর ঘরকা কাহানির মতোই। তাঁর মায়ের প্রতি দাদী ও পিসিদের অন্যায় আচরণ এবং মায়ের প্রতি বাবার নিস্পৃহতা, মায়ের অসুস্থতা, ঘনঘন স্কুল পরিবর্তন, বাবার জেলে যাওয়া সবকিছু মিলিয়ে তার শৈশব স্বস্তিদায়ক ছিল না। যদিও দাদা মতিলাল নেহেরুর খুব আদরের ছিলেন। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন যখন থেমে থেমে চলছে তখন তাকে পাঠানো হয় কবিগুরুর শান্তি নিকেতনে। সেখানে গিয়েই তিনি জীবনের অন্য একটা রূপ দেখতে পান। রাজনৈতিক ও পারিবারিক কোলাহল থেকে একবারে অন্য একটা জীবনের স্বাদ পান। একবারে প্রকৃতির কাছাকাছি। এই প্রথম তার চোখে পড়ে ঋতুর বর্ণালী উৎসব, সংগীতের ঝর্ণাধারা, পরিবর্তনশীল আকাশ, পেলব মাটির সোঁদা গন্ধের স্বাদ ও স্পর্শ! অবশ্য খুব বেশিদিন সেখানে থাকা হয়ে উঠেনি। আবারও ফিরতে হলো নতুন জায়গায়। মায়ের চিকিৎসার জন্য সুইজারল্যান্ড সেই সাথে বোর্ডিং স্কুল। পরবর্তীতে তিনি অক্সফোর্ডে ভর্তি হন। মায়ের মৃত্যুতে কিছুদিনের জন্য দেশে ফিরলেও বাড়ির পরিবেশ তাকে শান্তি দিলো না। ফিরে গেলেন অক্সফোর্ডে। বাবার উপদেশমূলক চিঠিই তার একমাত্র পারিবারিক যোগসূত্র। এছাড়া তাঁর জীবনে তখন ফিরোজ গান্ধীর আগমন ঘটে। ফিরোজ গান্ধী তাঁর পূর্ব পরিচিত ও তাঁর মায়ের স্নেহধন্য ছিলেন। অক্সফোর্ডে তাদের ঘনিষ্ঠতা বাড়ে। এক পর্যায়ে দেশে ফিরে কারাগারে বাবা জওহরলাল নেহেরুকে ফিরোজ গান্ধীর ব্যাপারে জানান। এবং বিয়ের অনুমতি প্রার্থনা করেন। জওহরলাল হতভম্ব হয়ে পড়েন। তিনি তাকে বুঝানোর চেষ্টা করেন, পারিবারিক ঐতিহ্যের গৌরব তার সত্তার অবিচ্ছেদ্য। ঐতিহ্য একটি সামর্থ্য, একটি বিরাট সাহস, প্রচুর অধ্যবসায়, বিরাট উৎসর্গের ফলশ্রুতিস্বরূপ ঐ সবটুকু ভারতের সেবার জন্য পরিচালিত ও নিয়ন্ত্রিত। এই প্রস্তাব সম্পূর্ণ অগ্রহণীয়। অবশ্য পরবর্তীতে মহাত্মা গান্ধীর হস্তক্ষেপ ও সম্মতিতে খুব ঘটা করে বিয়ে হয়। কিন্তু ক্ষমতা ও রাজনৈতিক মতানৈক্যের কারণে ফিরোজ গান্ধীর সাথে তাঁর দূরত্বের সৃষ্টি হয়। ভারত স্বাধীন হওয়ার পর প্রথম প্রধানমন্ত্রী হন জওহরলাল নেহেরু। তিনি ইন্দিরাকে তাঁর যোগ্য উত্তরাধিকারী হিসেবে দেখতে চেয়েছিলেন। ১৯৫৯ সালের লাল বাহাদুর শাস্ত্রীর সরকারের তথ্যমন্ত্রী হিসাবে তাঁর যাত্রা শুরু। ১৯৬৬ সালে তিনি ভারতের প্রথম মহিলা প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নির্বাচিত হন। ১৯৭৭ সালে নির্বাচনে পরাজিত হলেও ১৯৮০সালে পুনরায় ক্ষমতায় আসেন। তিনি নিঃসন্দেহে ক্যারিশমাটিক লিডার ছিলেন। যদিও ঝঞ্জাবিক্ষুব্ধ জীবন তিনি কাটিয়েছেন। জীবনের শেষটাও ছিল অত্যন্ত মর্মন্তুদ! দেহরক্ষীর বিশ্বাসঘাতকার শিকার হয়ে তার জীবনাবসান ঘটে। এই বিশাল বইয়ের যে অংশটি বাংলাদেশ সম্পৃক্ত ছিল তা আমি পাঠকের জন্য তুলে দিলাম, তিনি একজন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ও রাষ্ট্রনায়ক শুধু ছিলেন না ভেতরে ভেতরে একজন কোমল হৃদয়ের নারীও ছিলেন। ‘পাকিস্তান সশস্ত্র বাহিনীর আত্মসমর্পণের কয়েকদিন পূর্বে, বিজয়ের মুহূর্তে প্রতীক্ষা করে গীতা মেহতা প্রধানমন্ত্রীকে বাংলাদেশের শরণার্থী সম্বন্ধে তার একটা চলচ্চিত্র প্রদর্শন করেন। জাতীয় সম্প্রচার সংস্থার সৌজন্যে চলচ্চিত্রটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যুষকালে টেলিভিশনে প্রদর্শিত হয়। যুদ্ধ শেষ হবার এক সপ্তাহ পূর্বে উপকূল থেকে উপকূলে জাতীয় সম্প্রচার সংস্থার টেলিফোনগুলো চার ঘন্টার অধিক সময় ধরে ঠাসাঠাসি করা হয়েছে মুক্তিবাহিনীর সেনাদলকে সাহায্য করার প্রস্তাব দিয়ে। আমি, প্রধানমন্ত্রী, রাজীব ও সঞ্জয় গান্ধীর সাথে চলচ্চিত্রটি দেখার জন্য উপস্থিত ছিলাম। গুপ্তস্থান থেকে তাদের শূন্য ধ্বংসপ্রাপ্ত বাড়িঘরে ফিরছে মনুষ। যুবক ও বৃদ্ধদের মুখমন্ডলসমূহ, নিষ্ফলা দগ্ধ ময়দানগুলো আমাদের বিধস্ত করে তোলে। ইন্দিরা কাঁদছে। পরে আমি তাঁর কাছে জানতে চাই যুদ্ধ তাকে মর্মাহত করেছে কিনা! তিনি বলেন, ‘একজন নারী ও মা হিসেবে আমি জানি যুদ্ধ একটি মারাত্মক বিষয়। আমি বয়স্ক হয়েছি, কষ্ট ভোগ করেছি, অনেককিছুর পর বেঁচে আছি এবং পরিণত হয়েছি।’

পূর্ববর্তী নিবন্ধজাগো নারী
পরবর্তী নিবন্ধচট্টগ্রামে করোনায় আরও একদিন মৃত্যুহীন দিন