চট্টগ্রামে সাংবাদিকতা পেশার অগ্রযাত্রী

মুহাম্মদ শামসুল হক | মঙ্গলবার , ১৪ সেপ্টেম্বর, ২০২১ at ৬:২৭ পূর্বাহ্ণ

যুগ যুগ ধরে নানা কারণে বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান আলোচিত ও আলোকিত অঞ্চল সুনাম রয়েছে চট্টগ্রামের। দেশের রাজনীতি, সাহিত্য সাংস্কৃতি মুক্তিযুদ্ধ ও ব্যবসা বাণিজ্যসহ সর্বক্ষেত্রেই চট্টগ্রামের নিজস্ব একটা ঐতিহ্য আছে। দেশের মানুষকে আলোর পথে নিয়ে যাওয়া, সুস্থ সুন্দর জীবন, আদর্শ রাজনীতি ও সমাজ কল্যাণের পথ নির্দেশ করা এবং সমাজ জীবনের সামগ্রিক কর্মকাণ্ড দেশবাসীর সামনে তুলে ধরার মাধ্যমে সাংবাদিক সমাজ বিশেষ ভূমিকা পালন করে থাকেন। এক্ষেত্রেও রয়েছে চট্টগ্রাম সাংবাদিক সমাজের গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা।
চট্টগ্রামের অনেক সাংবাদিক সেই বৃটিশ শাসনামল থেকে শুরু করে বাংলাদেশের স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে সংবাদপত্র ও সাংবাদিকতার উন্নয়ন এবং বিকাশে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছেন। বর্তমানেও এই ধারা অব্যাহত রয়েছে নিঃসন্দেহে। চট্টগ্রামে জন্মগ্রহণকারী এসব সাংবাদিকের অনেকে শুধু চট্টগ্রাম নয় সারা দেশের সাংবাদিকতা জগতে বিশিষ্ট স্থান করে নিয়েছেন নিজেদের যোগ্যতাবলে। এখানে চট্টগ্রামের সেরকম কিছু প্রয়াত সাংবাদিক-সম্পাদকের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি তুলে ধরা হলো যাঁরা ক্রমেই বিস্মৃতির আড়ালে হারিয়ে যেতে বসেছেন।
শাহ বদিউল আলম : চট্টগ্রাম প্রথম সাংবাদিক ও আদি সম্পাদক ছিলেন বাঁশখালী উপজেলার ইজ্জতনগরী গ্রামের অধিবাসী ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি আমলের সাবজজ আনর আলী খানের পুত্র শাহ বদিউল আলম। তাঁর আগে চট্টগ্রাম জেলার কেউ সাংবাদিকতা করেননি। শাহ বদিউল আলম শিক্ষা জীবন শেষে ১৮৮৩ সালে ডেপুটি কালেকটর নিযুক্ত হন। কিন্তু স্বাধীনচেতা মানসিকতার কারণে ব্রিটিশ সরকারের অধীনে বেশিদিন চাকরি করতে পারেননি। ১৮৯২ সালের ১৩ মার্চ তিনি চাকরি ছেড়ে দিয়ে কোলকাতা থেকে প্রকাশিত ইংরেজি সাপ্তাহিকে ‘মোহামেডান অবজারভারের’ প্রধান সম্পাদক পদে যোগ দেন। কয়েক বছর সাংবাদিকতা করার পর তাঁর স্বাস্থ্য ভেঙ্গে পড়লে তিনি সাংবাদিকতা ছেড়ে দেন। তিনি ১৮৫৬ সালে জন্মগ্রহণ করেন এবং ১৯৩১ সালের ১ জুন মারা যান।
মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী : গেলো শতকে সাংবাদিকতায় অবদান রেখেছেন এমন ব্যক্তিদের মধ্যে অন্যতম হচ্ছেন মাওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী। বৃহত্তর পটিয়ার আড়ালিয়া (বর্তমানে চন্দনাইশ উজেলার) গ্রামের অধিবাসী এ মনিষী মূলতঃ রাজনীতি ও সমাজসেবামূলক কাজের ধারাবাহিকতায় এক পর্যায়ে জনসচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে সাংবাদিকতার উন্নয়ন ও পৃষ্ঠপোষকতায় আত্মনিয়োগ করেন। তিনি মাসিক (পরে সাপ্তাহিক) আল ইসলাম, সাপ্তাহিক (পরে দৈনিক) সোলতান, দৈনিক আমীর ও সাপ্তাহিক ইসলামাবাদ পত্রিকার বিভিন্ন সময় সম্পাদক, প্রকাশক ও পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। মাওলানা ইসলামাবাদী একজন বিপ্লবী ধারার রাজনীতিবিদ, সমাজসেবক এবং লেখক ছাড়াও সাংবাদিকতার পথিকৃৎ হিসেবে সুধীমহলে পরিচিত ছিলেন। তাঁর ব্রিটিশ বিরোধী সাহসী ভূমিকার জন্য বৃটিশ সরকার সাপ্তাহিক সোলতান নিষিদ্ধ করে। তিনি ১৮৭৫ সালে জন্মগ্রহণ ও ১৯৫০ সালের ২৪ অক্টোবর মৃত্যুবরণ করেন। চট্টগ্রাম কদমমোবারক এতিমখানা তাঁর কৃতিত্বের স্বাক্ষী হয়ে আছে।
বিশ্বেশ্বর চৌধুরী : জীবনের শুরুতে ব্রিটিশ বিরোধী বিপ্লবী দলের সক্রিয় কর্মী ছিলেন। ব্রিটিশ আমলেই কোলকাতা থেকে প্রকাশিত আবুল মনছুর আহমেদ সম্পাদিত দৈনিক কৃষক পত্রিকায় সাংবাদিকতায় হাতে খড়ি। পরবর্তী সময়ে কলকাতা থেকে প্রকাশিত ফরওয়ার্ড ব্লক, আজাদ, আনন্দবাজার পত্রিকায় কাজ করেন। ঢাকায় এসে কাজ করেন সংবাদ, ইনসাফ, আজাদ, ইত্তেফাকসহ বিভিন্ন পত্রিকায়। তিনি ঢাকা থেকে প্রকাশিত অর্ধসপ্তাহিক বাংলাভাষা’র সম্পাদক এবং মাসিক বিশ্ববাসী’র প্রকাশক-সম্পাদক ছিলেন। তখনকার সাংবাদিকতা জগতে তিনি ‘বিশুদা’ এবং বিশুবাবু হিসেবে পরিচিত ছিলেন। তাঁর জন্ম ১৩১৩ বঙ্গাব্দের ১৭ ভাদ্র। ১৩৮৫ বঙ্গাব্দের ৪ ফাল্গুন (১৭ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৯) তিনি রাঙ্গামাটিতে মারা যান।
কালিশংকর চক্রবর্তী : পটিয়া থানার সুচক্রদণ্ডী গ্রামের অধিবাসী কালিশংকর চক্রবর্তী। ১৮৯৮ সালে তিনি সাপ্তাহিক জ্যোতি পত্রিকা প্রকাশ করেন যা ১৯২১ সালে দৈনিকে রূপান্তরিত হয়। তিনি কংগ্রেসের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। কলকাতার বাইরে সমগ্র বাংলাদেশে প্রথম দৈনিক হিসেবে ‘জ্যোতি’ বিশেষ ভূমিকা রাখে। কালিশংকর চক্রবর্তী নিজেও ব্রিটিশ প্রশাসনের হাতে নানাভাবে নির্যাতিত ও হয়রানির শিকার হন তাঁর স্বাধীনচেতা ভূমিকার জন্য।
মহিম চন্দ্র দাশ : পটিয়া থানার ভাটিখাইন গ্রামের অধিবাসী মহিমচন্দ্র দাশ ছিলেন মূলত রাজনীতিবিদ (কংগ্রেস নেতা) ও আইনজীবী। ১৯২৪ সালে রেঙ্গুনে আবদুল মোনেয়েম সম্পাদিত সাপ্তাহিক সম্মিলনী পত্রিকায় সাংবাদিকতা শুরু করে তিনি। জেলা কংগ্রেসের সভাপতি থাকা অবস্থায় তিনি দৈনিক জ্যোতি পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন। পরে তিনি সাপ্তাহিক পাঞ্চ-জন্যকে দৈনিক হিসেবে বের করেন। এটির সম্পাদনা করেন কালিশংকর চক্রবর্তী। পত্রিকাটি বৃটিশ যুগে সাংবাদিকতার বিকাশে অবদান রাখে। ভাষা আন্দোলনের সমর্থনেও ভূমিকা ছিল পত্রিকাটির।
আবদুস সালাম : চট্টগ্রামের সাংবাদিকতা জগতে কবিখ্যাত আবদুস সালামের নাম বিশেষভাবে আলোচিত ছিল। পাকিস্তান রাষ্ট্রের আনুষ্ঠানিক অভ্যুদয়ের আগেই ১৯৪৬ সালের জুন মাসে তিনি চট্টগ্রাম থেকে দৈনিক পূর্ব-পাকিস্তান পত্রিকা বের করেন। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর এটিই ছিল পূর্ব পাকিস্তানে মুসলমান সম্পাদিত একমাত্র দৈনিক। সরকারি রোষানলের শিকার হয়ে পত্রিকার প্রকাশনা বন্ধ হওয়ার প্রেক্ষাপটে পরবর্তী সময়ে তিনি তাঁর ছোট ভাই আবদুল কুদ্দুসকে সম্পাদক করে দৈনিক মজদুর বের করেন। তাঁর স্ত্রী আয়শা খাতুনকে সম্পাদক করে দৈনিক সরহদ (১৯৫০ থেকে ৬০) নামে একটি পত্রিকাও বের করেন। দৈনিক পূর্ব পাকিস্তান অবশ্য অনিয়মিতভাবে হলেও ৬৩ সাল পর্যন্ত বের হয়। এর মধ্যে পাকিস্তান সরকার পত্রিকাটির প্রকাশনা একবার বন্ধ করে দিয়েছিল। আবদুস সালাম এ ছাড়া সত্যবার্তা, দৈনিক আজান (প্রথম পর্যায়) সাপ্তাহিক গণমত পত্রিকা সম্পাদনা করেন বিভিন্ন সময়। তিনি ৭১ এর মার্চের শেষদিকে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে হানাদার পাকিস্তানি বাহিনীকে মরিচের গুঁড়ো মেরে প্রতিহত করার জন্য আহবান জানিয়ে জনগণকে উদ্বুদ্ধ করেন। বিভিন্ন সময় তাঁর ১৪টি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়। তিনি ১৯০৭ সালে মতান্তরে ১৯০৮ সালের ১২ অক্টোবর ফতেহপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন এবং ৮৭ সালের ২৪ এপ্রিল মারা যান।
মাহবুব উল আলম : চট্টগ্রামের আলম পরিবার হিসেবে খ্যাত পরিবারের সন্তান মাহবুব উল আলম সাহিত্যিক হিসেবে সমাধিক পরিচিত দেশের বিজ্ঞ সুধীজনের কাছে। পারিবারিক ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতায় কর্মজীবন থেকেই তিনি সাহিত্য সাধনায় নিয়োজিত ছিলেন। কর্মজীবনে তিনি ১৯৫৪ সালে রেজিস্ট্রেশন পরিদর্শক পদ থেকে অবসর নেন এবং সাংবাদিকতার দিকে ঝুঁকে পড়েন। তিনি প্রথমে সাপ্তাহিক জমানা বের করেন। ১৯৫৯ সালে এটিকে দৈনিকে রূপান্তর করেন। সাহিত্য, সাংবাদিকতা ও সমাজ সংস্কারের জন্য তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের এ এফ রহমান হলের আজীবন সদস্যপদ লাভ করেন। পত্রিকা সম্পাদক হিসেবে ৫৯ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্টের আমন্ত্রণে তিনি প্রথম যুক্তরাষ্ট্র সফর করেন। তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা ২৩টি। মাহবুব উল আলম ১৮৯৮ সালের ১ মে ফতেয়াবাদে জন্মগ্রহণ এবং করেন ১৯৮১ সালের ৭ আগস্ট মৃত্যুবরণ করেন।
আবদুল খালেক ইঞ্জিনিয়ার : চট্টগ্রামের সাংবাদিকতা জগতের প্রধান অগ্রদূত ইঞ্জিনিয়ার আবদুল খালেক। ১৯৬০ সালের ৫ সেপ্টেম্বর তিনি দৈনিক আজাদী পত্রিকা বের করেন যা এখনো এ অঞ্চলের শীর্ষস্থানীয় জনপ্রিয় দৈনিক হিসেবে পাঠক সমাজে স্বীকৃত। আজাদী বের হবার পর প্রথম দু’বছর এর সম্পাদনার দায়িত্ব পালন করেন ইঞ্জিনিয়ার খালেক নিজেই। তাঁর সম্পাদনায় তাঁরই নিজস্ব প্রেস কোহিনুর ইলেকট্রিক প্রেস থেকে এর আগে বের হয় মাসিক কোহিনুর নামে সাহিত্য পত্রিকা। দৈনিক আজাদী প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে চট্টগ্রামে সাংবাদিকতা পেশার প্রতি মনযোগ আকর্ষণ, পেশার বিকাশ, মানোন্নয়ন এবং এ অঞ্চলের শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতির পরিচয় তুলে ধরার ক্ষেত্রে ইঞ্জিনিয়ার আবদুল খালেকের অবদান অপরিসীম। তিনি ১৯৬২ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর মৃত্যুবরণ করেন।
লোকমান খান শোরোয়ানী : চট্টগ্রাম থেকে প্রকাশিত দৈনিক রাষ্ট্র বার্তার সম্পাদক ও কলকাতা থেকে প্রকাশিত দৈনিক প্রত্যহ এর ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক ছিলেন। তিনি একজন লেখক, চিত্রশিল্পী, কবি হিসেবেও পরিচিত ছিলেন। জন্ম পাঠানটুলী এলাকায়। মৃত্যু ২৭ আগস্ট ১৯৬৯।
অধ্যক্ষ আবুল কাশেম : তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক সংগঠন তমুদ্দুন মজলিশ ও ভাষা আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক ছিলেন অধ্যক্ষ আবুল কাশেম। তিনি সাপ্তাহিক সৈনিক (১৯৪৮-’৬১) বের করেন এবং ভাষা আন্দোলনকে জাগিয়ে তুলতে বিশেষ ভূমিকা রাখেন। তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থ ১৪টির বেশি। তিনি ১৯২০ সালের ২৮ জুন চন্দনাইশ উপজেলার ছেদণ্ডী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন এবং ১৯৯১ সালের ১১ মার্চ মৃত্যুবরণ করেন।
নূরুল ইসলাম চৌধুরী : পটিয়া উপজেলার বরলিয়া গ্রামে ১৯১১ সালে নূরুল ইসলাম চৌধুরীর জন্ম। তিনি ১৯৩৩ সালে কোলকাতায় প্রথমে সাপ্তাহিক সওগাত ও পরে আনন্দবাজার পত্রিকায় সাংবাদিকতা করেন। সেই থেকে দীর্ঘ প্রায় পাঁচ দশক সাংবাদিকতা পেশায় নিয়োজিত ছিলেন। এ সময়ের মধ্যে তিনি দৈনিক আজাদ এবং দৈনিক আজাদী পত্রিকায় কাজ করেন। তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থ দু’টি। নূরুল ইসলাম চৌধুরী ১৯৮৪ সালের ১৯ মে ইন্তেকাল করেন।
নূরুল ইসলাম : বোয়ালখালী উপজেলার গোমদণ্ডী মুন্সিপাড়া গ্রামের নূরুল ইসলাম ১৯৪৯ সালে ছাত্রাবস্থায় সাংবাদিকতা পেশায় যোগ দেন দৈনিক আজাদের ক্রীড়া সাংবাদিক হিসেবে। তিনি ১৯৭০ সাল পর্যন্ত চট্টগ্রাম এপিপি’র ব্যুরো প্রধান এবং পঞ্চাশ-ষাটের দশকে ইউনিটি, দৈনিক আজাদ, দৈনিক পাকিস্তান ও অবজারভার পত্রিকায় কাজ করে সাংবাদিকতা পেশার বিকাশ ও মানোন্নয়নে বিশেষ ভূমিকা রাখেন। নুরুল ইসলাম ১৯৬৯ সালে পিপলস ভিউ নামে ইংরেজি সাপ্তাহিক পত্রিকা বের করেন যা পরে দৈনিকে পরিণত হয়। তিনি ১৯৭৩-৭৪ ও ৭৪-৭৫ সালে চট্টগ্রাম সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি ছিলেন। ১৯২৮ সালে জন্মগ্রহণ এবং ১৯৮৪ সালের ৭ জুলাই তিনি মারা যান। (বাকি অংশ আগামীকালের পত্রিকায়)।
লেখক : জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক, ইতিহাসবিষয়ক গবেষণাকর্মী, সম্পাদক-ইতিহাসের খসড়া।

পূর্ববর্তী নিবন্ধচট্টগ্রামের বধ্যভূমি : সংরক্ষণ করা জরুরি
পরবর্তী নিবন্ধকরোনায় চট্টগ্রামে নতুন আক্রান্ত ৯৭, মৃত্যু ২ জনের