গ্যাসহীন চট্টগ্রাম। শিল্প কারখানা থেকে রান্নাঘর সর্বত্র গ্যাস সরবরাহ বন্ধ হয়ে গেছে। আগে কুমিল্লার বাখরাবাদ, ফেনী বা সিলেট অঞ্চলের গ্যাসক্ষেত্র থেকে চট্টগ্রামে গ্যাস আসার সিস্টেম ছিল। সেই সিস্টেম এখন পুরোপুরি বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। এলএনজি আমদানির পর থেকে সিস্টেমটি এমনভাবে গড়ে তোলা হয়েছে, চট্টগ্রাম থেকে শুধু গ্যাস যাবে, কোনো গ্যাস আসবে না।
শুক্রবার রাতে এলএনজি সরবরাহ বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর থেকে চট্টগ্রামে গ্যাস আসা বন্ধ হয়ে যায়। পাইপ লাইনে যা গ্যাস ছিল তা দিয়ে কোনো কোনো এলাকায় টুকটাক কিছু কাজকর্ম হলেও এক পর্যায়ে চট্টগ্রামের পাইপে গ্যাস শেষ হয়ে যায়। বন্ধ হয়ে যায় শিল্প কারখানা, সিএনজি রি–ফুয়েলিং স্টেশন, রান্নাঘরের চুলা। বন্ধ হয়ে যায় গ্যাসনির্ভর সবক’টি বিদ্যুৎ কেন্দ্র। গ্যাসের জন্য ঘরে ঘরে শুরু হয় হাহাকার, রান্না বন্ধ হয়ে যায়। হোটেলেও খাবারের জন্য ছিল দীর্ঘ লাইন। অনেক হোটেলে খাবারের সংকট দেখা দেয়। বেকারিতে বিস্কুট–পাউরুটি জুটছে না। গার্মেন্টসসহ বিভিন্ন কারখানায় গ্যাসের অভাবে উৎপাদন মুখ থুবড়ে পড়ে। গ্যাস জুটছে না সিএনজি টেক্সিসহ যানবাহনে। এতে করে সিএনজি টেক্সি চলাচল প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। যানবাহনের সংখ্যাও নেমে আসে অর্ধেকে। পরিবহন ভাড়া অস্বাভাবিক হারে বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে। কেরোসিনের দাম বেড়ে গেছে। বেড়ে গেছে স্টোভ, ইন্ডাকশন চুলার দাম। রাইস কুকার খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না বাজারে। শুধুমাত্র গ্যাসের অভাবে চট্টগ্রামে ঘরে–বাইরে মানুষের দুর্ভোগ চরমে পৌঁছে। চট্টগ্রামে রেশনিং করে হলেও দ্রুত গ্যাস সরবরাহ শুরু করার জন্য দাবি জানানো হয়েছে।
জানা যায়, চট্টগ্রামে গ্যাসের সংকট অনেক দিনের। সাংগুর গ্যাস উত্তোলন বন্ধ হওয়ার পর থেকে এই সংকট প্রকট হয়ে ওঠে। সাংগু উৎপাদনে আসার আগেও চট্টগ্রামে গ্যাসের সংকট প্রকট ছিল। আশির দশকের শেষ দিকে চট্টগ্রামে গ্যাস সরবরাহ শুরু হয়। আশুগঞ্জ–বাখরাবাদ পাইপ লাইনের মাধ্যমে সিলেট, কুমিল্লা ও ফেনী অঞ্চলের গ্যাসক্ষেত্র থেকে দৈনিক ২৩০ মিলিয়ন ঘনফুট পর্যন্ত গ্যাস চট্টগ্রামে সরবরাহ দেয়া হতো। পরে চট্টগ্রামে গ্যাস সরবরাহ আরো কমে যায়। বাখরাবাদ কিংবা সিলেট অঞ্চলের গ্যাস কমিয়ে দেয়ায় এখানে হাহাকার শুরু হয়।
চট্টগ্রামে গ্যাসের আকালের মাঝে শুরু হয় এলএনজি আমদানির প্রক্রিয়া। বিদেশ থেকে আমদানিকৃত এলএনজি মহেশখালীতে ভাসমান টার্মিনালে খালাস করে আনোয়ারা পর্যন্ত ৯২ কিলোমিটার পাইপ লাইনে এনে ন্যাশনাল গ্রিডে দেয়ার সিস্টেম করা হয়। এই সিস্টেমে ন্যাশনাল গ্রিডের আশুগঞ্জ–বাখরাবাদ গ্যাস সরবরাহ লাইন ব্যবহার করা হয়। মহেশখালীতে দৈনিক ৫০০ মিলিয়ন ঘনফুট থেকে ৭০০ মিলিয়ন ঘনফুট এলএনজি খালাস করে ন্যাশনাল গ্রিডে সরবরাহ দেয়ার ব্যবস্থা করা হয়।
এর মধ্যে চট্টগ্রামের প্রয়োজনীয় আড়াইশ থেকে তিনশ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহের ব্যবস্থা রেখে বাকি গ্যাস ন্যাশনাল গ্রিডে নেয়ার সিস্টেম করা হয়। এই সিস্টেম করতে গিয়ে আশুগঞ্জ বাখরাবাদ গ্যাস পাইপ লাইনে আগে যেখানে কুমিল্লা অঞ্চল থেকে চট্টগ্রামে গ্যাস আসত সেই সিস্টেমটি পুরোপুরি বন্ধ করে দেয়া হয়। পাইপ লাইনে এমনভাবে বাল্ব স্থাপন করা হয়েছে যাতে করে শুধুমাত্র চট্টগ্রামের দিক থেকে গ্যাস যাবে, কোনো গ্যাস আসবে না। এর ফলে এলএনজি সরবরাহ বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর চট্টগ্রামে আর কোনো গ্যাস সরবরাহ দেয়া হচ্ছে না। ন্যাশনাল গ্রিড থেকেও চট্টগ্রামে কোনো গ্যাস আসছে না। এই অবস্থায় চট্টগ্রামজুড়ে গ্যাসের হাহাকার শুরু হয়েছে।
কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির (কেজিডিসিএল) একাধিক কর্মকর্তা গতকাল আজাদীকে বলেছেন, ন্যাশনাল গ্রিড থেকে কোনো গ্যাস আসছে না। আমরা কিছু গ্যাস দেয়ার জন্য বলেছি। যদি গ্যাস পাওয়া যায় তাহলে আবাসিক খাতে সরবরাহ দেয়ার ব্যবস্থা করা হবে। তবে এজন্য কিছুটা সময় লাগবে। পাইপ লাইনের বাল্ব পরিবর্তন করে সিস্টেম ঠিক করতে হবে।
কেজিডিসিএলের কর্মকর্তারা বলেন, চট্টগ্রামের গ্যাস সেক্টর পুরোপুরি আমদানিকৃত এলএনজি–নির্ভর। আমদানিকৃত এলএনজি বঙ্গোপসাগরের মহেশখালীর অদূরে দুটি ভাসমান টার্মিনালে খালাস করা হয়। ওখান থেকে পাইপ লাইনের মাধ্যমে চট্টগ্রামের আনোয়ারা পর্যন্ত এনে জাতীয় গ্রিডের মূল সরবরাহ লাইনে প্রদান করা হয়। সুপার সাইক্লোন হওয়ার শঙ্কা দেখা দেয়ায় ঘূর্ণিঝড় মোখার কারণে ভাসমান টার্মিনাল দুটিকে শুক্রবার রাত ১১টা নাগাদ নির্ধারিত স্থান থেকে সরিয়ে গভীর সমুদ্রে পাঠিয়ে দেয়া হয়। এতে চট্টগ্রামে গ্যাস আসা পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গভীর সমুদ্র থেকে ওই দুটি ভাসমান টার্মিনাল মহেশখালীতে এনে যথাস্থানে স্থাপন করে গ্যাস খালাস শুরু করা হলেই কেবল চট্টগ্রামে গ্যাসের সরবরাহ শুরু হবে। তবে এজন্য কিছুটা সময় লাগবে। পাইপ লাইন ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার কথা উল্লেখ করে সূত্র বলেছে, একটি টার্মিনাল আগামী দুই–তিন দিনের মধ্যে স্থাপন করা সম্ভব হলেও অপরটি স্থাপন করতে আট–দশ দিন লাগতে পারে। তবে আগামী দুই–তিন দিনের মধ্যে সীমিত পরিসরে হলেও চট্টগ্রামে গ্যাস সরবরাহ শুরু করার চেষ্টা চলছে বলে কেজিডিসিএলের কর্মকর্তারা বলেছেন।
গ্যাস সরবরাহ পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় চট্টগ্রামে নাগরিক জীবনে অবর্ণনীয় দুর্ভোগ নেমে আসে। ঘরে ঘরে শুরু হয় হাহাকার। খাবারের জন্য হোটেল–রেস্তোরাঁয় ভিড় লেগে যায়। কিন্তু কোথাও খাবার জুটছে, কোথাও জুটছে না। বেকারিতে পাউরুটি–বিস্কুটও পাওয়া যায়নি গতকাল। বেশিরভাগ মানুষ টেনশনে দিন কাটিয়েছেন।
এলপি গ্যাসের দোকানে দীর্ঘ লাইন লেগে গেছে। বাড়তি দামেও এলপি গ্যাসের সিলিন্ডার পাওয়া যাচ্ছে না। বাজারে স্টোভ নেই, নেই ইনডাকশন চুলা কিংবা রাইস কুকার। চড়া দাম দেয়ার পর গোপন স্থান থেকে বের করে দেয়া হচ্ছে। ১০৯ টাকার কেরোসিন বিক্রি হয়েছে ১৫০ টাকায়। সিএনজি স্টেশন বন্ধ হওয়ায় যানবাহনে গ্যাস নেই। গ্যাস–নির্ভর বাস ও সিএনজি চলাচল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় নাগরিক বিড়ম্বনা অসহনীয় পর্যায়ে গিয়ে ঠেকে। এক–দেড় কিলোমিটার জায়গার ভাড়া চাওয়া হয় দেড়শ–দুইশ টাকা।
চট্টগ্রামের গ্যাস–নির্ভর শিল্প কারখানাগুলো পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেছে। গার্মেন্টস থেকে শুরু করে বড় বড় সব কারখানার উৎপাদন মুখ থুবড়ে পড়েছে। কোটি কোটি টাকার উৎপাদন ক্ষতির কবলে পড়ছে চট্টগ্রামের শিল্পখাত। চট্টগ্রামের ব্যবসায়ী–শিল্পপতিদের মাঝে দেখা দিয়েছে উৎকণ্ঠা। রাউজান তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র, শিকলবাহা তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রসহ গ্যাস–নির্ভর সবগুলো বিদ্যুৎ কেন্দ্র বন্ধ হয়ে গেছে। এতে বিদ্যুৎ উৎপাদনেও ধস নেমেছে। চলছে ঘণ্টার পর ঘণ্টা লোডশেডিং।
ভুক্তভোগীরা বলছেন, গ্যাসের অভাবে চট্টগ্রামে মানুষের দুর্ভোগ অতীতের সব রেকর্ড ভঙ্গ করেছে। যদি ন্যাশনাল গ্রিড থেকে ২০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসও চট্টগ্রামে দেয়া হতো তাহলে বাণিজ্যিক রাজধানীতে বসবাসকারী ৬০ লক্ষ মানুষের শেষ রক্ষা হতো।
বিজিএমইএর প্রথম সহসভাপতি মোহাম্মদ নজরুল ইসলাম গতকাল এক বিবৃতিতে চট্টগ্রামে গ্যাস সরবরাহ পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তিনি এই সিস্টেমের প্রতিবাদ করে বলেছেন, ঘূর্ণিঝড় মোখার প্রভাবে এলএনজি সরবরাহ বন্ধ হয়েছে। এটি হতে পারে। এই নিয়ে আমাদের কোনো বক্তব্য নেই। কিন্তু ন্যাশনাল গ্রিড থেকে চট্টগ্রামে একটুও গ্যাস আসবে না, এটি হতে পারে না। রেশনিং করে হলেও চট্টগ্রামে কিছু গ্যাস সরবরাহ করার জন্য তিনি সংশ্লিষ্টদের প্রতি আহ্বান জানান।