কেইপিজেড : শিল্পায়নের মাইলফলক

এম নুরুল ইসলাম | মঙ্গলবার , ২১ সেপ্টেম্বর, ২০২১ at ১০:৩৮ পূর্বাহ্ণ


কোরিয়ান এক্সপোর্ট প্রসেসিং জোনের (কেইপিজেড) হাত ধরেই দক্ষিণ চট্টগ্রামে সূচনা হয়েছিল শিল্পায়নের যাত্রা। সেটি ১৯৯৯ সালের কথা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেই সময়ে কেইপিজেড প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে আড়াই হাজার একর জমি বরাদ্দ প্রদান করেন। সেখানে এখন গড়ে উঠেছে ২৭টি শিল্প কারখানা। পরিকল্পনাধীন আছে আরো ৪৫। যেখানে কাজ করছে ২৬ হাজার কর্মী। এই একে ইপিজেড রপ্তানি করেছে ৮৫০০ কোটি টাকার পন্য। যা সম্ভাবনার নতুন বাংলাদেশের জন্য একটি মাইলফলক।
কর্ণফুলী শাহ আমানত সেতু পেরিয়ে সামনে কিছুদূর গেলে কর্ণফুলী উপজেলার দৌলতপুরে চোখে পড়বে কেইপিজেডের দৃষ্টিনন্দন গেইট। পাহাড় সুরক্ষিত রেখে সবুজ আর প্রকৃতির মিশেলে এখানে শুধু শিল্পায়ন নয়, সৌন্দর্যও বাড়িয়েছে বহুগুণ। এখানে দিনরাত চলছে উন্নয়নযজ্ঞ। নতুন শিল্প কারখানা গড়ে তোলার কাজ।
কেইপিজেডে বর্তমানে ৩৪টি বিশ্বমানের কারখানায় ফুটওয়্যার, পোশাক শিল্প এবং টেঙটাইল পণ্য উৎপাদিত হচ্ছে। এখন পর্যন্ত এখানে প্রায় ২৬ হাজার মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে। এখানে আরো ৪৫ কারখানা স্থাপনের পরিকল্পনা রয়েছে বলে জানান কেইপিজেডের উপ মহাব্যবস্থাপক মুশফিকুর রহমান। তিনি বলেন, কেইপিজেড এর মধ্যে এই এলাকার জীবনমান বদলে দিয়েছে। ২৬ হাজার কর্মী এখানে কাজ করলেও এই ইপিজেডকে ঘিরে ভাগ্য বদলেছে লাখো মানুষের। এখন হাইটেক পার্কের কাজ চলছে। ১০০ একর জায়গার উপর এই হাইটেক পার্ক নির্মিত হলে অনেকদূর এগিয়ে যাবে স্বপ্নের বাংলাদেশ। ইপিজেডে চারটি টেঙটাইল জোন, একটি আইটি জোন ও মহিলা শ্রমিকদের জন্য ডরমিটরিসহ ব্যাপক অবকাঠামোগত উন্নয়নকাজ চলছে বলে জানান তিনি।
সবগুলো কারখানা চালু হলে প্রায় তিন লাখ লোকের কর্মসংস্থান হবে এবং এর মধ্য দিয়ে আনোয়ারা-পটিয়া-বাঁশখালী, চন্দনাইশ ও কর্ণফুলীসহ দক্ষিণ চট্টগ্রামের অর্থনৈতিক চিত্র পাল্টে যাবে বলে কর্তৃপক্ষের দাবি। এগুলোর মধ্যে প্রায় ১৫ হাজার বর্গফুটের ১০ টি কারখানা নির্মাণাধীন রয়েছে। বাকি ৩৫টির কাজ দ্রুততম সময়ের মধ্যে শেষ হবে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা।
কেইপিজেড করপোরেশন (বিডি) লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক কর্নেল (অব.) মোহাম্মদ শাহজাহান বলেন, ‘বর্তমানে স্থাপিত কারখানাগুলোয় কর্মরত রয়েছে প্রায় ২৬ হাজার শ্রমিক। যাদের সিংহভাগই স্থানীয়। তাদের বার্ষিক আয় প্রায় ২০০ কোটি টাকা।’ তিনি বলেন, কেইপিজেড বরাবরই সবুজায়ন ও সামাজিক দায়বদ্ধতার কাজ করে যাচ্ছে। সৌরবিদ্যুত প্রকল্পের মাধ্যমে টেকসই পদ্ধতিতে এর বাড়তে থাকা বিদ্যুৎ শক্তির চাহিদা পূরণের পাশাপাশি জাতীয় গ্রিডে অতিরিক্ত নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ শক্তি সরবরাহের মাধ্যমে সামাজিক দায়বদ্ধতায় কাজ করবে।
কেইপিজেডের পরিকল্পনা অনুযায়ী, ১০০ একর জমিতে একটি তথ্যপ্রযুক্তিশিল্প এলাকা হবে। ১৪০ একর জমিতে একটি টেঙটাইল-শিল্প এলাকা হবে। ওষুধ শিল্পের জন্য জমি থাকবে ৫০ একর। এছাড়া কৃষি প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্প ও মাঝারি শিল্পের জন্য নির্ধারিত জমি থাকবে। সব মিলিয়ে অবকাঠামো উন্নয়নে ব্যয় হবে ২০ কোটি ডলার। সেখান থেকে বছরে ১০০ কোটি ডলারের পণ্য রফতানি হবে বলে আশা করছে কেইপিজেড কর্তৃপক্ষ।
এখানে ১০০ একর জমিতে গড়ে তোলা হচ্ছে হাইটেক পার্ক। মূলত মেড ইন বাংলাদেশ ব্রান্ডকে সারাবিশ্বে ছড়িয়ে দিতে এই উদ্যোগ। হাইটেক পার্কে গার্মেন্টস, টেঙটাইল, সুজ এসব ফ্যাক্টরির পাশাপাশি আইটি সেক্টরে বিনিয়োগ হবে। খুব অল্প সময়ের মধ্যে আইটি সেক্টর ও ইপিজেডে আরো ২০ হাজার লোকের কর্মসংস্থানের সুযোগ হবে বলে আশা উদ্যোক্তাদের।
হাইটেক পার্ক বাস্তবায়নে গত ২২ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ হাইটেক পার্ক কর্তৃপক্ষ, কেইপিজেড কর্তৃপক্ষ ও স্টার্টআপ বাংলাদেশ লিমিটেডের মধ্যে ত্রি-পক্ষীয় চুক্তি বাস্তবায়ন হয়। উদ্যোক্তারা জানান, এই পার্ক থেকে শিক্ষা, প্রযুক্তি প্রশিক্ষণ ও মানবসম্পদ উন্নয়নে দক্ষ জনশক্তি তৈরি হবে। ইয়ংওয়ান কর্পোরেশন তাদের সহযোগী সংস্থা টেকভিশন (বিডি) লিমিটেডের মাধ্যমে এই পার্কে প্রায় ২শ‘ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করবে বলে জানা গেছে। যা সফটওয়্যার, শিল্পোন্নয়ন, ডাটা এন্ট্রি ও আউটসোর্সিং-এ দক্ষ জনশক্তিতে তৈরিতে ভূমিকা রাখবে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, ২০৪১ সালে বাংলাদেশকে উন্নত দেশের কাতারে পৌঁছানোর স্মারক হিসাবে এই হাইটেক পার্কে ৪১ তলা বিশিষ্ট একটি আইটি ভবন নির্মাণ করা হবে। এখানে বিশ্ববিদ্যালয়, স্কুল ও কমিউনিটি কমপ্লেঙ থাকবে। প্রায় ২০ হাজার মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হবে।
কেইপিজেড ইতিমধ্যে এই অঞ্চলে বড় ধরনের কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করেছে। এর টেঙটাইল জোনে এর মধ্যে ১৭ লাখ বর্গফুট আয়তনের কারখানা ভবন নির্মাণের কাজ চলছে এর মধ্যে অর্ধেক নির্মাণ কাজ সম্পন্ন হয়েছে। ভবিষ্যতে এটি পোশাক রপ্তানিকারকদের বৃহত্তম হাব-এ পরিণত হবে। আইটি পার্কসহ সবগুলো প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে কেইপিজেডে প্রায় ৩ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান হবে।
দেশের বৃহত্তম রুফটপ সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের মাধ্যমে এই বছর নতুন চমক সৃষ্টি করেছে কেইপিজেড। ৪০ মেগাওয়াট সমন্বিত সক্ষমতাসম্পন্ন দেশের বৃহত্তম ছাদ সৌর বিদ্যুৎ বা রুফটপ সোলার পাওয়ার প্রজেক্ট-টি চালুর অপেক্ষায় রয়েছে। এছাড়া ৪০ মিলিয়ন ডলারের পরিবেশবান্ধব জ্বালানি প্রকল্পের পাশাপাশি কোরিয়ান প্রতিষ্ঠানটি কেইপিজেডে সবুজ কারখানা ভবন নির্মাণসহ প্রায় ২৪ লাখ বৃক্ষ রোপন করেছে। কেইপিজেড কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, প্রায় ৪০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ব্যয়ে তিন ধাপে প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হবে। এছাড়া, এই ইপিজেডের সকল ভবন সৌরশক্তির সুবিধা পাবে।
প্রথম ধাপে, একটি ১৬ মেগাওয়াট সৌর ফটোভোলটাইক (পিভি) বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপিত হয়েছে। ১৬ মিলিয়ন ডলার ব্যয়ে স্থাপিত এই কেন্দ্র গত জুন মাসে উদ্বোধন করেন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ। দ্বিতীয় ধাপে, চলতি বছরের অক্টোবর নাগাদ ৪.৩ মিলিয়ন ডলায় ব্যয়ে ৪.৩ মেগাওয়াট সৌর প্যানেল স্থাপনের সময়সীমা নির্ধারণ করা হয়েছে। তৃতীয় ধাপে, ২০ মেগাওয়াটের অপর একটি কেন্দ্র ইনডিপেন্ডেন্ট পাওয়ার প্ল্যান্ট (আইপিপি) হিসেবে স্থাপনের পরিকল্পনা করা হয়েছে। ১২ মাস মেয়াদী এই প্রকল্প সরকারি অনুমোদনের অপেক্ষায় আছে বলে জানিয়েছেন কেইপিজেড করপোরেশনের কর্মকর্তারা। পাওয়ার প্লান্টটি জাতীয় গ্রিডের সাথে সংযুক্ত থাকবে এবং নেট মিটারিং সিস্টেমের অধীনে গ্রিডে অতিরিক্ত বিদ্যুৎ সরবরাহের উপযুক্ত হবে।
বাংলাদেশ বেসরকারি ইপিজেড আইনের অধীনে ১৯৯৬ সালে প্রথম প্রতিষ্ঠান হিসেবে দক্ষিণ কোরিয়ার ইয়াংওয়ান করপোরেশন দেশে বেসরকারি রপ্তানি প্রক্রিয়াজাতকরণ অঞ্চল স্থাপন করে। অঞ্চলটির প্রচার, উন্নয়ন এবং ব্যবস্থাপনার স্বার্থে ‘কোরিয়ান ইপিজেড করপোরেশন (বিডি) লিমিটেড’ নামের একটি প্রতিষ্ঠান গঠিত হয়।
লেখক : দৈনিক আজাদীর আনোয়ারা প্রতিনিধি

পূর্ববর্তী নিবন্ধচট্টগ্রামের চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলন
পরবর্তী নিবন্ধআধুনিক লাইফ স্টাইলের সব সুবিধা নিয়ে নতুন নতুন প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে এপিক প্রপার্টিজ