চট্টগ্রামে বেড়েছে আত্মহত্যা

স্কুল কলেজে পড়ুয়া শিক্ষাথীদের ক্ষেত্রে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ হার চট্রগ্রামে পনের দিনে আট আত্বহত্যা , দুটি ফেইসবুকে জানান দিয়ে সব সংকট থেকে বেরিয়ে আসা সম্ভব : মনোরোগ বিশেষজ্ঞ

ঋত্বিক নয়ন | শনিবার , ২০ এপ্রিল, ২০২৪ at ৬:৫৮ পূর্বাহ্ণ

চট্টগ্রামে আত্মহত্যার ঘটনা বেড়েছে। আইনের চোখে আত্মহত্যা একটি অপরাধ বলে বিবেচিত হলেও তার প্রভাব পড়ছে না সমাজে। চিকিৎসকদের মতে, মানসিক বিষণ্নতা থেকেই মানুষ আত্মহত্যার চেষ্টা করে থাকে। মানসিক বিষণ্নতা তৈরির পেছনে কাজ করে শারীরিক ও মানসিক অসুস্থতা, সিজোফ্রেনিয়া, প্রিয় মানুষটির মৃত্যু, মাদকের ছোবলসহ নানাবিধ কারণ। নিজের কাছে, পরিবার ও সমাজের কাছে নিজেকে মূল্যহীন ভাবতে গিয়েই মানুষ পা বাড়াচ্ছে আত্মহত্যার দিকে।

মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. মিশকাতুর রহমান আজাদীকে বলেন, প্রত্যেকেরই কিছু না কিছু মানসিক চাপ থাকে। তখন জীবন থেকে পালানো বা আত্মহত্যায় মুক্তি খোঁজে। বিষণ্নতা থেকে এ রকম ঘটনা ঘটে। কারণ জীবন নিয়ে তাদের মধ্যে প্রচণ্ড নেতিবাচক ধারণা কাজ করে। এ পর্যায়ে মনে রাখা উচিত সব ধরনের সঙ্কট থেকেই বেরিয়ে আসা সম্ভব। তিনি বলেন, আত্মহত্যার চেষ্টাকারীকে দ্রুত চিকিৎসকের কাছে নিয়ে আসতে হবে। এ ধরনের রোগী অবশ্যই সুস্থ হতে পারে। তবে এর সবচেয়ে বড়ো ওষুধ হলো, যে কারণে আত্মহত্যার চেষ্টা, তা সমাধানের চেষ্টা করা। তা যদি না করা যায়, তবে ওষুধে সে হয়তো কিছুদিন সুস্থ থাকবে, কিন্তু পুনরায় তার মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা জেগে উঠতে পারে। তিনি বলেন, যে সংখ্যক লোক আত্মহত্যা করে তার চেয়ে ১০ গুণ বেশি আত্মহত্যার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। আত্মহত্যা করবে বলে চিন্তা করে তারও ১০ গুণ বেশি মানুষ। মানসিকভাবে বিপর্যস্তদের মধ্যে ৭০ শতাংশই আত্মহত্যা করে। নগর পুলিশের অতিরিক্ত উপকমিশনার নোবেল চাকমা আজাদীকে জানান, আত্মহত্যার প্ররোচণায় মামলা খুব একটা দেখা যায় না। পরিবার থেকে উদ্যোগ না নিলে এই মামলা প্রমাণ করা খুবই কঠিন।

জানা যায়, গত বছর চট্টগ্রামে আত্মহত্যার প্রবণতা বেড়ে গিয়েছিল। প্রায় প্রতিদিনই চট্টগ্রামের কোথাও না কোথাও আত্মহত্যার ঘটনা ঘটছিল। চলতি বছরেও তা অব্যাহত আছে। গত পনের দিনে চট্টগ্রামে আটটি আত্মহত্যার সংবাদ পাওয়া গেছে। তার মধ্যে দুটি ঘটনায় আত্মহননকারী রীতিমতো ফেইসবুকে আগাম জানান দিয়ে আত্মহত্যা করেছে।

সম্প্রতি এক গবেষণায় আত্মহত্যার যেসব কারণ উঠে এসেছে তার মধ্যে রয়েছে যৌতুক ও পারিবারিক নির্যাতন, দাম্পত্য কলহ, উত্ত্যক্ত করা ও প্ররোচিত আত্মহত্যা, প্রেম ও পরীক্ষায় ব্যর্থতা, দারিদ্র্য ও বেকারত্ব, আত্মহত্যার উপকরণের সহজপ্রাপ্যতা, মানসিক অসুস্থতা, জটিল শারীরিক রোগ যন্ত্রণা থেকে আত্মহত্যা, নগরায়ন ও পরিবারতন্ত্রের বিলুপ্তি ও নৈতিক অবক্ষয় ও সামাজিক অস্থিরতা।

দেশের ৮টি বিভাগে স্কুল ও কলেজ পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের মধ্যে আত্মহত্যার দিক থেকে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ হার চট্টগ্রামে। সবচেয়ে বেশি হয়েছে ঢাকা বিভাগে। আঁচল ফাউন্ডেশনের এক জরিপ থেকে দেখা যায়, স্কুলপড়ুয়া থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া অর্থাৎ সকল স্তরের শিক্ষার্থীদের মধ্যেই আত্মহত্যা সংক্রামক হারে বেড়ে চলছে। সমীক্ষার ফলাফলে জানানো হয়েছে, স্কুল এবং কলেজ পড়ুয়া আত্মহত্যাকারী শিক্ষার্থীদের মধ্যে নারী ৬৩.৯০ শতাংশ এবং পুরুষ ৩৬.১ শতাংশ। শুধু স্কুলগামী শিক্ষার্থীদের মধ্যে আত্মহত্যাকারী নারী শিক্ষার্থী ৬৫.৩০ শতাংশ এবং পুরুষ শিক্ষার্থী ৩৪.৭০ শতাংশ। অন্যদিকে, শুধু কলেজ পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের মধ্যে আত্মহননকারীদের মধ্যে নারী ৫৯.৪৪ শতাংশ এবং পুরুষ ৪০.৫৬ শতাংশ রয়েছে। সমীক্ষায় প্রাপ্ত তথ্য এবং উপাত্ত থেকে জানা যায়, ১৩ থেকে ১৯ বছর বয়সী শিক্ষার্থীরাই সবচেয়ে বেশি আত্মহত্যার দিকে এগিয়ে গেছে। সংখ্যায় তা ৪০৫ জন এবং শতকরা হিসেবে ৭৬.১২ শতাংশ। তন্মধ্যে নারী ৬৫.৯৩ শতাংশ এবং পুরুষ ৩৪.০৭ শতাংশ রয়েছেন। আবার ৭ থেকে ১২ বছর বয়সী শিক্ষার্থী রয়েছেন ৪৩ জন বা ৮.০৮ শতাংশ। এর ভেতর নারী ৪৬.৫২ শতাংশ থাকলেও পুরুষ রয়েছেন ৫৩.৪৮ শতাংশ।

বয়ঃসন্ধিকালে শারীরিক ও মানসিক পরিবর্তনের সাথে শিক্ষার্থীদের মানিয়ে নিতে প্রতিকূল পরিবেশের মুখোমুখি হতে হয় বলেই এ বয়সে আত্মহত্যার হার বেশি বলে বিশেষজ্ঞদের ধারণা।

অনুসন্ধানে জানা যায়, পরিবারের পক্ষ থেকে অভিযোগ না করার কারণে আত্মহত্যার ঘটনা সাধারণত ইউডি (আননেচারাল ডেথ বা অপমৃত্যু) হিসেবেই যবনিকাপাত ঘটে। এছাড়া পুলিশের পক্ষ থেকে স্বপ্রণোদিত হয়ে যদি আত্মহত্যার মামলাগুলো তদন্ত করা যায় তাহলে বেশির ভাগ আত্মহত্যার প্ররোচণাকারীদেরই সনাক্ত করা সম্ভব। তবে আত্মহত্যার ক্ষেত্রে আইনের এই ধারাটিকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন আইন বিশেষজ্ঞরা।

বিশিষ্ট মানবাধিকার কর্মী এডভোকেট জিয়া হাবীব আহসান আজাদীকে বলেন, পুলিশ ইচ্ছে করলেই দণ্ডবিধির ৩০৬ ধারামতে আত্মহত্যার প্ররোচণাকারীদের শাস্তি দেওয়ার উদ্যোগ নিতে পারে। কিন্তু ব্যস্ততার অজুহাতে পুলিশ তা করতে চায় না। কারণ হিসেবে তিনি আরও বলেন, আত্মহননকারীর পরিবারের পক্ষ থেকে পুলিশকে সহযোগিতা না করার কারণে পুলিশ উদ্যোগী হয়ে ৩০৬ ধারার মামলা নিতে চায় না।

পূর্ববর্তী নিবন্ধবাড়ল পেঁয়াজ ও আলুর দাম
পরবর্তী নিবন্ধআলোকিত জীবনের প্রত্যাশা, শেষ হলো রাখাইনদের জলকেলি