ইতিহাস ও তথ্যের উৎস : দৈনিক আজাদী

ড. নাজনীন কাউসার চৌধুরী রুনা | সোমবার , ৫ সেপ্টেম্বর, ২০২২ at ৭:০৫ পূর্বাহ্ণ

দৈনিক আজাদী’র ৬২তম জন্মদিন, ৬৩ বছরে পদার্পণ- আগামী ০৫ সেপ্টেম্বর, ২০২২। দীর্ঘ ৬২ বছর ধরে বহুল প্রচারিত দৈনিক পত্রিকা হিসেবে সকল প্রজন্মের কাছে ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে আছে দৈনিক আজাদী। দৈনিক আজাদী’র পথচলা শুরু ১৯৬০ খ্রিষ্টাব্দে। স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পেছনে সকল আন্দোলন-সংগ্রামের অনেক ইতিহাসের সাক্ষী এ পত্রিকা। বাংলাদেশ স্বাধীন দেশ হিসেবে ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ তারিখে জন্মলাভের পরদিনই ১৭ ডিসেম্বর ১৯৭১ তারিখে সংবাদ নিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম দৈনিক পত্রিকা হিসেবে প্রকাশিত হয়। এ সংবাদপত্রের ১৯৬০ থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত অর্থাৎ ১১ বছরেরও বেশি সময় ধরে সদর্পে পথ চলা। এ পত্রিকার প্রায় সকল সংখ্যায় স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পেছনে সকল আন্দোলন-সংগ্রামের সকল তথ্য-উপাত্ত রয়েছে। শুধু তাই নয়, বাংলাদেশ স্বাধীন দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশের পর হতে এ পর্যন্ত পত্রিকাটিতে বিভিন্ন উৎস থেকে প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে বিশিষ্ট লেখক, গবেষক ও প্রাবন্ধিকদের লেখার মাধ্যমে বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পেছনে সকল আন্দোলন-সংগ্রামের ইতিহাস ধরে রাখার প্রয়াস, বিশিষ্ট ব্যক্তিদের স্মরণীয় করে রাখার, তাদের অবদান পরবর্তী প্রজন্মের কাছে ছড়িয়ে দেয়ার উদ্যোগ অব্যহত রয়েছে। তাই আমি মনে করি দৈনিক আজাদী মানেই হলো ইতিহাস ও তথ্যের উৎস।
সময়ের পরিক্রমায় দৈনিক আজাদী আমার পরিবারের অংশ হয়ে গেছে। দৈনিক আজাদীতে প্রকাশিত বিভিন্ন সংবাদসহ বিভিন্ন তথ্য পর্যালোচনায় দৈনিক আজাদীর কোনো না কোনো সংখ্যায় আমার আব্বা ভাষা সৈনিক, রাজনীতিবিদ, শিক্ষানুরাগী ও সমাজসেবক মরহুম বদিউল আলম চৌধুরীর নাম ও তাঁর বিভিন্ন অবদানের তথ্য-উপাত্ত খুঁজে পাই। দৈনিক আজাদী’র প্রকাশিত বিভিন্ন বিশেষ সংখ্যা এবং বিভিন্ন লেখক, প্রাবন্ধিক, মুক্তিযুদ্ধ গবেষক ও বিশিষ্টজনদের লেখায়, গবেষণায় ও উপসম্পাদকীয়তে ভাষা আন্দোলন, চুয়ান্নর নির্বাচন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান ও একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে আমার আব্বা বদিউল আলম চৌধুরীর সরাসরি অংশগ্রহণের অনেক তথ্য উঠে এসেছে। আজ এ লেখায় আমি দৈনিক আজাদী’তে কাভার করা আমার আব্বার ভাষা আন্দোলন, চুয়ান্নর নির্বাচন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান ও একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ সংক্রান্ত তথ্যগুলোই কেবল তুলে ধরছি। চট্টগ্রামে শিক্ষার প্রসার ও সমাজসেবায় আমার আব্বার যে অবদান দৈনিক আজাদী’তে বিভিন্ন সময় কাভার করা রয়েছে- তা পরবর্তী কোনো এক সংখ্যায় তুলে ধরার পরিকল্পনা রয়েছে। ভাষা আন্দোলন: চট্টগ্রামের বহুল প্রচারিত পত্রিকা- দৈনিক আজাদী’র ২১ ফেব্রুয়ারি, ২০২১ খ্রিস্টাব্দে ‘মায়ের ভাষা বাংলার জন্যে যারা জীবন বাজি রেখে সংগ্রাম করেছিলেন আমাদের প্রাণপ্রিয় চট্টগ্রাম থেকে, আমরা কি জানি তাঁদের? চট্টগ্রামের ভাষা সৈনিকদের পরিচিতি’ শিরোনামে প্রকাশিত একুশের বিশেষ সংখ্যায় ৩ (তিন) সারি’তে ৬(ছয়) কলামে চট্টগ্রামের ১৮(আঠার) জন ভাষাসৈনিকের পরিচিতি উপস্থাপন করে তাঁদের সম্মানিত করা হয়েছে। উক্ত ৬(ছয়) কলামের মধ্যে ১ম সারির ৩য় কলামে রয়েছেন- আমার আব্বা ভাষাসৈনিক বদিউল আলম চৌধুরী। উল্লেখ্য, একই সারির ১ম কলামে রয়েছেন- তমদ্দুন মজলিসের প্রতিষ্ঠাতা ও ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা-না উর্দু’ পুস্তকের অন্যতম লেখক ভাষাসৈনিক অধ্যাপক আবুল কাশেম। একই সারিতে ২য় কলামে রয়েছেন- ঐতিহাসিক কবিতা ‘কাঁদতে আসিনি, ফাঁসির দাবী নিয়ে এসেছি’ এর লেখক ভাষাসৈনিক কবি মাহবুব-উল আলম চৌধুরী। দৈনিক আজাদীর উক্ত বিশেষ সংখ্যায় ভাষা আন্দোলনে আব্বার অবদান নিয়ে বেশ কিছু বিষয় উল্লেখ করা হয়, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য- ‘ভাষা সৈনিক বদিউল আলম চৌধুরী ছিলেন বাংলা ভাষা আন্দোলনের চট্টগ্রামের প্রধান সংগঠন তমদ্দুন মজলিসের উঠতি ছাত্রনেতা। …ভাষা সৈনিক বদিউল আলম চৌধুরী পুলিশের চোখকে ফাঁকি দিয়ে গোপন মিশনে নেমেছিলেন। তাঁর এ গোপন মিশনের বাহন ছিল সাইকেল এবং তিনি এ ‘সাইকেল বাহিনী’র নেতা ছিলেন। চট্টগ্রাম কলেজে সে সময় যে শহীদ মিনার নির্মাণ করা হয় তার সাথে ভাষা সৈনিক বদিউল আলম চৌধুরী সরাসরি সম্পৃক্ত ছিলেন’। উল্লেখ্য, দৈনিক আজাদীর ১২ অক্টোবর ২০২০ তারিখে বিশিষ্ট কলামিস্ট ও মুক্তিযুদ্ধ গবেষক সাখাওয়াত হোসেন মজনু’র তাঁর নিয়মিত কলাম ‘সাম্প্রতিক চট্টগ্রাম ও দৈনন্দিন টুকিটাকি’ প্রবন্ধে ভাষা আন্দোলনে চট্টগ্রামের সাইকেল বাহিনীর ত্যাগ ও সাহসের কথা উল্লেখ করা হয়, যে সাইকেল বাহিনীর নেতা ছিলেন আমার আব্বা ভাষাসৈনিক বদিউল আলম চৌধুরী এবং এ কাজে গতিশীলতা আনয়নের জন্যে আব্বা তাঁর নিজের সাইকেল কেনার সময় এ কাজে তাঁর অন্যতম এক সহযোগীকেও সাইকেল কিনে দিয়েছিলেন। দৈনিক আজাদীর ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ তারিখের ‘ভাষা আন্দোলনে কাট্টলীর কীর্তিমান পুরুষ বদিউল আলম চৌধুরী’ শীর্ষক প্রবন্ধে ভাষা আন্দোলনে বদিউল আলম চৌধুরীর অবদানের বিষয়ে বিস্তারিত প্রকাশিত হয়েছে।
দৈনিক আজাদীর ১০ অক্টোবর ২০১৬ তারিখে প্রকাশিত বিশিষ্ট কলামিস্ট ও মুক্তিযুদ্ধ গবেষক সাখাওয়াত হোসেন মজনু’র তাঁর নিয়মিত কলাম ‘সাম্প্রতিক চট্টগ্রাম ও দৈনন্দিন টুকিটাকি’ প্রবন্ধে লিখেছেন- ‘……ভাষা সংগ্রামের একজন ত্যাগী কর্মী ছিলেন কাট্টলী নাজির বাড়ীর সন্তান বদিউল আলম চৌধুরী। সে সময় তিনি ছিলেন ছাত্র। বয়স তো খুব বেশি ছিলোনা। তবে রাজপথে ছিলেন কঠিন ব্রত নিয়ে’। দৈনিক আজাদীর ১১ অক্টোবর ২০১৬ তারিখের ‘ভাষা সৈনিক বদিউল আলম চৌধুরী ক্ষমতার মোহে রাজনীতি করেননি’ শিরোনামে প্রকাশিত সংবাদে আমার আব্বা সম্পর্কে বিশিষ্ট কলামিস্ট ও মুক্তিযুদ্ধ গবেষক মরহুম সাখাওয়াত হোসেন মজনু তাঁর এক বক্তব্যে বলেছিলেন- ‘……ভাষা আন্দোলনে বদিউল আলম চৌধুরী অসামান্য অবদান রেখেছেন। হুলিয়া মাথায় নিয়ে তিনি ভাষার দাবী আদায়ে অবিচল সংগ্রাম চালিয়েছেন’। উক্ত শিরোনামে পরিবেশিত সংবাদে একই তারিখে আমার আব্বা ভাষাসৈনিক বদিউল আলম চৌধুরীর অবদানের বিষয়ে আরো বলা হয়- ‘ভাষা, শিক্ষা ও সমাজ সেবায় ভাষাসৈনিক বদিউল আলম চৌধুরী যে অবদান রেখে গেছেন তা ইতিহাসে অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। তমুদ্দুন মজলিশের মাধ্যমে নেতৃত্বের সম্মুখভাগে থেকে তিনি ভাষা আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়ে ইতিহাসে একজন ক্ষণজন্মা কৃতিপুরুষ হিসেবে অমর হয়ে আছেন। সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাঁর অবদানের কারণে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে তার নাম স্বর্ণাক্ষরে লিপিবদ্ধ আছে। ……চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা আলহাজ্ব মোসলেম উদ্দিন আহমেদ (বর্তমানে মাননীয় সংসদ সদস্য, চট্টগ্রাম-৮) বলেন, বদিউল আলম চৌধুরী দল মত নির্বিশেষে সমাজের সকল শ্রেণি পেশার মানুষের শ্রদ্ধার পাত্র ছিলেন। নীতি আদর্শের ব্যাপারে তিনি আমৃত্যু অবিচল ছিলেন। ক্ষমতার মোহে তিনি কখনো রাজনীতি করেননি। ব্যক্তি জীবনে তিনি ছিলেন অসাম্প্রদায়িক’। উল্লেখ্য, দৈনিক আজাদীর ২২ জুলাই ২০১১ তারিখের উপসম্পাদকীয়- বিশিষ্ট লেখক ও মুক্তিযুদ্ধ গবেষক আহমদ মমতাজের ‘চাটগাঁর আজিজ’ প্রবন্ধের ২য় কলামের ১ম অনুচ্ছেদের ২০তম লাইনে আমার আব্বা ভাষাসৈনিক বদিউল আলম চৌধুরীর নাম রয়েছে। উল্লেখ্য, আলোচ্য প্রবন্ধে ১৯৪৭ এর নভেম্বরে গঠিত তমদ্দুন মজলিস, চট্টগ্রাম শাখার প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে যে ক’জন সম্পৃক্ত ছিলেন তাদের নামের তালিকা দেয়া হয়েছে।
চুয়ান্নর নির্বাচন: দৈনিক আজাদীর ১০ অক্টোবর ২০১৫ তারিখে বিশিষ্ট কবি, প্রাবন্ধিক, গবেষক ও রম্য লেখক মুহাম্মদ নিযামুদ্দিন এর ‘বদিউল আলম চৌধুরীঃ দেশ দরদের দৃষ্টান্ত’ প্রবন্ধে উঠে আসে- ‘……একজন রাজনীতিবিদ হিসেবেও বদিউল আলম চৌধুরীর নাম স্মরণীয় হয়ে থাকবে। ১৯৫৪ প্রর যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনে তিনি পাহাড়তলী, ডবলমুরিং, সীতাকুণ্ড এলাকায় তৎকালীন মুসলিম লীগ সরকারের বিরুদ্ধে যুক্তফ্রন্টের পক্ষে জোরালো বক্তব্য রেখেছিলেন। ……চুয়ান্নর নির্বাচনে বিপুল ভোটের ব্যবধানে বিজয়ী হয়েছিলেন যুক্তফ্রন্টের প্রার্থী মাহমুদুন্নবী চৌধুরী। তাঁর এ বিজয়ের পেছনে বদিউল আলম চৌধুরীর ছিল ব্যাপক অবদান’।
ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান: ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের সময়ে দৈনিক আজাদী’র অনেকগুলো সংখ্যার প্রকাশিত সংবাদে আমার আব্বা বদিউল আলম চৌধুরীর সরাসরি অংশগ্রহণের অনেক তথ্য রয়েছে। যার মধ্যে উল্লেখ্যযোগ্য: তমুদ্দুন মজলিসের রাজনৈতিক সংগঠন কেআরপি’র পুনর্গঠন, কেআরপি’র সাধারণ সম্পাদক হিসেবে আমার আব্বা বদিউল আলম চৌধুরীর দায়িত্ত্বগ্রহণ, সাধারণ সম্পাদক হিসেবে গণআন্দোলনের বিভিন্ন কর্মসূচী প্রদান ও গণমিছিলে অংশগ্রহণ, ১৯৬৯ প্রর গণঅভ্যুত্থানে ড. সামশুজ্জোহা নিহত হওয়ার পর কেআরপি’র সাধারণ সম্পাদক হিসেবে আমার আব্বা বদিউল আলম চৌধুরীর প্রতিবাদ, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহারের দাবি, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান’সহ সকল রাজবন্দীদের মুক্তির দাবি, সাধারণ নির্বাচনে পাকিস্তানের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট আয়ুবের প্রতিদ্বন্দ্বিতা না করার সিদ্ধান্তে তাঁর প্রতিক্রিয়া, মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে পাকিস্তানী শাসক গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে ১৯৬৯-৭০-এ আয়োজিত বিভিন্ন সম্মেলনে আমার আব্বা বদিউল আলম চৌধুরীর অংশগ্রহণ’সহ আরো অনেক বিষয়।
মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে তমুদ্দুন মজলিসের রাজনৈতিক সংগঠন কেআরপি’র পুনর্গঠন এবং ১৯৬৯ প্রর গণঅভ্যুত্থান চলাকালে আমার আব্বা বদিউল আলম চৌধুরীর পার্টির সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ত্ব পালনের খবর প্রকাশিত হয় দৈনিক আজাদী’র ০৭ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯ তারিখে। কেআরপি’র পুনর্গঠনের পর ঐ সময়ে আমার আব্বা বদিউল আলম চৌধুরী গণআন্দোলনের বিভিন্ন কর্মসূচী প্রদান করেন এবং বিভিন্ন সম্মেলন/ অধিবেশন এর আয়োজন করেন। উক্ত সম্মেলন/ অধিবেশনে গণআন্দোলনের বিভিন্ন প্রস্তাব গৃহীত হয়, যা প্রকাশিত হয় দৈনিক আজাদীর ১৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯ তারিখের সংখ্যায়। আমার আব্বা বদিউল আলম চৌধুরী কর্তৃক গণআন্দোলনের বিভিন্ন কর্মসূচী প্রদান এবং সম্মেলন/ অধিবেশন আয়োজনের পাশাপাশি গণমিছিলেও অংশগ্রহণ করেন। গণমিছিলের খবরটি সে সময়ে বহুল প্রচারিত স্থানীয় দৈনিকসমূহে গুরুত্বের সাথে প্রকাশিত হয়। যার মধ্যে উল্লেখ্যযোগ্য দৈনিক আজাদী। দৈনিক আজাদী’র ১৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯ তারিখে ‘দেশব্যাপী হরতাল দিবসে চট্টগ্রামে মিছিল আর মিছিলঃ মুক্তিপাগল মানুষের কাফেলার বন্দরনগরীর আকাশ বাতাস প্রকম্পিত’ শিরোনামে প্রকাশিত খবরে আমার আব্বা বদিউল আলম চৌধুরীর গণমিছিলে অংশগ্রহণের কথা উল্লেখ করা হয়েছে- ‘…..এক গণমিছিল শহর প্রদক্ষিণ করে।………জনাব বদিউল আলম চৌধুরী প্রমুখ বিভিন্ন রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের নেতৃবৃন্দ উপরোক্ত গণমিছিলে অংশগ্রহণ করেন……’।
১৯৬৯ প্রর গণঅভ্যুত্থানে ড. সামশুজ্জোহা নিহত হওয়ার পর কেআরপি’র সাধারণ সম্পাদক হিসেবে আমার আব্বা বদিউল আলম চৌধুরীর প্রতিবাদ, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ সকল রাজবন্দীদের মুক্তির দাবিতে তাঁর বিবৃতি, পাকিস্তানের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট আয়ুব খানের বেতার ভাষণের ওপর তাঁর প্রতিক্রিয়া, মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে পাকিস্তানী শাসক গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে ১৯৬৯-৭০-এ আয়োজিত বিভিন্ন সম্মেলনে তাঁর অংশগ্রহণ তৎকালীন সকল জাতীয় ও স্থানীয় দৈনিকে বহুলভাবে প্রকাশিত ও প্রচারিত হয়। যার মধ্যে উল্লেখ্যযোগ্যঃ দৈনিক আজাদী। দৈনিক আজাদী’র ২০ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯ তারিখে ‘লালদিঘি ময়দানে গায়েবানা জানাজাঃ ড. সামসুজ্জোহার মৃত্যুতে অদ্য প্রতিবাদ দিবস পালিত হইবে’ শিরোনামে প্রকাশিত খবরে আমার আব্বা বদিউল আলম চৌধুরীর বিবৃতি রয়েছে- ‘সামরিক বাহিনীর গুলিতে অধ্যাপকের হত্যার তীব্র নিন্দা করিয়া কেআরপি’র সাধারণ সম্পাদক বদিউল আলম চৌধুরী বিবৃতি প্রদান করেন। তিনি বলেন, সরকার একদিকে গোলটেবিল বৈঠকের কথা বলিতেছেন এবং অপরদিকে ১৪৪ ধারা ও সান্ধ্য আইন জারী করিয়া পুলিশ ও সেনাবাহিনী নামাইয়া গণহত্যা চালাইয়া বিভীষিকা সৃষ্টি করিতেছেন। দমননীতির মাধ্যমে সুস্থ পরিবেশ সৃষ্টি হইতে পারেনা। তিনি আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহারের, শেখ মুজিবসহ সকল রাজবন্দীদের মুক্তির, গ্রেপ্তারী পরোয়ানা ও হুলিয়া প্রত্যাহারের দাবী জানান’। দৈনিক আজাদী’র ২৩ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯ তারিখে ‘আগামী সাধারণ নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট আয়ুবের প্রতিদ্বন্দ্বিতা না করার সিদ্ধান্তে দেশব্যাপী প্রতিক্রিয়া’ শিরোনামে প্রকাশিত খবরেও আমার আব্বা বদিউল আলম চৌধুরীর বিবৃতি পাওয়া যায়- ‘কেআরপি’র চট্টগ্রাম জিলা শাখার সাধারণ সম্পাদক জনাব বদিউল আলম চৌধুরী এক বিবৃতিতে বলেন যে, সংগ্রামী জনতার আন্দোলনের ফলে প্রেসিডেন্ট আয়ুব আগামী নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করিবেন না বলিয়া ঘোষণা করিতে বাধ্য হওয়ায় জাতি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলিয়াছে’।
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ: দৈনিক আজাদীর ১০ অক্টোবর ২০১৫ তারিখে বিশিষ্ট কবি, প্রাবন্ধিক, গবেষক ও রম্য লেখক মুহাম্মদ নিযামুদ্দিন এর ‘বদিউল আলম চৌধুরীঃ দেশ দরদের দৃষ্টান্ত’ প্রবন্ধ পর্যালোচনায় জানা যায়-‘মহান মুক্তিযুদ্ধ যখন শুরু হয়, মনেপ্রাণে বদিউল আলম চৌধুরী মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থন করেন এবং মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয়-প্রশ্রয় ও সাহায্য সহযোগিতা প্রদান করেন’। মুহাম্মদ নিযামুদ্দিন একই প্রবন্ধে বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক ডা. মাহফুজুর রহমান এর ‘বাঙালির জাতীয়তাবাদী সংগ্রাম মুক্তিযুদ্ধে চট্টগ্রাম (১৯৯৩)’ গ্রন্থটি পর্যালোচনা করে তাঁর ঐ প্রবন্ধে উল্লেখ করেন- ‘……এ দলের এক অংশ হারুনর রশীদ খান, বদিউল আলম চৌধুরী, আজিজুর রহমান চৌধুরী প্রমুখের নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে’। তিনি একই প্রবন্ধে আমার আব্বা বদিউল আলম চৌধুরী সম্পর্কে আরো উল্লেখ করেন- ‘মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্ন অপারেশনের পরিকল্পনা ও নকশা প্রণয়নে বদিউল আলম চৌধুরী ইঞ্জিনিয়ার আজিজুর রহমানের নেতৃত্বে তাদের সহযোগিতা করেন। শুধু তাই নয়, বদিউল আলম চৌধুরী মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয়দানসহ তাদেরকে খাবার সরবরাহ করেন তাঁর স্ত্রীর সহযোগিতায়। মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতা প্রদানের অপরাধে আলবদর বাহিনী একাত্তরের ১৪ ও ১৫ ডিসেম্বর বদিউল আলম চৌধুরীকে ধরে নেয়ার জন্যে কয়েকবার চেষ্টা চালায় ও ব্যর্থ হয়’।
বিশিষ্টজনের আমার আব্বা বদিউল আলম চৌধুরীর মূল্যায়ন: দৈনিক আজাদীর ১১ অক্টোবর ২০১৪ তারিখের ‘ভাষা সৈনিক বদিউল আলম চৌধুরীকে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি প্রদানের দাবী’ শিরোনামে প্রকাশিত সংবাদে আমার আব্বার সম্পর্কে বলা হয়েছে ‘……বদিউল আলম চৌধুরী এমনই সৌভাগ্যবান ছিলেন যে একাধারে সব কয়টি আন্দোলন-সংগ্রামে সক্রিয় অংশগ্রহণের সুযোগ পেয়েছিলেন’। দৈনিক আজাদীর ১০ অক্টোবর ২০১৬ তারিখে বিশিষ্ট কলামিস্ট ও মুক্তিযুদ্ধ গবেষক সাখাওয়াত হোসেন মজনু তাঁর নিয়মিত কলাম ‘সাম্প্রতিক চট্টগ্রাম ও দৈনন্দিন টুকিটাকি’তে আমার আব্বা বদিউল আলম চৌধুরী সম্পর্কে উল্লেখ করেন-‘……সেই ভাষা সংগ্রামী মানুষটি রাজনীতি করেছেন, মানুষের সেবা করেছেন, মানবকল্যাণে নিবেদিত ছিলেন, শিক্ষানুরাগী মানুষ ছিলেন। তাঁর ভাল কাজের মধ্যে তিনি ছিলেন মহান মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগী, আশ্রয়দাতা, দলীয় রাজনীতির মোহে তিনি আপ্লুত ছিলেন না, ছিলেন স্পষ্টবাদী, সত্যের পথে নিবেদিত, মিথ্যে অহংবোধ তাঁর ছিলোনা, ফলে তিনি দলীয় রাজনীতির অন্ধ অনুসারী হতে পারেননি। তবে এটা ঠিক যে, এরশাদ সরকার তাঁকে মন্ত্রী বানানোর চেষ্টা করেছিলো………। বুদ্ধিমত্তা ও কৌশলে নিজের গণতান্ত্রিক বিবেক রক্ষা করেছিলেন’। দৈনিক আজাদীর ১১ অক্টোবর ২০১৬ তারিখে ‘ভাষা সৈনিক বদিউল আলম চৌধুরী ক্ষমতার মোহে রাজনীতি করেননি’ শিরোনামে প্রকাশিত সংবাদে চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা (বর্তমানে মাননীয় সংসদ সদস্য, চট্টগ্রাম-৮) আলহাজ্ব মোসলেমউদ্দিন আহমেদ চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবে আমার আব্বা বদিউল আলম চৌধুরী সম্পর্কে বলেন- ‘বদিউল আলম চৌধুরী ছিলেন রাজনীতির একজন অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত। রাজনীতির প্রতি সাধারণ মানুষদের মধ্যে যে বিরাগ কাজ করছে তা দূর হয়ে যাবে যদি তাঁর মত মানুষদের পাদপ্রদীপের আলোয় নিয়ে আসা হয়। ……বদিউল আলম চৌধুরী দলমত নির্বিশেষে সমাজে সকল শ্রেণি পেশার মানুষের শ্রদ্ধার পাত্র ছিলেন। নীতি আদর্শের ব্যাপারে তিনি আমৃত্যু অবিচল ছিলেন। ক্ষমতার মোহে তিনি রাজনীতি করেননি। ব্যক্তি জীবনে তিনি ছিলেন অসাম্প্রদায়িক। ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণ ও নীতি-আদর্শে অটল ছিলেন বলেই সব দল-মতের মানুষ আজ এক মঞ্চে এসে তাঁকে স্মরণ করছি’।
আমার আব্বা পরিবার, সমাজ ও দেশের জন্যে নিঃস্বার্থভাবে কাজ করে গেছেন। আমার আব্বা আমাদের সাথে বসে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পেছনে সকল আন্দোলন-সংগ্রামের বিভিন্ন ইতিহাস আলোচনা করতেন এবং তথ্যবহুল ইতিহাস জানার জন্যে আমার আব্বার সংগ্রহে থাকা দৈনিক আজাদী’র সকল পুরোনো সংখ্যাগুলো পড়তে উৎসাহিত করতেন (সেই সাথে প্রতিদিনের সংখ্যাগুলো তো পড়তে হতোই)। সেগুলো পড়তে গিয়ে অনেক ইতিহাস এবং অনেকের সম্পর্কে জানার সুযোগ পেয়েছি। সেই সাথে জেনেছি স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পেছনে ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে সকল আন্দোলন-সংগ্রামে আমার আব্বারও সরাসরি সম্পৃক্ত থাকার ইতিহাস। পাশাপাশি, দৈনিক আজাদী’র বিভিন্ন বিশেষ সংখ্যা এবং অনেকগুলো সংখ্যায় বিভিন্ন লেখক, প্রাবন্ধিক, মুক্তিযুদ্ধ গবেষক ও বিশিষ্টজনদের লেখায়, গবেষণায় ও উপসম্পাদকীয়তে সকল আন্দোলন-সংগ্রামে আব্বার সরাসরি সম্পৃক্ত থাকার অনেক অজানা ইতিহাস জানার সৌভাগ্য হয়েছে।
সবচেয়ে বড় কথা আমার আব্বা আমাদের মাঝে জ্ঞানচর্চার অংশ হিসেবে বিভিন্ন ধরণের বই পড়ার পাশাপাশি দৈনিক আজাদী’সহ সকল পত্রিকার তথ্যবহুল বিভিন্ন প্রবন্ধ, সম্পাদকীয় ও উপসম্পাদকীয়গুলো পড়ার অভ্যাস গড়ে তুলেছিলেন। অন্যদিকে, প্রতিদিন দৈনিক আজাদী পড়তে দেরী হলে মনে হয় চট্টগ্রাম থেকে বিচ্ছিন্ন থাকার পাশাপাশি দেশ থেকেও যেন বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছি। বর্তমান প্রজন্মের বেশিরভাগই পড়তে চায়না, তাই অনেক ক্ষেত্রে সঠিক ইতিহাসও জানেনা। অনেক সময় শোনা কথায় বিভ্রান্ত হয়ে গুণিজনদের মূল্যায়ন করতে জানেনা। প্রত্যাশা থাকবে নতুন প্রজন্ম পড়ার অভ্যাস গড়ে তুলবে, সঠিকভাবে জ্ঞানচর্চা করবে। আর এ জ্ঞানচর্চার অংশ হিসেবে দৈনিক আজাদীর তথ্যবহুল বিভিন্ন প্রবন্ধ, সম্পাদকীয় ও উপসম্পাদকীয়গুলো পড়ার চেষ্টা করবে।
দৈনিক আজাদীর আজাদীর ৬২তম জন্মবার্ষিকী এবং ৬৩’তে পদার্পণ উপলক্ষে আমার ও আমার পরিবারের পক্ষ থেকে আন্তরিক শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানাচ্ছি। দৈনিক আজাদী সমাজের ও দেশের কল্যাণে কাজ করে যাক, বিশিষ্ট ব্যক্তিদের বিশেষ করে চট্টগ্রামের বিশিষ্টজনদের বর্তমান ও পরবর্তী প্রজন্মের কাছে তুলে ধরার প্রয়াস অব্যহত রাখুক- এ প্রত্যাশা।

লেখক: সরকারের যুগ্মসচিব, অর্থনীতিবিদ, গবেষক ও কলামিস্ট

পূর্ববর্তী নিবন্ধজামায়াত বিএনপির অশুভ চক্রান্ত রুখতে হবে
পরবর্তী নিবন্ধগ্রামবাংলার পুঁথিপাঠ