চা উৎপাদনে সাম্প্রতিক সাফল্য ধরে রাখতে হবে

| শুক্রবার , ২১ অক্টোবর, ২০২২ at ৬:১৫ পূর্বাহ্ণ

চা উৎপাদনের ক্ষেত্রে অনন্য উদাহরণ সৃষ্টি করেছে চট্টগ্রাম। গত ১৯ অক্টোবর দৈনিক আজাদীতে ‘চট্টগ্রামের ইতিহাসে সর্বোচ্চ চা উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা’ শীর্ষক প্রকাশিত সংবাদে বলা হয়েছে, চট্টগ্রামের চা বাগানগুলোতে চলতি বছর সোয়া এক কোটি কেজি চা পাতা উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এটি চট্টগ্রামের চা শিল্পের ইতিহাসে সর্বোচ্চ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা বলেও সূত্র জানিয়েছে। সূত্র জানায়, দেশে চা শিল্পের সূচনা চট্টগ্রাম থেকে হলেও মাটির প্রকৃতি এবং আবহাওয়ার কারণে এখানে উৎপাদন সবসময় কম থাকে। চা পাতার উৎপাদনের পেছনে বৃষ্টিপাত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। চট্টগ্রামে বৃষ্টি দেরিতে হয়। এটি সিলেট কিংবা পঞ্চগড়সহ অন্যান্য অঞ্চলের চা বাগান থেকে চট্টগ্রামকে পিছিয়ে রাখে।

চট্টগ্রামের ২২টি চা-বাগানের মধ্যে কয়েকটির অবস্থা খুবই ভালো। অন্যান্যগুলোতেও যাতে ভালো উৎপাদন হয় সেজন্য নানামুখী পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। উৎপাদন বাড়ানোর মাধ্যমে চট্টগ্রামের ২২টি বাগান থেকে এ যাবতকালের সর্বোচ্চ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।

চা এমন এক উদ্ভিদ প্রজাতি, যা চিরসবুজ; যার শুকানো পাতা থেকে তৈরি হয় জনপ্রিয় পানীয়। বিশেষজ্ঞদের মতে, চা বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান রপ্তানি দ্রব্য যা দীর্ঘকাল থেকে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী খাত হিসেবে বিবেচিত। বর্তমানে বাংলাদেশের ১৬২টি চা বাগানে বিশ্বের ৩ শতাংশ চা উৎপন্ন হয়। এই খাত ৪০ লক্ষ লোকের কর্মসংস্থানের সুযোগ করে দিয়েছে।এটি বাংলাদেশে মূলত একটি কৃষিভিত্তিক, রপ্তানিমুখী বহুবর্ষজীবী ফসল। প্রাকৃতিক পরিবেশে চা গাছ ক্ষুদ্র বৃক্ষ আকারে বেড়ে ওঠে, কিন্তু পরপর ছাঁটাই ও অন্য পরিচর্যা যেমন : আগা কাটা, কুঁড়ি ভাঙা, সঠিক মাত্রায় পাতা-কুঁড়ি সংগ্রহ ইত্যাদি কারণে গাছের সাধারণ আকৃতির পরিবর্তন হয়।

ইতিহাস পর্যালোচনা করে জানা যায়, ১৮০০ শতাব্দীর প্রথম ভাগে ভারতবর্ষের আসাম ও তৎসংলগ্ন এলাকায় চা চাষ শুরু হয়। তারই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশের চট্টগ্রাম জেলার কর্ণফুলী নদীর তীরে চা আবাদের জন্য ১৮২৮ খ্রিস্টাব্দে জমি বরাদ্দ হয়। কিন্তু বিভিন্ন কারণে সেখানে চা চাষ বিলম্বিত হয়। ১৮৪০ সালে চট্টগ্রাম শহরের বর্তমান চট্টগ্রাম ক্লাব সংলগ্ন এলাকায় একটি চা বাগান প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল যা কুন্ডদের বাগান নামে পরিচিত। এই বাগানটিও প্রতিষ্ঠার পরপরই বিলুপ্ত হয়ে যায়। অতঃপর ১৮৪৭ সালে সিলেট শহরের এয়ারপোর্ট রোডের কাছে মালনীছড়া চা বাগান প্রতিষ্ঠিত হয়। মূলত মালনীছড়াই বাংলাদেশের প্রথম বাণিজ্যিক চা বাগান।

রবার্ট ব্রুস আসামের উঁচু অঞ্চলে চা গাছের সন্ধান পান। এরপর ১৮৫৫ সালে সিলেটের চাঁদখানি টিলায় দেশীয় জাতের চা গাছের সন্ধান মেলে। একই সময়ে খাসি ও জৈন্তা পাহাড়েও বন্য প্রজাতির চা গাছের সন্ধান পাওয়া যায়। ১৮৪০ সালে চট্টগ্রামেও চা উৎপাদন শুরু হয়। এখানে চা উৎপাদনের জন্য চীন থেকে চারা আমদানি করা হয় এবং কলকাতা বোটানিক্যাল গার্ডেনে উৎপাদিত চীনা প্রজাতির চা গাছ রোপণ করা হয়। প্রথমদিকে ব্যক্তিগত উদ্যোগে চা বাগান প্রতিষ্ঠা শুরু হয়। কিন্তু উনিশ শতকের ষাটের দশকে ব্যাপক মন্দায় ব্যক্তিগত উদ্যোগে চা বাগান প্রতিষ্ঠার তৎপরতা বন্ধ হয়ে গেলে চা শিল্প ধীরে ধীরে বড় বড় কোম্পানির আয়ত্তে চলে আসে।

আজাদীতে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশে চা উৎপাদন দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাংলাদেশ অতীতের সকল রেকর্ড ভঙ্গ করে চা উৎপাদন করলেও চট্টগ্রামে উৎপাদন কমে যায়। চট্টগ্রামের বাগানগুলোতে চা উৎপাদনের পরিমাণ নিম্নমুখী হয়ে উঠে। ২০২০ সালে চট্টগ্রামের বাগানগুলো থেকে ১ কোটি ১৩ লাখ ৫৯ হাজার ৬৫৫ কেজি চা পাতা পাওয়া যায়। কিন্তু ২০২১ সালে এসে পাওয়া যায় ৯৬ লাখ ৫২ হাজার ৮২২ কেজি। এক বছরের ব্যবধানে চট্টগ্রামের বাগানগুলোতে চা পাতা উৎপাদন ১৫ দশমিক ৩ শতাংশ কমে যায়। তবে চলতি বছর চা পাতার উৎপাদন অতীতের যে কোনো সময়ের তুলনায় বাড়াতে চান বাগান মালিকেরা। চা বোর্ডও এ ব্যাপারে বেশ সহযোগিতা করছে। শ্রমিকদের আন্দোলন এবং কর্মবিরতি কিছুটা প্রভাব ফেললেও বছর শেষে চট্টগ্রামের বাগানগুলো থেকে ১ কোটি ২০ লাখ কেজি চা পাতা উৎপাদিত হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করা হয়েছে। ইতোমধ্যে বিভিন্ন বাগান থেকে বেশি ভালো ফলন পাওয়া গেছে বলেও সূত্র জানায়।

বিশেষজ্ঞরা বলেন, দেশের আর্থিক উন্নতি হওয়ার কারণে মানুষের জীবনযাত্রায়ও উন্নয়ন ঘটছে। ফলে বাড়ছে চায়ের চাহিদা। মানুষের খাদ্যাভাসের পরিবর্তন ঘটছে। চা ক্রমেই অপরিহার্য একটি পানীয় হিসেবে রূপ নিচ্ছে। বাংলাদেশের হাতেগোনা কয়েকটি রপ্তানি পণ্যের তালিকায় একদা চায়ের অবস্থান ছিল বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। কিন্তু ৫০ বছরে চা বাগানের সংখ্যা দ্বিগুণ এবং উৎপাদন তিনগুণ হওয়া সত্ত্বেও রপ্তানি সেভাবে বাড়েনি। এর কারণ দেশেই বেড়েছে চায়ের ব্যবহার। চা পানে অনভ্যস্ত বাঙালির এখন যেন চা না হলে চলেই না। তাই রপ্তানি কমে যাওয়াকে নেতিবাচক হিসেবে দেখতে রাজি নন চায়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা। বরং তারা মনে করছেন, ১৭ কোটি মানুষের এই দেশের অভ্যন্তরীণ চাহিদাই চা শিল্পকে একটি শক্ত অবস্থানে নিয়ে যাওয়ার জন্য যথেষ্ট। আর উৎপাদন বাড়লে রপ্তানি তো হবেই। এদেশে উৎপাদিত চা গুণগত মানেও বিশ্বমানের। তাই চা উৎপাদনে সাম্প্রতিক সাফল্য ধরে রাখতে হবে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধ৭৮৬
পরবর্তী নিবন্ধএই দিনে