গ্রামবাংলার পুঁথিপাঠ

বাসুদেব খাস্তগীর | সোমবার , ৫ সেপ্টেম্বর, ২০২২ at ৭:০৫ পূর্বাহ্ণ

পুঁথি শব্দটার সাথে কম বেশি সবাই পরিচিত। বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলের মানুষের কাছে পুঁথি অতি পরিচিত একটি নাম। পুঁথির বিভিন্ন ইতিহাস পর্যালোচনায় দেখা যায় পুঁথি বাংলা সাহিত্যে ব্যবহৃত অতি প্রাচীন একটি শব্দ। বলা হচ্ছে পুঁথি শব্দের উৎপত্তি ‘পুস্তিকা’ শব্দ থেকে। এ অর্থে পুঁথি শব্দদ্বারা যেকোনো গ্রন্থকে বুঝানো হতো। পুঁথি সাহিত্যের ক্ষেত্রে বিশেষ অর্থ বহন করে। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে একটি বিশেষ সময়ে রচিত বিশেষ ধরনের সাহিত্যই হচ্ছে পুঁথি সাহিত্য। পুঁথির মধ্য দিয়ে গল্প কাহিনি রূপকথা ধর্মীয় উপাখ্যানের বর্ণনা আছে। পুঁথি সুর তাল লয়ে পড়তে হয়। পড়ার সময় অনেক মনোযোগী শ্রোতা একাগ্রচিত্তে মন দিয়ে পুঁথিপাঠ শুনেন। গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যবাহী পুঁথিপাঠ আমাদের সাহিত্য সংস্কৃতিরই অংশ। গ্রামের সাথে নিবিড়ভাবে সম্পর্ক রাখা মানুষরা তো জানেন রাত জেগে পুঁথিপাঠের আসরের কথা। সময়ের স্রোতে সেই পুঁথিপাঠ অনেকটাই হারিয়ে যাচ্ছে। আধুনিকতার নামে নানা সংগীত আমাদের সেই ঐতিহ্যকে গ্রাস করছে। এ প্রজন্মের কাছে অনেকটাই অজানা থেকে যাচ্ছে পুঁথিপাঠের মত গ্রামের ঐতিহ্যমণ্ডিত একটি সংস্কৃতির কথা। গ্রামের বাড়িতে বাড়িতে হ্যাজাক লাইট জ্বালিয়ে প্রতিদিন পুঁথিপাঠের আসর বসতো। যান্ত্রিকতার এযুগেও মাঝে মাঝে গ্রামাঞ্চলে পুঁথির আসর বসে। এই পুঁথি পড়ার মধ্যে এক ধরনের কৌশল দ্যোতনা ছন্দ সুর তাল লয় আছে। সবাই সুন্দর ভাবে পুঁথিপাঠ করতে পারেন না। যারা পারেন তাদের পুঁথিপাঠ শোনার জন্য মানুষ রাত জেগে বসে থাকতো। পুঁথিপাঠের মধ্যে থাকতো অঙ্গভঙ্গি আর হাস্যরসাত্মক কথার সমাহার। গ্রামে দেখা যেতো সাধারণত বয়স্ক অভিজ্ঞ ব্যক্তি যিনি পুঁথিপাঠে বেশ অভিজ্ঞ এবং সে পুঁথির কাহিনি সম্পর্কে বেশ ধারণা রাখেন তিনিই পুঁথিপাঠ করতেন এবং তাঁর থেকে অন্যরা ধীরে ধীরে সে কৌশল রপ্ত করতেন। পুঁথিপাঠ সাধারণত সুর প্রধান একটা বিষয়। পুঁথির সুরটি একেবারে একটি আলাদা ধারা। তাকে নানা সুরে দোলায়িত করা যায়। কোন পর্বটা কোন গানের সুরে হবে সেটা দেখে বুঝে নেয়াই হচ্ছে পুঁথি পড়ার বুদ্ধিমত্তা। আবার একটা পর্বকে শুধু একটা সুরে নয়, ভিন্ন ভিন্ন সুরেও গাওয়া যায়। কে কোন সুরে গাইবেন, কোন সুরে গাইলে দর্শক আনন্দ পাবে সেটা পুঁথিপাঠকের ওপর নির্ভর করে। অনেক পুঁথিপাঠক পুঁথির কিছু অংশ পাঠ করে এর সারসংক্ষেপ উপস্থিত দর্শকদের কথার মাধ্যমে বুঝিয়ে দিতেও সচেষ্ট থাকতেন। পুঁথি পাঠের সাথে নানা বাদ্য যন্ত্রের ব্যবহারও হতো চমৎকারভাবে। গ্রামীণ পুঁথি পাঠের মধ্য দিয়ে গ্রাম বাংলার ইতিহাস, ঐতিহ্য, সামাজিকতা, শোষণ, নিপীড়ন কিংবা বঞ্চনার কথাগুলো উঠে আসতো। সে কথা মানুষের বিবেককে নাড়িয়ে দিতো। সমাজে এর ইতিবাচক প্রভাবও পড়তো। তবে সনাতনী ধর্মীয় সমাজে পুঁথি পড়ার সংস্কৃতি বেশ পুরানো। মনসা পুজোর সময় মনসা পুঁথিপাঠ ও দুর্গোপুজোর সময় জাগরণ পুঁথিপাঠ গ্রামীণ সমাজে একসময় অনিবার্য অনুষঙ্গ ছিলো। এই পুঁথিপাঠের বিষয়টি শুধুই ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতা নয়, এটি একই সঙ্গে সংস্কৃতির অংশও বলা যায়। হিন্দুশাস্ত্রে মনসার কাহিনি নিয়ে কালজয়ী সাহিত্য রচিত হয়েছে। বাসর রাতে বেহুলার স্বামী লক্ষ্মীন্দরকে সাপে কাটার অংশ নিয়ে মনসামঙ্গল বা মঙ্গলকাব্য যে জনপ্রিয় কাহিনি তাকে ঘিরে কত গান কবিতা মঞ্চ নাটক রচিত হয়েছে। তবে এগুলোর রচনার আগেও মনসা পুঁিথর প্রচলন ছিলো বলে জানা যায়। এই মনসামঙ্গল বা মঙ্গলকাব্য কিংবা প্রাচীন পদ্মপুরাণ পুঁথি বা প্যাঁচালির সুরে সুরে পড়া হতো। এই কাহিনি বর্তমান সময়ে প্রচলিত মনসা পুঁথিতেই চমৎকারভাবে বর্ণিত আছে। মনসা পূজা হয় শ্রাবণ মাসের শেষ দিনে। এই মনসা পূজার পরই হিন্দুদের নানা পূজা পার্বণ শুরু হয়। শ্রাবণ মাসের শুরু থেকেই মনসা পুঁথিপাঠের পর্ব শুরু হয় এবং শ্রাবণ মাসের শেষ দিন পর্যন্ত এই পাঠ করার বিধান আছে বলে ধরা হয়। এই মনসা পুঁথিপাঠ অঞ্চলভেদে তার পঠনরীতি আলাদা আলাদা হয়ে থাকে। পুঁথিপাঠের আসরের এ আয়োজন চলে আসছে কয়েক যুগ যুগ ধরে। সংসারের কাজকর্ম সেরে পুঁথিপাঠে অংশ নেন নারী ও পুরুষেরা। গ্রামের অনেক নারী আবার একাকী ঘরে বসে বা কয়েকজন মিলে শ্রাবণ মাসে পুঁথি পাঠ করে। পুরো শ্রাবণ মাস পুঁথিপাঠের মাধ্যমে তারা মনসার সেই কাহিনি সমাপ্ত করতে সচেষ্ট থাকে। তবে গ্রামাঞ্চলে একসময় বাড়িতে বাড়িতে প্রতি রাতে জমজমাট মনসা পুঁথি পাঠের আসর বসতো। নানা দূর দূরান্ত থেকে পুঁথি পাঠে অংশ নিতে লোক আসতো। নানান বাদ্য যন্ত্রের সংমিশ্রণে পুঁথিপাঠ হয়ে উঠতো বেশ উপভোগ্য। বাংলা গান আমাদের খুব প্রিয়। অনেক জনপ্রিয় গান আমাদের মুখে মুখে ফেরে। চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গানও আমাদের কাছে অনেক প্রিয়। আর পল্লীগীতি ভাটিয়ালিতো আছেই। এসব অনেক জনপ্রিয় গানের তালে মনসা পুঁথিপাঠে শ্রোতারা বিমুগ্ধ হন। এখানে যারা পুঁথিপাঠ করেন তাদের মুন্সীয়ানা থাকতে হয়। কোন পর্বে কোন সুরে পুঁথি পাঠ হবে কোন গানের সাথে মিলবে সে হিসাবে পুঁথি পাঠ করতে হয়। দীর্ঘদিনের চর্চার ফলে অনেকেই এ কৌশলটি ভালোভাবে রপ্ত করে ফেলেন। সেজন্য দেখা যায় গ্রামের অতি কম শিক্ষিত লোকও তাল মাত্রা লয় একটু আধটু বোঝেন এমন ব্যক্তি চমৎকার গানে পুঁথিপাঠকে প্রাণবন্ত করে তোলেন। পুঁথির লাইন গানের ছন্দে পড়েন এবং সে লাইন শেষ হলে গানের ছন্দে সবাই পুঁথিপাঠকের সাথে সমস্বরে গানটি ধরে বাজনার সাথে মেতে উঠেন। চট্টগ্রামের ভাষায় একে পুঁথির ‘ঘোষা’ দেয়া বলে। পুঁথির লাইনটি কোন সুরের সাথে ম্যাচিং হবে সেটা গুরুত্বপূর্ণ। একটি লাইনকে প্রচলিত অনেক গানের সাথে সুরে মেলানো যায়। যে যেটাতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন বা শ্রোতাকে আকৃষ্ট করতে পারবেন বলে মনে হয় সে গানের ‘ঘোষা’ দিয়ে পুঁথি পাঠ করেন। ব্যাপারটি বেশ কৌশলগত এবং বুদ্ধিমত্তার একটি কাজ। একজনের পর শুরু হয় আরেক জনের পুঁথিপাঠ করার পালা। এভাবে গানের ছন্দে ছন্দে রাত কেটে যায়। পুঁথিপাঠ আয়োজনকারী বাড়ির কর্তারা চা-নাস্তায় আপ্যায়ন করে থাকেন পুঁথিপাঠকারী ও শ্রবণকারীদের। এক অঞ্চলের পুঁথিপাঠকারীকে অন্য এলাকায় পুঁথিপাঠে আমন্ত্রণ জানানো হয়। গ্রামে একসময় সময় প্রতিরাতে আজকে এ-বাড়িতে কাল ও-বাড়িতে এমনি করে পুঁথিপাঠের আসর বসতো। এখন গ্রাম বাংলায় প্রযুক্তির এ উৎকর্ষতার যুগে সে উদ্দীপনা অনেকটাই ম্রিয়মান। আর সে সময়ের জাদরেল পুঁথিপাঠকদের অনেকেই এখন আর বেঁচে নেই। পরবর্তী প্রজন্মদের অনেকেই এগুলোর চর্চাকে তেমন গুরুত্ব দেন না। ফলে গ্রামে এখন পুঁথিপাঠের সেই জৌলুস আর নেই। তবে কোনো কোনো জায়গায় এখনো পুঁিথপাঠের আসর বসে। মানুষ আনন্দ পায়। ফিরে যায় সেই গ্রামের অতীত স্মৃতিতে। সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে এখন সেই পুঁথিপাঠের দৃশ্যের দেখাও মেলে। দুর্গাপূজার সময় জাগরণ পুঁথিপাঠ ছিলো দুর্গাপূজার অন্যতম আকর্ষণ। সপ্তাহব্যাপী দুর্গাপূজায় জাগরণ পুঁথিতে দুর্গাপূজার পুরো মাহাত্ম্য বর্ণনা থাকে পুঁথির ছত্রে ছত্রে। পুঁথির পাঠের ছন্দময় তালে তালে বাদ্য যন্ত্রের ঝংকারে দুর্গাপূজার হয়ে উঠতো আনন্দময়। এখনকার সময়ে দুর্গাপূজার সময় সেই জাগরণ পুঁথি পাঠের ঐতিহ্যও হারিয়ে যেতে বসেছে। এখন পূজার সময় সাউন্ড সিস্টেমের সাথে এক ধরনের উন্মাতাল নৃত্য পূজার প্রকৃত সাত্ত্বিক দিকটাই বিনষ্ট করছে। আধুনিকতার উন্মাতাল স্রোতে হারিয়ে যাচ্ছে দুর্গাপূজায় পুঁথিপাঠের ঐতিহ্য। তবুও কিছু গ্রাম বাংলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে দুর্গাপূজার সময় জাগরণ পুঁথিপাঠের ঐতিহ্য নজরে আসে। গ্রামবাংলার মানুষ একসময় একটি সময়কে বেছে নিত এই পুঁথিপাঠের জন্য। এই পুঁথিপাঠকে ঘিরেই গ্রামবাংলার জনগণের মধ্যে একটি মধুর সম্পর্কের সেতুবন্ধন রচিত হতো। পরষ্পরের খোঁজখবর নেওয়ারও একটি মাধ্যম ছিল পুঁথিপাঠের আসর। পারষ্পরিক খোঁজখবরের মাধ্যমে সামাজিক সমপ্রীতি আরও জোরদার হতো। গ্রামের তরুণ উঠতি বয়সের ছেলেমেয়েদের মধ্যে পুঁথিপাঠ নিয়ে এক ধরনের আকর্ষণ দেখা যেতো। এই পুঁথিপাঠ তাদের আনন্দ বিনোদনের ছিলো অন্যতম খোরাক। গ্রামীণ অনেক কিছুই হারিয়ে যাবার অতলে পুঁথিপাঠও একটি। এ প্রজন্মের অনেকেই আজ পুঁথিপাঠ সম্পর্কে ধারণাই রাখে না। প্রযুক্তি আর আকাশ সংস্কৃতির গড্ডালিকা প্রবাহে পুঁথিপাঠ আরো অনেক কিছু সাথেই হারিয়ে যাবার দলে। কিন্তু ঐতিহ্যকে রক্ষা করতে হলে আমাদের গ্রামীণ এসব ঐতিহ্যের শিকড়ে পৌঁছতে হবে। তা না হলে পুঁথিও একদিন গ্রামবাংলার প্রত্যন্ত অঞ্চলের এ জনপদ থেকে হয়তো জাদুঘরেই ঠাঁই নেবে।
লেখক: প্রাবন্ধিক, সহকারী অধ্যাপক, বিএমসি কলেজ।

পূর্ববর্তী নিবন্ধইতিহাস ও তথ্যের উৎস : দৈনিক আজাদী
পরবর্তী নিবন্ধচিটাগাং টু দ্য ফোর