জন্ম-মৃত্যু

সাজিদ মোহন | বুধবার , ২১ অক্টোবর, ২০২০ at ৯:৩৭ পূর্বাহ্ণ

ছোটবেলা থেকেই কবুতর পোষার শখ রাতুলের। ছাদের প্রায় অর্ধেকজুড়ে চিড়িয়াখানার মত জাল দিয়ে ঘেরা।
সেখানে নানান রকম কবুতর। অন্য পাখিও সে আগে পুষতো। বন্দি পাখিদের ছটফটানি তার ভালো লাগে না। কবুতর পোষার এক ধরনের আনন্দ আছে। অন্য পাখির মত কবুতরকে বন্দি করে রাখা লাগে না। সারাদিন মুক্ত পাখির মত উড়ে উড়ে ঘুরে বেড়ায়। বিল থেকে ধান খেয়ে ফিরে আসে সন্ধ্যায়। মাঝে মাঝে রাতুল দেখে খেলার মাঠের উপর দিয়ে উড়ে যাচ্ছে এক ঝাঁক কবুতর। হয়তো তারই কবুতর। মুক্ত পাখির মত স্বাধীন। অন্যরকম আনন্দ হয় তখন।
শুক্রবার কবুতরের বড় বাজার বসে বক্তারহাটে। প্রতি হাটেই ঘুরতে যায় রাতুল। প্রতি হাটেই যে কেনাবেচা করে তা কিন্তু নয়। তারপরও সে যায়।দীর্ঘদিনের অভ্যাস। ভালো দামে নতুন কোন কবুতর পেলে সুযোগ বুঝে কিনেও ফেলে।
হাটে ঢুকেই গলির মুখে বসে থাকা একটা লোকের উপর চোখ পড়লো রাতুলের।লোকটার সামনে খাঁচার ভেতর চার পাঁচটা কি যেন বাঁধা। রাতুল জানতে চাইলো কি?লোকটা বলল, চিনা মুরগী। চিনা মুরগী!এই নাম সে কখনো শোনেনি। লোকটা খাঁচা খুলে রাতুলকে দেখালো চার জোড়া তিতির। ডিসকভারী চ্যানেলে আফ্রিকার জঙ্গলে মুরগীর মত পাখিগুলো ঘুরতে দেখছে সে। দাম কত জিজ্ঞেস করতে লোকটা বলল, জোড়া দুই হাজার। এতো দাম! এ যে কবুতরের চেয়েও বেশি। লোকটা বলল, ডিম পাড়া মুরগী। এজন্য দাম বাড়তি।
কথা না বাড়িয়ে কবুতরের হাটে ঢুকে পড়লো রাতুল। একজোড়া ময়ূরপঙ্খী কবুতর এসেছে আজ। অদ্ভুত সুন্দর পেখম। যেন ময়ূর। দাম তাও দুই হাজার।খুব কিনতে ইচ্ছে করছে রাতুলের। আবার মন থেকে তিতিরগুলোর কথাও সে ফেলতে পারছে না। এ এলাকায় আগে কখনো তিতির সে দেখেনি। এক জোড়া কিনে নিলে ভালো হয়। ময়ূরপঙ্খীর চেয়ে আফ্রীকান মুরগীগুলোই তাকে বেশি টানছে।
গলির মুখে গিয়ে রাতুল দেখলো লোকটা এখনো আছে। এক জোড়া তিতির বিক্রি হয়ে গেছে। আছে আরেক জোড়া। লোকটা বলল, নিলে নিয়ে ফেলেন। আমি এখন চলে যাবো। বাজারের পেছনেই ঘর দেখিয়ে দিয়ে লোকটা বলল, কোন সমস্যা হলে নিয়ে আসবেন। টাকা ফেরত।লোকটার আশ্বাস পেয়ে শেষমেশ একজোড়া কিনে ফেললো রাতুল।
সুন্দর একজোড়া তিতির। খাঁচায় ঢুকিয়ে দিতেই খুটে খুটে খাবার খাওয়া শুরু করলো। হাঁটার ভঙ্গীও রাজসিক। চার পাঁচ দিন কাটলো কোন রকম ঝামেলা ছাড়াই। লোকটা বলেছিলো ডিম দেয়া তিতির।অথচ এতোদিনেও ডিমের দেখা নেই। লোকটা কি ঠকালো নাকি?
পরের সপ্তাহ হাটে গিয়ে লোকটার সঙ্গে দেখা হলো আবার। রাতুলের জেরার মুখে পড়ে লোকটা বলল, ডিম তো পাড়ার কথা। আপনি কোথায় রেখেছেন পাখিগুলো? রাতুল বলল, ছাদে খাঁচায় বেঁধে রাখি। মাথায় হাত দিয়ে হায় হায় করতে করতে লোকটা বলল, বেঁধে রাখলে তো ভয়ে ডিম পাড়বে না। ছাদে ছেড়ে দিয়েন। যদি না পাড়ে টাকা ফেরত নিয়ে যাবেন।
লোকটার কথায় তিতির দুটো ছাদে ছেড়ে দিলো রাতুল। ছাড়া পেয়েই পাখির মতো উড়ে,পালক ভাজ করে,কক্‌ কক্‌ শব্দ করে করে মুক্তির স্বাদ আস্বাদন করলো কিছুক্ষণ। এদিক ওদিক ঘুরে ঘুরে খড় কুটো খেতে লাগলো। চোখে যে ভয় ছিলো এতোদিন কেটে গেলো হঠাৎ। রাতুল ভাবলো, এতোদিন বেশ অন্যায় হয়েছে ওদের সঙ্গে। ছেড়ে দিলেই তো দিব্যি ওরা ভালো থাকে। ছাদের চারপাশ জাল দিয়ে ঘেরা। নিচে নামার সুযোগ নেই।
সারাদিন খেয়ে দেয়ে সন্ধ্যায় ছাদের পাশে কাঁঠাল গাছটায় উঠে পড়লো তিতির দুটি। কী সুন্দর দৃশ্য। যেন জঙ্গলের গাছের ডালে নিজস্ব পরিবেশে বসে আছে ভয়হীন, মুক্ত, স্বাধীন এক জোড়া পাখি। চোখ জুড়িয়ে গেলো রাতুলের। গাছ থেকে নামিয়ে এনে খাঁচায় বন্দি করার কথা সে আর ভাবতে পারলো না।

সন্ধ্যার পর থেকেই মেঘ জমতে শুরু করেছে আকাশে। বর্ষার আনাগোনা। রাতে বৃষ্টি নামলো জোরে। রাতুল ছাদে গিয়ে দেখলো পাতার আড়ালে গুটিসুটি মেরে বসে আছে ওরা। বৃষ্টিতে যে ভিজে যাচ্ছে এ ব্যাপারে নিজেদের খেয়ালই নেই। যেন এটাই স্বাভাবিক। একবার ইচ্ছে হলো নামিয়ে আনতে। রাতুল আবার ভাবলো জঙ্গলেও তো বৃষ্টি হয়। নামিয়ে আনার চেয়ে গাছেই বরং ওরা স্বাচ্ছন্দে আছে।
সারা রাত ঝমঝম বৃষ্টি হলো। সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে রাতুল দেখলো গাছ থেকে নেমে ছাদময় ঘুরে বেড়াচ্ছে মেয়ে তিতিরটি। পুরুষটি দেখা যাচ্ছে না। হয়তো কোথায় লুকিয়ে আছে। এদিক ওদিক ঘুরে রাতুল দেখলো ছাদে, ছাদের আশেপাশে কোথাও তিতিরটি নেই। নিচে নেমে বাসার চারপাশ খুঁজতে লাগলো সে।আশপাশের ঝোঁপগুলোও খুঁজলো তন্নতন্ন করে। সবাইকে জিজ্ঞেস করলো। কিন্তু কেউ কোন তিতির দেখার কথা বলতে পারলো না।
বিমর্ষ মনে রাতুল ছাদে এসে দাঁড়ালো। মেয়ে তিতিরটি একা একা হাঁটছে আর ডেকে বেড়াচ্ছে অন্যটিকে। লোকটা বারবার সাবধান করে দিয়েছিলো।বলেছিলো, ছাদ থেকে যেন নিচে পড়ে না যায়। নিচে পড়লেই বিপদ। হয়তো কুকুর ধরবে। নইতো অন্যকিছু। প্রত্যেক প্রাণীরই কেউ না কেউ শত্রু থাকে। কিন্তু গাছের ডালে তিতির জোড়ার বসে থাকার দৃশ্য দেখে মনটা এতোই আবেগী হয়ে গিয়েছিলো, লোকটার কথা রাতুল ভুলেই গিয়েছিলো। না বেঁধে বড় ভুল হয়েছে। ভুলের মাশুল দিচ্ছে এখন।
একবার চারপাশ খুঁজে এলেও মন মানছে না। মন বলছে হয়তো কোথাও না কোথায় লুকিয়ে আছে।রাতুল আরও একবার খুঁজতে শুরু করলো। খুঁজতে খুঁজতে হঠাৎ মনে হলো খাঁচার ভেতরটা একবার দেখি আসি। সেখানেও তো লুকিয়ে থাকতে পারে। বিশেষ করে খাঁচার ভেতরে ডিম পাড়ার জন্য রাখা বাক্সটায়। খাঁচার দরজা খুলে রাতুল দেখলো সেখানেও নেই। তবে নতুন একটা কিছু দেখে হঠাৎ কিছুক্ষণের জন্য দুঃখভরা বিষণ্ন মনটা নেচে উঠলো আনন্দে। খাঁচার কোনায় সে দেখলো, কাগজের বাক্সের ভেতর ছোট একটা তিতিরের ডিম।

পূর্ববর্তী নিবন্ধশ্বেতশুভ্র কাশ ফুল
পরবর্তী নিবন্ধমোহাম্মদ আজিজুর রহমান চৌধুরী