চিরকুট উপাখ্যান

শৈবাল বড়ুয়া | শুক্রবার , ৬ জানুয়ারি, ২০২৩ at ৬:০৯ পূর্বাহ্ণ

আজ হতে ঠিক দু’বছর আগে মানুষ যখন প্রচন্ড করোনাতঙ্কে ভুগছিল সেসময় আমার এ গল্পের নায়ক সৈকত মাস্টার্সের তুখোর ছাত্র। অনার্স পর্যায়ে সৈকত শীর্ষ গ্রেড নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে চূড়ান্ত পর্বে ভর্তি হয়েছিল। তখন ছিল করোনার সূচনা মাত্র। কয়েক বন্ধু মিলে টিউটোরিয়্যাল নোট তৈরির জন্য লাইব্রেরির ঢালু সিঁড়ি বেয়ে ছুটে ওঠার সময় সৈকত নিচ থেকে দেখলো। এক পর্যায়ে ওপর থেকে দু’জন তরুণীকে নেমে আসতে দেখে ও একপাশে দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে ওদের স্বচ্ছন্দে নামার জায়গা করে দিল।

কিন্তু সৈকত দেখল দুই তরুণীর একজন হঠাৎ পা পিছলে সিঁড়ির মেঝেতে পড়ে গেল। এটি একটি নিছক দুর্ঘটনা।

তরুনীর কাঁধের ভারী ব্যাগটি ছিটকে পড়লো সৈকতের পায়ের ওপর। পায়ে আঘাত পেয়ে সৈকত বসে পড়লো। আর দু’জন তরুণীর একজন মেঝেতে অর্ধ শোয়া অবস্থায় যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে।

অবস্থা বেগতিক বুঝতে পেরে সৈকত কোনভাবে উঠে দাঁড়াল। ও খানিকটা এগিয়ে উঠে আহত তরুণীকে উঠে দাঁড়াতে সাহায্য করলো। সৈকতের যন্ত্রণা পায়ের আঙুল জুড়ে। আর তরুণীটির হাঁটুর নিচে অনেকটা চামড়া ছড়ে গিয়ে রক্ত ঝরছে।

সৈকত আর আহত তরুণীটি কোনোভাবে খুঁড়িয়ে হেঁটে লাইব্রেরি সীমানার বাইরে রাস্তার ওধারের ছোট্ট ফার্মেসির সরু বেঞ্চিতে এসে বসে। তারপর যন্ত্রণায় কাতর তরুণীটি বেঞ্চিতেই শুয়ে পড়ে। ফার্মেসির কম্পাউন্ডার মেয়েটির চামড়া ছড়ে যাওয়া অংশে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে রক্ত ঝরা বন্ধ করে। ব্যন্ডেজ দিয়ে আঘাতের অংশে কিছু সুরক্ষা দেয়। ওভাবেই কিছুক্ষণ বিশ্রাম শেষে সৈকত সিএনজি ডেকে ওই দুই তরুণীকে তুলে দেয়।

সৈকতের পকেটে একটা চিরকুট ছিল, তাতে এগারো ডিজিটের কিছু সংখ্যা ওর পকেটে কে দিয়েছিল তা, ও মনে করতে পারে না। কিন্তু সৈকতের হাতে তরুণীটির ব্যাগে ছোট করে নাম সাঁটানো ছিল, ‘উপমা নাসরীন’। আর একটি মোবাইল নম্বর যা সৈকতের পকেটে থাকা নম্বরের সাথে হুবহু মিলে গেছে।

‘উপমা’ খুঁড়িয়ে হেঁটে সিএনজিতে ওঠার আগ মুহূর্তে সৈকতের দিকে তাকায়। উপমার চোখের কৃতজ্ঞতার ভাষা সৈকতের কাছে বাক্সময়।
এ-তো দু’বছরে আগের গল্প!
পাঠক-পাঠিকাগণ ভাবতে বসলেন এর পরবর্তী উপাখ্যান কি হতে পারে ?

বিগত দু’বছরে করোনা মহামারির মহাতান্ডবে আক্রান্ত হলো বহু মানুষ। বহু সংসার ছিন্নভিন্ন হলো। চারদিক বিক্ষিপ্ত। বিদগ্ধ ব্যক্তি, চিকিৎসক, সেবিকা এবং সাধারণ মানুষ ধনী-গরীব সবাই এক কাতারের জীব হয়ে গেল। লকডাউন, মাস্ক, স্যানিটাইজার ইত্যাদি নিত্য-নতুন শব্দের সাথে সবাই পরিচিত হলো। এলো প্রতিষেধক টিকা। সরকার বিভিন্ন হাসপাতালে বিনামূল্যে তিন ডোজ টিকা দেয়ার ব্যবস্থা করেছে। সেখানে অগুণতি নারী-পুরুষের ভিড়। এগুলো সবই প্রত্যক্ষ করলো সৈকত। ওর হঠাৎ মনে হলো উপমা কে টিকা নেওয়ার বিষয়টি জানানো দরকার। সৈকত, উপমার নম্বরগুলো বাটনে চেপে অপেক্ষা করে। কিন্তু উপমার ফোনের রিংটোন বেজেই বন্ধ হয়ে গেল। সৈকতের কপালে চিন্তার রেখা। কিছু পরেই উপমার সেলফোন থেকে সৈকত রিং পেতেই জিজ্ঞেস করলো, তোমরা সবাই ভালো আছো তো ?

উপমা চুপ থাকলো কিছু সময়। তারপর একটু স্বাভাবিক হয়েই ডুকরে কেঁদে উঠল। সৈকত এসব কিছুই বুঝতে পারে না। ও শুধু উপমাকে শান্ত হওয়ার অনুরোধ জানায়। উপমা, কান্নাজড়িত কন্ঠে শুধু এটুকু জানায় ওর বাবা ভোরের দিকে না ফেরার দেশে পাড়ি জমিয়েছেন।

সৈকত আর এক মুহুর্ত দেরি না করে উপমাদের বাড়ির দিকে রওনা দেয়। সেখানে তখন উপমার প্রয়াত বাবার জানাজা পড়ার তোড়জোড় চলছে। ক’জন নিকটজন ছাড়া পাড়া-মহল্লার কেউ আসেনি করোনা সংক্রমণের ভয়ে। জানাজা সেরেই উপমার বাবার মরদেহ নিয়ে কবরস্থানে পৌঁছালো সৈকত আর উপমার একমাত্র বড় ভাই। দাফন শেষে দু’তিনজন মিলে মৃত আত্মার শান্তি কামনা করে মোনাজাত করলো।

উপমা তখন পর্যন্ত স্বাভাবিক হয়নি। ওর মা-ও জটিল রোগে শয্যাশায়ী। আজ বাবাকে হারিয়ে ও যেন নিঃস্ব হয়ে পড়েছে। বড় ভাই আর ভাবী-ই এখন সংসারের হাল ধরবে আরো শক্ত হাতে।

সৈকতরা দাফন সেরে শোকবিধুর বাড়িতে এসে সৈকতের মনে হয় উপমার তখন অব্দি নীরব অশ্রুবিন্দু ঝরছে। ওর মাথায় চুলগুলো অবিন্যস্ত। এই অবস্থায় সৈকত, উপমা-কে, কী বলে সান্ত্বনা দেবে ? কিছুক্ষণ নিশ্চুপ বসে থেকে সৈকত, উপমাকে আলতোভাবে বলে, উপমা তুমি শান্ত হও।

সৈকত আর উপমা গত দু’বছর দেখেছে করোনার চরম থাবা। করোনা অনেক পরিবারকে প্রায় সর্বশান্ত করেছে। কেউ কেউ করোনার সাথে প্রচন্ড লড়াই করে জীবন ফিরে পেয়েছে।

সৈকতের পরিবারেও করোনা আঘাত হেনেছিল। করোনা শুরুর মধ্যভাগে সৈকত নিজেই আক্রান্ত হয়েছিল। ও তখন বাড়িতে নিজ কক্ষে কোয়ারেন্টাইন-এ সকলের থেকে আলাদা হয়ে থেকে ডাক্তারের পরামর্শে দশ দিনেই সুস্থ হয়েছিল। কিন্তু করোনা পরবর্তী দুর্বলতা কাটাতে ওর সময় লেগেছিল বেশ।

এ কি রূপকথার কাহিনি ? না-তো ! এ হলো একবিংশ শতকে প্রাচীন ড্রাগনের মারণ ছোবল !
আজ এ মুহুর্তে করোনা শুরুর পর হতে দু’বছরে বহু পরিবর্তন হয়ে গেছে। এখন মানুষ আর করোনার ভয়ে ভীত নয়। মানুষ এখন মাস্ক পড়ে না। কোন সুরক্ষাও ওদের নেই। মনে হয় মানুষ আবার আগের জীবন ফিরে পেয়েছে।

কিন্তু গত দু’বছর আগে করোনার মাঝেই সৈকতের ‘আন্তর্জাতিক সম্পর্ক’ বিষয়ের মাস্টার্স শেষে চূড়ান্ত পরীক্ষায় শীর্ষ গ্রেড নিয়ে বিসিএসের চিন্তা-ভাবনা করছে। উপমা প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘ইংরেজি সাহিত্যে’ মাস্টার্স শেষ করেছে। সৈকত ওকে পরামর্শ দেয় সামনের বিসিএস পরীক্ষায় উপমাও যেন আবেদন করে। তবে সৈকত ‘প্রশাসন’ কিংবা ‘পররাষ্ট্র’ ক্যাডার চায় আর উপমাও একি ক্যাডার কিংবা নিদেন পক্ষে ‘শিক্ষা’ ক্যাডারে যেন আবেদন করে।

সৈকত আর উপমা এরই মাঝে অনেকটা ঘনিষ্ঠ। এখন ওরা একে অন্যের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্নায় একাকার হয়ে দুধ সাদা রাজহাঁস আর হংসিনীর মতো স্বচ্ছ নীল আকাশে ডানা মেলে পাশাপাশি উড়ছে সুদূর শ্যামলিমায়।

একই সেশনের প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় অবতীর্ণ হয়ে সৈকত পায় ‘প্রশাসন’ ক্যাডার। উপমা মন খারাপ করে। ওকে জয়েন করতে হবে শিক্ষা ক্যাডারে প্রভাষক হিসেবে।

সৈকত সান্ব্তনার বাণী শোনায় উপমাকে, ‘তোমার শিক্ষা ক্যাডার কম কিসে ? হয়তো সামনের দিনে আমাকে ডিঙিয়ে তুমি কোনো সরকারি কলেজের অধ্যক্ষার দায়িত্ব নিয়েছ !’

সৈকত আর উপমা, দু’জনেরই বেড়ে ওঠা চাটগাঁয়। কিছু পরে প্রশাসন ক্যাডারে সৈকতের পোস্টিং হয় ঢাকার নরসিংদী উপজেলায়। শিক্ষা অধিদফতর হতে উপমা নিয়োগপত্র পায় নারায়নগঞ্জের একটি কলেজে যোগ দেয়ার জন্য।

এবার ষৈকত আর উপমা মুখ চাওয়া-চাওয়ি করে। মুহুর্ত মাঝে সৈকত হেসে বলে, ভালোই হলো আমরা দু’জন চাটগাঁ ছেড়ে ঢাকায় পাড়ি জমাচ্ছি অচিরেই !
উপমার ভাই-ভাবী ভেবেই রেখেছে ওরা একটু প্রতিষ্ঠিত হলেই ওদের শুভ মিলন ঘটিয়ে দেবে। বড় ভাই সব বুঝে শুনে উপমাকে এ বিষয়টি জানাল। পেশায় ব্যাংকার বড় ভাইয়ের ওপর উপমার পূর্ণ আস্থা আছে। উপমা তবু মুখ লুকোলো। ভাবীর কাছে ছুটে গিয়ে, নালিশ জানালো ভাইয়ার বিরুদ্ধে। ভাবীতো হেসে কুটিকুটি।

সৈকত প্রশাসনে জয়েন করেই উপমাকে ম্যাসেঞ্জারে চিরকুট লেখে, আমিতো চাটগাঁ ছেড়ে এলাম। তুমি কবে আসছো জানাওনি তো!
উপমাও চিরকুট লেখায় কম নয়। ও লিখলো, আমি তো নারায়নগঞ্জে গিয়ে কলেজের ডর্মিটরিতে উঠবো, তোমার কী এতে সায় আছে?
সৈকত হাসির ইমোজি দিয়ে লিখলো, না গো উপমা। অচিরেই আমাদের দু’জনের একই ছাদের তলায় থাকার ব্যবস্থা হলো বলে…!
চিরকুটে এর চেয়ে বেশি কিছু লেখা যায়না তো!

পূর্ববর্তী নিবন্ধঅদ্ভুত
পরবর্তী নিবন্ধআত্মজ