চট্টগ্রামের চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলন

নাজিমুদ্দীন শ্যামল | মঙ্গলবার , ২১ সেপ্টেম্বর, ২০২১ at ১০:৩৮ পূর্বাহ্ণ


ভারত উপমহাদেশের চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলনে চট্টগ্রামের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। ১৯৪৭ সালে ভারতের প্রথম চলচ্চিত্র সংসদ ক্যালকাটা ফিল্ম সোসাইটি গঠনে মূখ্য ভূমিকা পালন করেছিলেন বিশ্ববরেণ্য চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায় এবং বিশ্ববরেণ্য চলচ্চিত্র সমালোচক বিদ্যানন্দ দাশগুপ্ত চট্টগ্রামই সন্তান। তাঁর জন্ম ও আদি নিবাস আনোয়ারা থানার পরৈ পাড়া গ্রামে। ক্যালকাটা ফিল্ম সোসাইটির আরেক পুরোধা ব্যক্তিত্ব ছিলেন নিত্যানন্দ দত্ত। তিনি সত্যজিৎ রায়ের সহকারী পরিচালক হিসাবে কাজ করেন এবং পরে তিনি নিজেই অনেক চলচ্চিত্র পরিচালনা করে ভারতের চলচ্চিত্রে অনেক স্বকীয় ধারার পরিচালক হিসেবে নিজেকে সুপ্রতিষ্ঠিত করেন। তিনি ভারতের কেন্দ্রীয় চলচ্চিত্র অধিদপ্তরের সর্বোচ্চ কর্তা হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। তাঁর বাড়িও চট্টগ্রামে। তিনি চট্টগ্রামের রাউজান থানার নোয়াপাড়ার সন্তান অর্থাৎ ভারতের চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলনের সূচনার তিন প্রধান পুরুষের দুই জনই ছিলেন চট্টগ্রামের। তাছাড়াও চট্টগ্রামের রাউজানের নোয়াপাড়ার আরেক কৃতীসন্তান কল্প তরু সেনগুপ্ত কলকাতা সিনে সেন্ট্রালের সভাপতি হিসাবে অনেক বছর দায়িত্ব পালন করেছেন।
বাংলাদেশের চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলনের সূচনা হয় বিগত শতাব্দীর ষাটের দশকে। ১৯৬৩ সালে আনোয়ারুল হক খান, ওয়াহিদুল হক ও মুহম্মদ খসরুর উদ্যোগে পূর্ব পাকিস্তান চলচ্চিত্র সংসদ প্রতিষ্ঠিত হয় যা স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সংসদ নামেই আত্ম প্রকাশ করে।
আর চট্টগ্রামের চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলনের সূচনা হয় ১৯৬৫ সালে। ঐ বছর চট্টগ্রামের পতেঙ্গায় ইস্টার্ন রিফাইনারী স্থাপনের কাজ শুরু হয়। ওই সময় ইস্টার্ন রিফাইনারী নির্মান কাজের সাথে জড়িত ফরাসী প্রকৌশলী ও কর্মকর্তাগণ মিলে চট্টগ্রাম চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলনের গোড়াপত্তন করেন। একই বছর চট্টগ্রামে অলিয়ঁস ফ্রঁসেজ প্রতিপালিত হয়েছিল। ফরাসী ব্যক্তিবর্গ ও চট্টগ্রামের প্রকৌশলী ও কর্মকর্তা যারা ওই প্রকল্পে কাজ করতেন তাঁরা মিলে চালু করেছিলেন ইস্টার্ন ফিল্ম সোসাইটি। এটিই চট্টগ্রামের প্রথম চলচ্চিত্র সংসদ। সেই সময় মেহেদিবাগস্থ অলিয়াঁস ফ্রসেজে এই চলচ্চিত্র সংসদটি নিয়মিত চলচ্চিত্র প্রদর্শনীর আয়োজন করতো। উল্লেখ্য ফরাসীদের সাথে তৎকালীন রেল কর্মকর্তা এস এম আফজাল, ইস্টার্ন রিফাইনারীর সাব্বির আহমেদ এবং চট্টগ্রামের ব্যবসায়ী হায়দার রেজা চট্টগ্রামের প্রথম এই চলচ্চিত্রটির প্রতিষ্ঠাতা ও কর্মকাণ্ড পরিচালনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন।
ষাট দশকের শেষদিকে চট্টগ্রাম ক্লাবের কতিপয় অবাঙালি সদস্য চট্টগ্রামের ফিল্ম ক্লাব নামে আরেকটি চলচ্চিত্র সংসদ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তারা সেই সময় চট্টগ্রাম ক্লাবে নিয়মিত চলচ্চিত্র প্রদর্শনীর আয়োজন করতেন। কিন্তু ১৯৭০ সালের মধ্যভাগ থেকে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময়কালে এখানকার চলচ্চিত্র সংসদগুলো করা হয়ে যায়। পরে স্বাধীনতা উত্তর কালে এই দুইটি সংগঠন খুবই সীমিত আকারে অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখলেও কার্যকর চলচ্চিত্র গড়ে তুলতে আর পারেনি।
১৯৭২ সালে বাংলাদেশ ফিল্ম সোসাইটির শাখা হিসাবে চট্টগ্রাম চলচ্চিত্র সংসদ প্রতিনিধিত্ব হলে এখানে কার্যকরী ধারার চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলন শুরু হয়। ১৯৭২ সালে অধ্যাপক আবুল ফজলের সভাপতিত্বে চট্টগ্রাম চলচ্চিত্র সংসদ গঠিত হয়। এই সময়ে চট্টগ্রাম চলচ্চিত্র সংসদের সাথে জড়িত ছিলেন শামসুল হোসাইন বাহাদুর, আবুল মোমেন, আব্দুল মান্নান, অমিত চন্দ, হাসান শাহীন, ফরিয়াদুল ইসলাম সহ আরো অনেকেই। চট্টগ্রাম চলচ্চিত্র সংসদ সেই সময় নিয়মিত চলচ্চিত্র প্রদর্শনী, চলচ্চিত্র বিষয়ক পাঠচক্র ইত্যাদি আয়োজন করে। চট্টগ্রাম চলচ্চিত্র সংসদের ৫০তম প্রদর্শনী উপলক্ষ্যে সেই সময় একটি পুস্তিকা প্রকাশ করা হয়। পরবর্তীতে চট্টগ্রাম চলচ্চিত্র সংসদ এপিক নামে একটি বুলেটিন প্রকাশ করে। সেই সময় ভারতের পুনে ফিল্ম ইন্সটিটিউটের প্রফেসর সতীশ বাহাদুর ঢাকায় একটি কর্মশালা পরিচালনা করেছিলেন। চট্টগ্রাম চলচ্চিত্র সংসদের কর্মীরা সেই কর্মশালায় অংশগ্রহণ করেছিলেন। স্বাধীনতার পর চট্টগ্রাম চলচ্চিত্র সংসদ গঠিত হলে এর কর্মীরাই চট্টগ্রামে চলচ্চিত্র সংস্কৃতির চর্চা ও আন্দোলনকে এককভাবে বেগবান করে যায়। কিন্তু ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার মাধ্যমে রাজনৈতিক পরিবর্তন ও সামরিক শাসন শুরু হলে চট্টগ্রাম চলচ্চিত্র সংসদের কার্যক্রম সাময়িকভাবে বন্ধ হয়ে যায়।
১৯৭৭ সালে ‘ইমেজ ও সিনেমেট’ কাজ শুরু করে। কিন্তু বছর খানেক নিয়মিত কাজ করার পর এই দুইটি চলচ্চিত্র সংগঠন বন্ধ হয়ে যায়। এরপর ১৯৭৮ সালে সোচ্চার ফিল্ম সোসাইটি গঠিত হয়ে বছর খানেক সক্রিয় থাকে। সোচ্চার ফিল্ম সোসাইটির নেতৃত্বে ছিলেন জাহেদ রঞ্জু, কামাল উদ্দিন খান ও আবুল বাশার। পরে ঢাকার সিনেমা পাগলরা চট্টগ্রাম শাখা গঠন করেন। ড. আবু হেনা মোস্তফা কামাল, ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী এবং আহমেদ খালেদ কায়সার এর কার্যক্রমে নেতৃত্ব প্রদান করেন।
১৯৮০ সালে চট্টগ্রামে রেইনবো ফিল্ম সোসাইটির শাখা গঠিত হয়। এই সময় আনোয়ার হোসেন পিন্টু, মাহবুবুর রহমান, শৈবাল চৌধুরী, ইকবাল করিম হাসনু, আলমগীর ফরিদুল হক, শাহেনুর শানু সহ একঝাঁক বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া চলচ্চিত্র কর্মী রেইনবো ফিল্ম সোসাইটির সাথে যুক্ত হয়ে চট্টগ্রামের চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলনকে বেগবান করে তোলেন।
১৯৮০ সালে চট্টগ্রামের ইউসিস মিলনায়তনে ব্রিটিশ চলচ্চিত্র কর্মী জন ওয়ারিংটন একটি চলচ্চিত্র কর্মশালা পরিচালনা করেন। এতে চট্টগ্রামের তরুণ চলচ্চিত্র কর্মীরা অংশগ্রহণ করেন।
উল্লেখ্য রেইনবো ফিল্ম সোসাইটি কয়েকটি চলচ্চিত্র কর্মশালা আয়োজন করে। তাছাড়াও ইন্টারনেট নামে একটি সিরিয়াস চলচ্চিত্র পত্রিকা প্রকাশ করেন। তাছাড়াও এই সংসদটি চলচ্চিত্র চিন্তা নামে সংগঠনের মুখপত্র প্রকাশ করেন। এই দুইটি পত্রিকার বেশ কয়েকটি সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছিল।
সেই সময় চিত্রালী পাঠক-পাঠিকা ফোরামের সদস্যরা মিলেই িিচপাচস অর্থাৎ চিত্রালী পাঠক পাঠিকা চলচ্চিত্র সংসদ নামে একটি সংগঠন গড়ে তুলে।
১৯৮১ সালে বরেণ্য চিত্রশিল্পী মর্তুজা বশারের নেতৃত্বে চট্টগ্রাম চলচ্চিত্র সংসদ পুনর্গঠিত হয়। সেই সময় আবুল মোমেন, আবুল মনসুর, মৃণাল সরকারের মতো সিনিয়র চলচ্চিত্র কর্মীরা যেমন এই সংগঠনের সাথে সম্পৃক্ত হন তেমনি আনোয়ার হোসেন পিন্টু, ইকবাল করিম হাসনু, শৈবাল চৌধুরী,আলমগীর ফরিদুল হক, মাহবুবুল হক, অনিল ব্যানার্জী অপু, আতিকুল ইসলাম সহ অনেক চলচ্চিত্র কর্মী এর সাথে যুক্ত হন। সেই সময় মর্তুজা বশীর ছিলেন সংসদের সভাপতি, আনোয়ার হোসেন পিন্টু ছিলেন সাধারন সম্পাদক এবং শৈবাল চৌধুরী ছিলেন কোষাধ্যক্ষ। পুনর্গঠনের পর ১৯৮২ সালে চট্টগ্রাম চলচ্চিত্র সংসদের মুখপত্র লুক থ্রু প্রকাশিত হয়। পরবর্তীতে অধ্যাপক আবুল মনসুর সভাপতি, শাহেদুজ্জামান মুন্না সাধারন সম্পাদক ও শৈবাল চৌধুরী কোষাধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করেন। এরপরে শফিকুল আলম সাধারণ সম্পাদক, নাজিমুদ্দীন শ্যামল নির্বাহী সম্পাদক এবং শৈবাল চৌধুরীকে কোষাধ্যক্ষ করে সভাপতি আবুল মনসুরের নেতৃত্বে কমিটি গঠিত হয়। পরে আবুল মনসুর সভাপতি, নাজিমুদ্দীন শ্যামল সাধারন সম্পাদক এবং শৈবাল চৌধুরী কোষাধ্যক্ষ হিসাবে ১৯৯২ সাল পর্যন্ত চট্টগ্রাম চলচ্চিত্র সংসদের নেতৃত্ব দেন।
চট্টগ্রাম চলচ্চিত্র সংসদে সেই সময় সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিলেন আনোয়ার হোসেন পিন্টু, ইকবাল করিম হাসনু, আলমগীর ফরিদুল হক, শৈবাল চৌধুরী, আলম খোরশেদ, শাহেদুজ্জামান, নুরুল ইসলাম, আনোয়ারুল ইসলাম জুয়েল, নাজিমুদ্দিন শ্যামল, হাসান ইমাম, ইফতেখার কামাল খান, শোভরাজ চৌধুরী আইয়ুব, মিজানুর রহমান, ডা. সালমা সুলতানা, ডা. কুহু মুস্তফা, সৈয়দ আবদুল্লাহ খালিদ, ঢালি আল মামুন, জাবের আহমেদ চৌধুরী, শফিকুল আলম, স্থপতি বিধান বড়ুয়া, শান্তনু দাশ গুপ্ত, হাসান মুরাদ, প্রদীপ দেওয়ানজী, অরুণ দাশ গুপ্ত, কমলেশ দাশ গুপ্ত, সেলিম হাসান, জাহেদ চৌধুরী, গৌতম নন্দী, পোপাল দাশ, নাজলী মনসুর, আবদুল মান্নান, সুপ্রিয় রক্ষিত সহ অনেকেই।
চট্টগ্রাম চলচ্চিত্র সংসদ গত শতাব্দীর আশির দশক থেকে নব্বই এর দশকের প্রারম্ভিক দুই বছর চট্টগ্রামে প্রকৃতার্থে চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলনের ব্যাপক বিস্তার করতে সমর্থ হয়। এই সংগঠনের সংঘবদ্ধ নেতৃত্বে এই আমলের মানুষকে চলচ্চিত্র সংস্কৃতিক সাথে শুধু সংযুক্তই করেনি বরং দেশের চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলনে ব্যাপক ভ্থমিকা রেখেছিলো, সেই সময় ইউসিস, ভারতীয় হাইকমিশন, সোভিয়েত দূতাবাস, আলিয়ঁস ফ্রঁসেজ বৃটিশ কাউন্সিল, ইঞ্জিনিয়ারস ইনস্টিটিউট শিল্পকলা একাডেমি, শিশু একাডেমি, মুসলিম হল, স্টুডিও থিয়েটার সহ নানা স্থানে নিয়মিত চলচ্চিত্র প্রদর্শনী, উৎসব, রেট্রোস্পেকটিভ ও নানা অনুষ্ঠান আয়োজন করতো।
১৯৮৪ সালে চট্টগ্রাম চলচ্চিত্র সংসদ বাংলাদেশের প্রথম স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র আগামী সহ অনেকগুলো দেশে-বিদেশের স্বল্প দৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র প্রদর্শন করে। ১৯৮৫ সালে বাংলাদেশ ফেডারেশন অব ফিল্ম সোসাইটিজর সাথে যৌথভাবেও বৃটিশ কাউন্সিলের সহযোগিতায় চলচ্চিত্র অধ্যাপক জেমস লিহির দুইদিনব্যাপ িকর্মশালা পরিচালনা করে। তাছাড়াও চলচ্চিত্র গবেষক ফাদার গাঁস্ত রোবের্জ ও বিদ্যানন্দ দাসগুপ্তের পরিচালনায় পৃথক দুইটি ফিল্ম এপ্রিসিয়েশন কোর্স করে। চলচ্চিত্র গবেষক এবং ঋত্বিক গবেষক বাঁধন সেনের পরিচালনায় ফির্ম এপ্রিসিয়েশন কোর্স পরিচালনা করা হয়। চলচ্চিত্রকার শিল্পী ও কবি পূর্ণেন্দু ৃ ও চট্টগ্রাম চলচ্চিত্র সংসদেও আমন্ত্রণে চট্টগ্রামে কর্মশালা পরিচালনা করেছিলেন। চট্টগ্রাম চলচ্চিত্র সংসদ থেকে শৈবাল চৌধুরী, নাজিমুদ্দীন শ্যামল, জাবের আহমেদ চৌধুরী ও শফিকুল আলম সহ কয়েকজন চলচ্চিত্র কর্মী ১৯৯০ সালে ভারতের আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে বাংলাদেশের প্রতিনিধি দলের সাথে অংশগ্রহণ করেছিলেন।
চট্টগ্রাম চলচ্চিত্র সংসদের উদ্যোগে পরপর তিনবার জাপান চলচ্চিত্র উৎসব, জার্মান চলচ্চিত্র অধিবেশন, ফরাসী নিউওয়েভ চলচ্চিত্র অধিবেশন, ফ্যাসিবাদ বিরোধী চলচ্চিত্র অধিবেশন সহ অজস্র চলচ্চিত্র অধিবেশন আয়োজন করা হয়েছিল। জহির রায়হান, লুই বুনুয়েল, ভিম ভেন্ডার, চ্যালি চ্যাপলিন, রনে ক্লেয়ার, ফাস ভিন্দার সহ অনেক বিখ্যাত চলচ্চিত্রকারের ছবি নিয়ে রেট্রোসেপকটিভ আয়োজন করা হয়েছে। চট্টগ্রাম চলচ্চিত্র সংসদ ১৯৯১ সালে বাংলাদেশ শর্ট ফিল্ম ফোরামের সাথে যৌথ উদ্যোগে দ্বিতীয় জাতীয় স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র উৎসব চট্টগ্রামে সফলতার সাথে আয়োজন করে। এই উৎসবে দেশের প্রায় সকল স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাতা ও কুশলীরা অংশগ্রহণ করেছিলেন। চট্টগ্রাম চলচ্চিত্র সংসদ বাংলাদেশের প্রথম ও দ্বিতীয় বিজয় মেলায় ১৯৮৯ ও ১৯৯০ সালে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র প্রদর্শন করেছিলো।
১৯৯৩ সালের ১ জানুয়ারী শৈবাল চৌধুরী ও নাজিমুদ্দীন শ্যামলের নেতৃত্বে চট্টগ্রাম চলচ্চিত্র কেন্দ্র প্রতিষ্ঠিত হয় শৈবাল চৌধুরী পরিচালক, নাজিমুদ্দীন শ্যামলকে সাধারণ সম্পাদক করে চট্টগ্রাম চলচ্চিত্র কেন্দ্রের কমিটি গঠিত হয়। চট্টগ্রাম চলচ্চিত্র কেন্দ্র গঠনের সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন মিজানুর রহমান, গৌতম নন্দী, হাসান ইমাম, আবু নঈম মাহতাব মোর্শেদ, দেবাশীষ রায়, ইফতেখার কামাল খান, শোভরাজ চৌধুরী আইয়ুব, আবু ইউসুফ সহ অনেক চলচ্চিত্র কর্মী। চট্টগ্রাম চলচ্চিত্র কেন্দ্র শুরু থেকেই। বিএফসির রেজিস্ট্রেশন প্রাপ্ত হয়। চট্টগ্রাম চলচ্চিত্র কেন্দ্র ফরাসী চলচ্চিত্র উৎসব, আফির্শন চলচ্চিত্র উৎসব, রণে ক্লেয়ার, কুরোশোয়া, অপর্ন সেন, সত্যজিৎ রায়, আদুর গোপাল কৃষ্ণানন, মৃনাল সেন, ঋত্বিক ঘটক, উত্তম কুমার রেট্রোসেপকটিভ সহ বিশ্ব বরেণ্য প্রায় সকল বিখ্যাত চলচ্চিত্রকারের সিনেমা নিয়ে রেট্রোস্পেকটিও আয়োজন করে। চট্টগ্রাম চলচ্চিত্র কেন্দ্র ১৯৯৯ সালে চট্টগ্রামে সফলভাবে আন্তর্জাতিক স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র উৎসব আয়োজন করেছে। এই উৎসবের পরিচালক ছিলেন শৈবাল চৌধুরী ও উৎসব সচিব হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন নাজিমুদ্দীন শ্যামল। তাছাড়াও চট্টগ্রাম চলচ্চিত্র কেন্দ্র আড়াই দশকের বেশি সময় ধরে চট্টগ্রামে চলচ্চিত্র আন্দোলনের ও চলচ্চিত্র সংস্কৃতি চর্চার ক্ষেত্রে অনন্য অবদান রেখে চলেছে।
চট্টগ্রাম চলচ্চিত্র কেন্দ্র সাজ্জাদ হোসেন উৎপল, গোলাম হায়দার কিসলু, কবির সাদিক, আরশাদ হোসেন, গিয়াস আহমদ, সৈকত দে, রিপন সাহা, নাসির জুয়েল, ডাঃ শুভার্থী কর, ডাঃ সালমা সুলতানা, ডাঃ কুদ্দু মুস্তফা, হাফিজ রশিদ খান, ডাঃ জিল্লুর রহমান, অভিজিৎ সেনগুপ্ত, সহ অনেকেই কেন্দ্রের প্রথম উৎসব উদ্বোধন করেচিলেন প্রফেসর সৈয়দ আব্দুল্লাহ খালিদ। ড. অনুপম সেন, অরুণ দাশগুপ্ত, প্রদীপ দেওয়ানজী, সিদ্দিকী আহমেদ, বেগম মুশতারী শফী, অধ্যাপক তপন জ্যোতি বড়ুয়া, অধ্যাপক ইফতেখার উদ্দিন, শুক্লা ইফতেখার, স্থপতি বিধান বড়ুয়া, জাপানের অনারারী কনসাল মুহাম্মদ নুরুল ইসলাম, আলহাজ্ব নুরুল ইসলাম বিএসসি সহ অনেকেই সংশ্লিষ্ট থেকে একে একে দেশের অন্যতম সেরা চলচ্চিত্র সংগঠনের পরিনত করেছন।
চট্টগ্রাম চলচ্চিত্র কেন্দ্র শুরুতেই ভারতের অধ্যাপক মিহির ভট্টাচার্যেও ফিল্ম এপ্রিসিয়েশন কোর্স করে। এ পর্যন্ত প্রায় শতাধিক কোর্স ও সেমিনার সিম্পোজিয়াম আয়োজন করেছে।
১৯৯৪ সালে ভারতের আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে চট্টগ্রাম চলচ্চিত্র কেন্দ্রে শৈবাল চৌধুরী ও নাজিমুদ্দীন শ্যামলের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল অংশগ্রহণ করে। এই উৎসব উদ্বোধন করেছিলেন বিশ্ববরেণ্য চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়।
চট্টগ্রাম চলচ্চিত্র কেন্দ্র তার মুখপত্র নিউওয়েভ ও বুলেটিন চিত্রাকৃতির অনেকগুলো সংখ্যা প্রকাশ করেছে। তাছাড়াও চলচ্চিত্র প্রদর্শনী উপলক্ষে ফোল্ডার, হ্যান্ড আউট, পুস্তিকা প্রকাশ করে সদস্যদের চলচ্চিত্রে স্বাদ গ্রহণের পথ সুগম করেছে।
১৯৯৩ সালে আনোয়ার হোসেন পিন্টুর নেতৃত্বে চট্টগ্রামে ‘সত্যজিৎ চর্চা কেন্দ্র’ গঠিত হয়। তাঁর এই উদ্যোগের সাথে স্বপন দত্ত, নাজিমুদ্দীন শ্যামল, দেবাশীষ রায়, হাসিনা বেগম, শেখ মীরাজুল ইসলাম সহ বেশ কয়েকজন চলচ্চিত্র কর্মী সম্পৃক্ত হয়ে কাজ করে যাচ্ছেন। সত্যজিৎ চর্চা কেন্দ্র মূলত সত্যজিৎ রায়ের উপর চর্চা ও গবেষণার প্রতিষ্ঠান হিসাবে বিগত আড়াই দশকে দুই বাংলায় খ্যাতি লাভ করেছে। ‘সত্যজিৎ চর্চা’ নামে এই প্রতিষ্ঠানের মুখপাত্র প্রকাশিত হয়ে থাকে যা চলচ্চিত্র চর্চা ও গবেষণার ক্ষেত্রে নতুন মাত্রা যোগ করেছে।
চট্টগ্রাম চলচ্চিত্র সংসদ ও চট্টগ্রাম চলচ্চিত্র কেন্দ্রের অর্ধশতাব্দীর বেশি সময়ের চলচ্চিত্র আন্দোলনের প্রেক্ষিতে চট্টগ্রামে বেশ কিছু চলচ্চিত্র কর্মী সৃষ্টি হয়েছে। এর মধ্যে চলচ্চিত্র বিষয়ক গবেষক, লেখক, চলচ্চিত্র নির্মাতা, কুশলী ইত্যাদি যেমন রয়েছে তেমনি আরো অনেকগুলো চলচ্চিত্র সংগঠন সাম্প্রতিক বছরগুলোতে নানাভাবে কাজ করেছে। চট্টগ্রামে আরো যে সব চলচ্চিত্র সংগঠন কাজ করেছে বা করছে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় চলচ্চিত্র সংসদ, কর্ণফুলী ফিল্ম সোসাইটি, চিল্ড্রেন ফিল্ম সোসাইটি, চট্টগ্রাম ফিল্ম কাউন্সিল, অযান্ত্রিক মিডিয়া স্টাডিজ সেন্টার, সিনে ক্লাব বিস্তার, সিনে বার (ডিপার্টমেন্ট অব ফাইন আর্টস, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়), দৃশ্য ছায়া, রেবেল অ্যান্ট, মিঁজোসীন ইত্যাদি। এর মধ্যে অনেকগুলো সংগঠন চলচ্চিত্র বিষয়ক কর্মশালা, প্রশিক্ষণ ও সিনেমা নিয়ে সিরিয়াস পত্রিকা প্রকাশ করে চলচ্চিত্র সংস্কৃতি চর্চায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। এসব সংগঠনের পাশাপাশি ডিজিটাল ফরমেটে নীরিক্ষাধর্মী বেশ কিছু চলচ্চিত্র নির্মানেও এগিয়ে এসেছে যা চট্টগ্রামে চলচ্চিত্র চর্চার ক্ষেত্রে নতুন আশার সঞ্চার করেছে।
তরণ চলচ্চিত্র সংসদ কর্মীদের মধ্যে ইফতেখার আহমদ সায়মন, মুজিবর রহমান সজীব, রিজোয়ান রাজন, মাসউদুর রহমান, আসবাবীর রাপসান, পংকজ চৌধুরী রনি, অলিউর রহমান, জুনায়েদ রশীদ প্রমুখ নাম উল্লেখযোগ্য।
চট্টগ্রামের চলচ্চিত্র কর্মীদের মধ্যে অনেকের চলচ্চিত্র বিষয়ক লেখা পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে এর মধ্যে আনোয়ার হোসেন পিন্টু (চলচ্চিত্র কথা, সত্যজিৎ ও রবীন্দ্রনাথ, সম্পাদন), শৈবাল চৌধুরী ( রৌদ্র ছায়ার লুকোচুরি খেলা ও চলচ্চিত্রের পটভূমিকায়) এবং নাজিমুদ্দীন শ্যামল (চলচ্চিত্র বীক্ষন ও সিনেমার কথা) এর চলচ্চিত্র বিষয়ক বেশ কয়েকটি মৌলিক গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে।
নানা সীমাবদ্ধতার মধ্যেও চট্টগ্রামের চলচ্চিত্র সংসদ কর্মীরা চলচ্চিত্র বিষয়ক গবেষণা, লেখালেখি ও চলচ্চিত্র নির্মাণ প্রয়াসে সচেষ্ট রয়েছেন। দীর্ঘ অর্ধশতাব্দীর বেশিকালের চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলনে চট্টগ্রামের অর্জন নেহায়েত অপ্রতুল নয়। সারা দেশের চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলনের তুলনায় চট্টগ্রামে এই আন্দোলন এখনো অনেক বেশি বেগবান ও ফলপ্রসূ। লেখক : কবি, সাংবাদিক

পূর্ববর্তী নিবন্ধকনডেম সেল নিয়ে প্রতিবেদন চাইল হাই কোর্ট
পরবর্তী নিবন্ধকেইপিজেড : শিল্পায়নের মাইলফলক