আত্মজ

সুবর্ণা দাশ মুনমুন | শুক্রবার , ৬ জানুয়ারি, ২০২৩ at ৬:১০ পূর্বাহ্ণ

রাতটা নিশুতির গহ্‌বরে ডুব দেয়ার তখনও ঢের বাকি। নাথপাড়ার মানুষগুলোর কারও ভাত খাওয়ার পালা, কেউ আবার ভাত পেটে পানের জাবর কাটতে কাটতেই ঘুমের প্রস্তুতি নিচ্ছে। বাইরে রুপোলি থালার মত গোলগাল চাঁদ। যেন ফোটায় ফোটায় ঝরছে আলো।

এমন সময় একটি নবজাতকের কান্নার আওয়াজ পুরো পাড়া জুড়ে ঘুরতে লাগলো। একসময় সেই শব্দ ডুব দিল গাংনীর জলে। তার সাথে একটা মায়ের আহাজারিও…আমার বাচ্চাটা ফিরায়ে দ্যাও…

একটা গা থমথমে ভাব নেমে এলো পুরো পাড়া জুড়ে। শিবনাথের সদ্য বিবাহিত ছেলের বৌটাই শুধু আহা উহু করতে লাগলো…আহারে কার বাচ্চাা এমন করে কাঁদছে…মা’টাই বা কই গেল!

আত্মীয় স্বজনে ভরপুর বিয়েবাড়ির কোলাহলেও যেন ঝুপ করে নেমে এলো একডালা নিস্তব্ধতা। শিবনাথের বুড়ো মা থরথর করে কাঁপতে লাগলো আর নাক-কান মলতে-মলতে অদৃশ্য কারো উদ্দ্যেশে শুধু বলতে লাগলো, হেরে ক্ষমা কইরা দ্যাও, হেই এয়ানে নতুন মানুষ, তাই কিছু জানেনা… হেরে তুমি ক্ষমা কইরা দ্যাও।
শিবনাথের মা শিমুল বালার বয়েসি ঘোলাটে চোখে সেইদিন ভেসে উঠলো আরো একবার।

সেবার অগ্রহায়নের মাঝামাঝিতেই শুরু হয়েছে শীতের আনাগোনা। বেলা সাতটা বাজতে চললো কিন্তু কুয়াশার চাদরে মোড়ানো হলদিয়া গ্রামটায় তখনো সূর্যের আলো পৌঁছোয়নি।

খুব সহজ সরল খেটে খাওয়া কিছু মানুষের বাস এ-গাঁয়ে। কোন মাসে কোন ফসলের চাষ, কোন মাটিতে কোন ধান ভালো হয়… শিক্ষা বলতে তাদের এটুকুই। এদের বেশিরভাগেরই বাংলা পড়ার মত অক্ষরজ্ঞানটুকুও ছিল না।

আর সব দিনের মত বুড়ো বটগাছ তলার চায়ের দোকানটায় তখন চা রুটির হাঁকডাক চলছে জোরেশোরে। গাঁয়ের সবচেয়ে বয়স্ক মানুষ দিজেন খুড়ো। গালের মাংশগুলো চোয়ালের গর্তে ঢুকে গেছে অনেক আগে। চায়ে ডুবানো নরম রুটিটা গর্তে ঠেলে দেওয়ার মতো করেই দু’ঠোঁটের ফাঁকে ঢুকিয়ে দিচ্ছেন পরম যত্নে।
তুলসীর জোড়া মালা গলায় খুড়ো পায়ের উপর পা তুলে আয়েসি ভঙ্গিতে চোখদুটো বুঝেই বললেন, রাজায় রাজায় যুদ্ধ হয় উলুখাগড়ার প্রাণ যায়। এইসব যুদ্ধ, গদি পাওনের ঠেলাঠেলিতে আমাগো কি কাম? আমরা নিরীহ মানুষ, অহন যেমন দুঃখ-কষ্টে দিন কাটে, ভবিষ্যতেও তেমনি হইবো। আমাগো লাইগা পূর্ব যেই পশ্চিমও একই কথা। তাই এসব নিয়া আমাগো মাথা ঘামানের কাম কী ? হ খুড়ো ঠিকই কইছে, দোকানে উপস্থিত অন্যরা মাথা ঝাঁকিয়ে সম্মতি জানালো।

চায়ের দোকানে বড়ো কেটলিতে ফুটতে থাকা চায়ের ধোঁয়া উড়ে গেলেও লোকজনের কথার রেশটা খুব বেশিদূর যেতে পারলো না।

সন্ধ্যার স্বামী ইন্দ্রনাথ গেছে গাঁয়ের শেষ প্রান্তে নদীর কিনারে ডুবে থাকা পাটি পাতার ঝোঁপ থেকে বেত কাটতে। ইন্দ্রনাথ লোকটা কেমন যেন। তার অনেক কথার মানেই সন্ধ্যা বুঝতে পারে না। শুধু এটুকু বুঝতে পারে এ-জীবনে স্বামী হিসেবে তাকে না পেলে এ-সংসারে তার অপ্রাপ্তিটা বড় বেশি হতো। মাঝরাতে পুরো গ্রাম যখন নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে, ঘুম ভাঙিয়ে হয়তো বলবে, এই সন্ধ্যা চল, গায়ে জ্যোৎস্না মাখি…চারিদিকে শুনশান,, গা শীতল করা ঠান্ডা বাতাস বয়ে যাচ্ছে শেষ রাত্তিরের গায়ে-গায়ে… বড় পুকুরের ধার ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকা ঝাউ গাছটা থেকে খট করে একটা ডাল ভেঙে নিয়েই বলবে, ‘নে ধর, এটা কানে ধরে দেখ, কেমন সমুদ্রের শোঁ শোঁ হাওয়াটা কানে এসে লাগে তোর।’

সন্ধ্যার ঘরে সুখের ভরভরন্ত
সচ্ছলতা বলতে তেমন আহামরি কিছু নেই। গত বছর পাটি বেচে কিছুটা লাভের মুখ দেখেছিল ইন্দ্রনাথ । লাভের জমানো অংশটা দিয়েই একটা ঘর বাঁধার স্বপ্ন বুকে গুঁজেছিল।এই আশ্বিনেই সেই স্বপ্ন পূরণ হলো। আর সেই ঘর আলো করে একটা ফুটফুটে কন্যা এসেছে আজ দিন পনেরো হলো।আঁতুরঘরের নিয়মনীতি মেনে আজ সন্ধ্যার শুদ্ধ হওয়ার দিন। তাই নবজাতককে নিয়ে তারও তাড়া কিছু কম নেই।

বেলা ৯ টা বাজতে বাজতেই পুরো নাথপাড়া ডুব দিল এক কর্মব্যাস্ততার উৎসবে। কারও উনুন তেঁতে উঠেছে দুপুরের আহার তৈরির জন্যে, কেউবা ব্যস্ত পাটির বেতগুলোকে মাড়ের জলে ডুবাতে, আবার কেউ আগের দিনের বোনা শীতল পাটির শেষের অংশটুকু শেষ করতেই কাজে মন লাগালো।

হঠাৎ পশ্চিম দিক থেকে উশখুশ করতে করতে দৌড়ে আসতে দেখা গেল মনু পাগলাকে। পরনের লুঙ্গিটা মুখ পর্যন্ত তুলে চোখ দুটো ঢাকারও চেষ্টা করলো যেন মুখে খালি একটাই কথা- ‘আইয়া পড়ছে রে, আইয়া পড়ছে… বেবাকে পলাইয়া যাও…’ কিছুক্ষণের মধ্যেই শুরু হয়ে গেল মানুষের ছুটোছুটি, সাথে একসার গুলির শব্দ।

লছাড়া ভিটা হওয়ায় সন্ধ্যারানী কিছুই বুঝে উঠতে পারলো না। উপায়ান্তর না দেখে বয়স্ক শাশুড়ি আর পনেরোদিনের শিশুটাকে নিয়ে পায়খানা ঘরের পিছনেই লুকিয়ে গেল। এই সংকটের সময়েও ঈশ্বরের নামের আগে মনের কোনে আসলো শিবনাথের নাম। না জানি সে এখন কোথায় কী করছে!

দেখতে না দেখতেই ধুপধাপ শব্দে ভরে উঠলো উঠোন। ৩ জন খান সেনা আর শান্তিবাহিনীর দুই চামচা। ঝলি দেওয়া পায়খানার পিছন থেকে বসে বসে উঁকি মেরে দেখছিল সন্ধ্যা আর তার শাশুড়ি চারুবালা। শান্তিবাহিনীর লোকগুলোর মনেই যেন সবচেয়ে বেশি আক্রোশ। আর সে আক্রোশ ঝাড়ছে ঘরের হাঁড়ি পাতিলগুলো ছুঁড়ে মেরে।

এমন সময় নবজাতকটি হঠাৎ ট্যাঁ করে কান্না করে আড়মোড়া ভাঙতে চাইলো। কিছু বুঝে উঠার আগেই সন্ধ্যা তার কন্যার মুখটা চেপে ধরে মুখের ভেতর বাম স্তনটা গুঁজে দিল। আর সে মেয়েও বেশ আরামে চোখ বুঝে চুকচুক করে দুধ খেতে লাগলো।

ওদিকে কাউকে খুঁজে না পেয়ে বেশ বিরক্তির ভাব নিয়েই হানাদাররা বের হওয়ার জন্য তাড়া দিলো। ধুপধাপ শব্দে উঠোন কাঁপিয়ে বাইরে বেরিয়ে গেল সবাই। সন্ধ্যা আর তার শাশুড়ি পরম কৃতজ্ঞতায় ঈশ্বরকে স্মরণ করতে লাগলো বারবার।

কাউকে খুঁজে না পেয়ে রেগেমেগে রাজাকার সলিম মোল্লার দাঁতের মাড়ি যেন মুখের চোয়াল ভেঙেই বেরিয়ে আসছিলো। দাঁত কিড়মিড় করতে করতে বলতে লাগলো, ‘স্যার একটু যদি দাঁড়ান, আর একবার দেখতাম।’ অনেকটা বিরক্তিবোধ নিয়েই হানাদাররা দাঁড়িয়ে গেল।

দ্বিতীয়বার বাড়িতে ঢুকেই সে সোজা চলে গেল ঝলি দেয়া পায়খানার পেছনের দিকে। চুলের মুঠি ধরে টেনে হিঁচড়ে বের করে আনলো সন্ধ্যা আর তার শাশুড়িকে। নবজাতকটি তখনও মায়ের বুকে শান্তিতে দুধ খাচ্ছে। সলিম মোল্লা হঠাৎ এক ঝটকায় বাচ্চাটিকে টেনে নিয়ে ছুঁড়ে মারলো উঠোনের পশ্চিম কোণে। গগন বিদারী একটা আর্তনাদ করেই শিশুটি একেবারে ঘুমিয়ে গেল শেষবারের মতো। ওদিকে বাচ্চা নিয়ে কাড়াকাড়ি করতে করতে কখন যে সন্ধ্যার বুক থেকে আঁচলখানা খসে পড়লো! সদ্য প্রসূতি এক মায়ের স্ফীত বুকের দিকে তাকিয়েই কুলাঙ্গার হানাদারদের জিভে জল জমে উঠলো। একজন খান সেনা সলিম মোল্লার দিকে তাকাতেই সলিম মোল্লা বলে উঠলো, কোন চিন্তা কইরেন না স্যার। এই বান্দা আপনাগের খেদমতে সবসময় হাজির।‘পানের পিক ফেলতে ফেলতে আবার বললো, তই বুড়া মানুষডারে অযথা কষ্ট দেওন কি ঠিক অইবো? সাথে সাথেই একটা গুলি ঝাঁঝড়া করে দিল চারু বালার বুক। তারপর পাঁচ হায়েনা মিলে এক সন্ধ্যার উপর বর্রতার অন্ধকার নামিয়ে আনলো। পৃথিবীতে যখন সন্ধ্যা নেমেছে, সন্ধ্যা নামের গ্রামীণ বধূটি তখন অনেক দূরে। শুধু চোখ দুটো তার খোলা রইলো, যেন পৃথিবীর আদিম নগ্ন রূপের প্রত্যক্ষদর্শী হয়ে!

এরপর থেকে ইন্দ্রনাথকে এ-গ্রামের কোথাও দেখা যায়নি আর। শুধু মাঝেমধ্যে একটি নবজাতকের কান্না আর তার মায়ের আহাজারির শব্দ ঘুরে বেড়ায় এই গ্রামীণ জনপদে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধচিরকুট উপাখ্যান
পরবর্তী নিবন্ধচট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্তর্জাতিক প্রতিবন্ধী দিবস পালিত