জলপরির বিয়ে

সরোজ আহমেদ | বুধবার , ৮ জুন, ২০২২ at ১০:৫৬ পূর্বাহ্ণ

মিশু ভারি মিষ্টি মেয়ে। তবে একটু অভিমানী। মুখে সারাক্ষণ আদুরি কথার খৈ ফোটে। পড়ে ক্লাস ওয়ানে। এমন আহ্লাদে মেয়ে দোষ করলেও কিছু বলার সাধ্য নেই! খাবে না, পড়বে না, ঘুমোবে না। গাল ফুলিয়ে পুতুলের মত বসে থাকবে। মেয়েটা আসলেই পুতুলের মত। তাই সবাই ডাকে পুতুলবুড়ি।
আজ বাবা একটু বকেছে, ব্যস। অমনি গাল ফুলিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে সোজা পুকুর ঘাটে। দাদুর বাড়ির পুকুরটা ইয়া বড়। ঠিক পুকুর নয়, মস্ত এক দীঘি। নামটাও ভারি সুন্দর, পদ্মপুকুর। শুধু নামে নয়, পুকুরটি পদ্মফুলে ভরা থাকে সারাবছর।

গ্রামে ছোট-বড় পুকুরের কমতি নেই। কিন্তু শহরে পুকুর যেন রূপকথার গল্প। তবে একসময় শহরেও অনেক বড় বড় দীঘি, পুকুর, অসংখ্য জলধার ছিল। এখন সব ভরাট করে গড়ে উঠেছে আকাশচুম্বী দালান। গ্রামের ছেলে-মেয়েরা পুকুরে ইচ্ছেমত সাঁতার কাটে, গোসল করে, মাছ ধরে। কত্ত মজা করে ওরা। আর শহরে চার দেয়ালের মধ্যেই সবকিছু। একটুও মজা নেই।

মিশু পিছু ফিরতেই দেখে ঘাটের একদম নিচের সিঁড়িটাতে পরির মত সুন্দর একটা মেয়ে বসে আছে। আরে, মেয়েটি মিটিমিটি হাসছে। আবার মিশুকে ইশারায় কাছে ডাকছে। মিশুও মন্ত্রমুগ্ধের মত মেয়েটির পাশে গিয়ে বসে। এমন অদ্ভূদ সুন্দর মেয়েটাকে ছুঁতে ইচ্ছে করছে মিশুর। কিন্তু….।

‘আমাকে ছুঁতে চাও? এসো, কাছে এসো।’ মিশুর হাত ধরে টেনে পাশে বসিয়ে মেয়েটি আবার বলল, ‘তুমি খুব সুন্দর। পুতুলের মত।’
‘তুমিও পরির মত সুন্দর।’ মিশুর কথায় মেয়েটি খিল খিল শব্দে হেসে উঠে।
‘তুমি কখনো পরি দেখেছো?’ ‘না’ সূচক মাথা নাড়ে মিশু।
‘তবে যে বললে পরির মত সুন্দর?’
‘ছবিতে দেখেছি, আর গল্পে শুনেছি। পরিরা দিনের আলোর মত সুন্দর। ঠিক তোমার মত।’
মেয়েটা টোল পড়া গালে আবারও হাসে। ‘তুমি ছোট হলেও বুদ্ধিমতী। অনেক কিছু বোঝার ক্ষমতা আছে তোমার।’
‘মানে?’
‘মানে, আমি সত্যি সত্যি পরি। আরে ভয়ের কিছু নেই। তোমার কোনো ক্ষতি করবো না। তুমি মন খারাপ করে বসেছিলে, দেখে মায়া হলো। তাই তোমার সঙ্গে সময় কাটাতে চলে এলাম।’
মিশু ড্যাপ ড্যাপ করে পরির মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। ‘কিগো মিষ্টি মেয়ে, চুপ করে আছো কেন? তোমার নামটা তো শুনি?’
‘মিশু।’
‘ভারি মিষ্টি নাম তো।’
‘তোমার নাম পরি?’ পরি একচোট হেসে বলল, ‘পরী কারও নাম হয় নাকি! তুমি মানুষ, আমি পরি। তোমার যেমন একটা নাম আছে, আমারও আছে।’
‘কি নাম?’
‘সায়রা। বাবা-মা আদর করে ডাকে সারা।’
‘তোমাদের বাড়ি কোথায়?’
‘দীঘির তলদেশে। মানে জলের মধ্যে।’
‘জলে! জলে আবার কারও বাড়ি হয় নাকি?’ হি হি করে হাসে মিশু।
‘হ্যাঁতো। পৃথিবীতে অনেক জাতের পরি আছে। আমরা হলাম জলপরি। জলেই আমাদের বসবাস।’
মিশুর হঠাৎ চোখ যায় ফুলের দিকে। জলপরির কোলে লাল, নীল, সবুজ, হলুদ, কমলা হরেক রঙের ফুল।
‘শুনো মিস্টি মেয়ে, আজ আমার বিয়ে। তাই এই ফুলগুলো দিয়ে বিয়ের পোশাক বানাবো, মালা গাঁথবো।’
‘এ্যাঁ মা! ফুল দিয়ে আবার পোশাক হয় নাকি?’
‘হয়। খুব সুন্দর পোশাক হয়। ফুলের পোশাক ছাড়া আমাদের বিয়ে হয় না।’
‘শাড়ি ছাড়া এ আবার কেমন বিয়ে? শুনে হাসি পাচ্ছে আমার।’
‘হেসো না মেয়ে। পরিদের বিয়ে তোমাদের মতো নয়। অন্যের বানানো জিনিস দিয়ে তোমাদের বিয়ে হয়। আমাদের বিয়েতে পোশাক, মালা, গহনা নিজেকে বানাতে হয়। তাইতো সকাল থেকে অনেক ঘোরাঘুরি করে পাঁচশ একটা ফুল জোগাড় করতে হলো।’
‘ইস! তাহলে তো অনেক কষ্ট তোমাদের বিয়েতে।’
‘কষ্ট কেন বলছো গো। পরিদের বিয়েতে নাচে-গানে অনেক আনন্দ হয়। যাবে আমার সঙ্গে?’
‘কিন্তু বাবা-মা যদি খুঁজে?’
‘আরে চিন্তা করো না, সময়মত আবার পৌঁছে দেবো তোমাকে।’
‘সত্যি?’
‘পরিরা কখনো মিথ্যে বলে না।’

জলের নিচে পরিরা বাঁচতে পারে। কিন্তু কোনো মানুষ অঙিজেন ছাড়া বেশিক্ষণ বাঁচতে পারে না। তাই জলপরি মিশুর মাথায় হেলমেটের মতো একটা বিশেষ ক্যাপ পরিয়ে নিয়ে গেল ওদের দেশে। সেখানে গিয়ে মিশুর আনন্দ আর ধরে না। অপূর্ব এক দেশ। স্বপ্নের মতো। চারদিকে নীল পানি আর পানি। এর মধ্যে রাস্তাঘাট, ঘর-বাড়ি, গাছপালা।

সারাদের বাড়িটা এমনিতেই সুন্দর। তারওপর বিয়ে বাড়ি বলে কথা। নানান রঙ বেরঙের ফুলে ফুলে সাজানো বাড়িটা আরও রঙিন, আরও সুন্দর লাগছে।
দুপুর গড়াতেই ফুলের ডালা হাতে দলে দলে বিয়ে বাড়িতে আসতে শুরু করে আমন্ত্রিত অতিথিরা। মুহূর্তেই নানা বয়সী পরির আগমনে বাড়ি ভরে যায়। যেন পরিদের মেলা বসেছে। সব পরি দেখতে একই রকম। সৌন্দর্যে কেউ কারও চেয়ে কম নয়।

বিয়ের লগ্ন শুরু হতেই বেজে উঠে ঢোল আর সানাই। ঢোলের তালে আর সানাইয়ের সুরে সুরে কেউ গাইছে, কেউ নাচছে। শিশু পরিরাও বসে নেই। কেউ ছিটাচ্ছে ফুলের পাঁপড়ি, কেউ বিলাচ্ছে মিষ্টি, সন্দেশ। আনন্দের যেন শেষ নেই। বিয়েতে সবই হচ্ছে। কিন্তু খাবারের কোনো আয়োজন চোখে পড়ছে না। এত মেহমান, বরযাত্রী খাবে কী? মিশু ছুটে যায় সারার কাছে। ‘আচ্ছা ব্যাপারটা কী বলো তো?’

‘কিসের ব্যাপার গো?’
‘বিয়েতে সবই হচ্ছে। কিন্তু রান্নার কোনো আয়োজন দেখছি না!’
‘ও, বুঝেছি। শোন মিষ্টি মেয়ে, এসব রান্না-বান্না, ভূড়িভোজ তোমাদের বিয়েতে হয়। মেয়ের পরিবারের সামর্থ্য থাক বা না থাক অনেক লোককে খাওয়াতে হয়। অনেক দামি দামি উপহার দিতে হয়। সঙ্গে নগদ অর্থও চায়। তা না হলে মেয়ের বিয়ে হয় না।’
‘এটাই তো নিয়ম।’
‘এটা নিয়ম না। অন্যায়। মেয়ের পরিবারের ওপর জুলুম! তোমরা মানুষরা যেমন লোভী, তেমন হিংসুটেও। এজন্য এত যুদ্ধ, বিবাদ, হানাহানি। নিজেদের স্বার্থের জন্য এমন সুন্দর পৃথিবীটার কী সর্বনাশটাই না করছে মানুষ! যাকগে তুমি ছোট, অতো কিছু বুঝবে না।’
মিশুর মিষ্টি মুখখানা দু’হাতে নিয়ে সারা আবার বলল, ‘পরিদের বিয়েতে খানা মেজবান হয় না। কেউ কাউকে কিছু উপহার দেয় না। বিয়েতে শুধু মিষ্টিমুখ করানো হয়। তোমার খুব খিদা পেয়েছে বুঝি?’
‘বাপরে বাপ, এত মজার মজার মিষ্টি-সন্দেশ খেলে বুঝি কারও খিদে পায়।’ মিশুর কথায় সারা আর না হেসে পারে না। মিশু আবার এক দৌঁড়ে ছুটে যায় বিয়ের আসরে।
বরপক্ষ আসার সঙ্গে সঙ্গেই বিয়ের আসর আরও জমে ওঠে। নাচানাচি, রঙখেলি আর বুদ্ধির খেলা চলে অনেকক্ষণ। এসব খেলায় কেউ কারও চেয়ে কম নয়। দুইপক্ষই সমান সমান। এভাবে নানা আনন্দ আয়োজনে সম্পন্ন হয় জলপরি সারার বিয়ে। এবার বিদায়ের পালা। বাপের বাড়ি ছেড়ে সারা যাবে শ্বশুর বাড়ি। কিন্তু তার আগে মিশুকে বাড়ি পৌঁছে দেয়া চায়।
সারা বিয়ের আসর থেকে উঠে এসে মিশুকে অনেক আদর দিলো। তারপর একটা পদ্মপাতা হাতে দিয়ে বলল, ‘শোন মিষ্টি মেয়ে, এই পাতার উপর দাঁড়িয়ে চোখ বন্ধ করে এক থেকে সাত পর্যন্ত উল্টো গুনবে। তারপর চোখ খুললে দেখবে, তুমি পৌঁছে গেছো তোমাদের সেই পুকুর ঘাটে।’
মিশু সারার কথামত পদ্মপাতার উপর দাঁড়িয়ে চোখ বন্ধ করে সাত থেকে উল্টো এক পর্যন্ত গুনে চোখ খুলে দেখে, সত্যি সত্যি পৌঁছে গেছে পুকুর ঘাটে!
এদিকে অনেকক্ষণ ধরে মিশুকে খোঁজাখুঁজি হচ্ছে। ঘরে, উঠানে, রাস্তায়, ঈদগাঁ মাঠ কোথাও খুঁজে পাওয়া গেল না। শেষে মিশুর বাবা পদ্মপুকুর ঘাটে এসে দেখে মিশু একাকী বসে আছে। এক ঝাপটায় মেয়েকে কোলে তুলে নিয়ে আদর দিতে দিতে বললেন, ‘তুই কেমন মা, একটু বকেছি বলে ছেলেকে না জানিয়ে ঘর থেকে এভাবে চুপিচুপি চলে এলি?’
বাবার গাল টানতে টানতে মিশু বলল, ‘বেশ করেছি, পচা ছেলে। মাকে কেউ বকা দেয় বুঝি? যদি আর কখনো বকা দাও, তবে জলপরির কাছে একেবারে চলে যাবো, আর ফিরবো না।’
‘তাই বুঝি? আমাকে ভয় দেখানো হচ্ছে?’
‘সত্যি বলছি। এবার গেলে আর আসবো না। জানো বাবা, জলপরি খুব ভালো। অনেক সুন্দর।

মিশুর নাক টিপে দিয়ে বাবা বললেন, ‘আমার মা-মণিও সুন্দর, পরির মতো।’ মিশু হি হি করে হেসে ওঠে। তারপর দু’হাতে বাবার গলা জড়িয়ে কাঁধে মাথা রাখে পরম মমতায়।

পূর্ববর্তী নিবন্ধপরিব্রাজক ফার্দিনান্দ ম্যাগেলান
পরবর্তী নিবন্ধসময়