গুঁড়ো করা হচ্ছে বছরে ৫৫ লাখ টন চাল

মোটা চাল ছেঁটে সরু ।। চাহিদার বেশি উৎপাদিত হলেও করতে হচ্ছে আমদানি ।। সংঘবদ্ধ ব্যবসায়ী চক্রের কারসাজি

আজাদী প্রতিবেদন | শুক্রবার , ৩০ সেপ্টেম্বর, ২০২২ at ৬:৩৫ পূর্বাহ্ণ

চাল ব্যবসার আড়ালে গড়ে উঠা সংঘবদ্ধ একটি চক্র বছরে অন্তত ৫৫ লাখ টন চাল হাওয়া করে দিচ্ছে। বিভিন্ন ধরনের মোটা চাল ছেঁটে সরু চাল হিসেবে বাজারজাত করতে গিয়ে অর্ধ কোটি টনেরও বেশি চাল গুঁড়ো করে ফেলা হচ্ছে। যা বিভিন্ন বেকারি আইটেমে ব্যবহৃত হলেও দেশের চালের চাহিদায় ঘাটতি তৈরি হচ্ছে। দেশে চাহিদার চেয়ে বেশি চাল উৎপাদিত হলেও শুধুমাত্র সংঘবদ্ধ চক্রটির কারসাজিতে প্রতিবছরই চাল আমদানি করতে হচ্ছে।
সূত্র জানায়, দেশে বর্তমানে বছরে গড়ে ৩ কোটি ৭০ লাখ টনের মতো চালের চাহিদা রয়েছে। দেশের কৃষিখাতে এই বিপুল পরিমাণ চাল উৎপাদিত হয়। দেশের কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের উৎপাদিত উন্নতজাতের ধান চাষের ফলে কৃষি উৎপাদন বেড়েছে। কিন্তু বাড়তি উৎপাদনের পরও প্রতিবছর বৈদেশিক মুদ্রা খরচ করে প্রচুর চাল আমদানি করতে হচ্ছে। গতবছরও বিপুল পরিমাণ চাল আমদানি করতে হয়। অথচ দেশে যে পরিমাণ চাল উৎপাদিত হচ্ছে তাতে চাল আমদানির কোনো প্রয়োজনই পড়েনা।
কৃষি অধিদপ্তরসহ সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর একাধিক কর্মকর্তা দৈনিক আজাদীকে জানান, দেশে কৃষি উৎপাদন অত্যন্ত সন্তোষজনক। প্রচুর ধান উৎপাদিত হয় আমাদের। কিন্তু উৎপাদিত ধান থেকে চাল করতে গিয়ে সংঘবদ্ধ চক্রটির কারসাজি শুরু হয়। এই চক্রটি মোটা চাল সরু করতে গিয়ে চালের শরীরের ৩০ শতাংশ পর্যন্ত ছেঁটে ফেলে। এতে চালের ওজন কমে যায়। যা দেশে খাদ্য পরিস্থিতিতে মারাত্মক রকমের নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।
কৃষি অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা জানান, দেশে মূলত তিন ধরনের ধান উৎপাদিত হয়। আউশ, আমন ও বোরো নামের ধান। এর মধ্যে অর্ধেকেরও বেশি হলো বোরো জাতের ধান। যেগুলো বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের উদ্ভাবিত ব্রি প্রজাতির ধান। এই প্রজাতির অধিকাংশ ধানই কিছুটা মোটা। কিন্তু এসব ধানের চাল সরাসরি বাজারে আসেনা। এগুলোকে বিভিন্ন রাইস মিলে কেটে ছেঁটে একেবারে সরু করে মিনিকেট, নাজিরশাইল কিংবা নাইজার শাইলসহ নানা বাহারি নামে বাজারজাত করা হয়। অথচ মিনিকেট, নাইজার শাইল কিংবা নাজিরশাইল নামের কোন ধানই দেশে নেই। অপরদিকে বাসমতি চালের প্রচুর জনপ্রিয়তা এদেশে। অথচ যে ধান থেকে এই চাল করা হয় সেটির নাম হচ্ছে বাংলা মতি। দেশের কৃষি বিজ্ঞানীদের উৎপাদিত ব্রি-৫০ জাতের ধানের নামই বাংলা মতি। দেশের ব্রি প্রজাতির বিভিন্ন ধানের চাল ছেঁটে বাংলা মতির চালের আদল দিয়ে বিক্রি করা হচ্ছে বাসমতি নামে। অথচ দেশে বাসমতি নামেও কোন ধান নেই। আবার ব্রি-৪৯ নামের ধানের চাল ছেঁটে তৈরি করা হয় পাইজাম আদলের চাল। এগুলো নাজির, পাইজাম ও ৪৯ চাল নামেও বাজারে বিক্রি করা হয়। দেশে প্রচুর হাইব্রিড ধান উৎপাদিত হয়। ফলনও ভালো। অথচ বাজারে হাইব্রিড চাল হিসেবে কোন চালই বিক্রি হয় না।
বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইন্সটিটিউটের একজন কর্মকর্তা দৈনিক আজাদীকে বলেন, আজব এক কারবার শুরু হয়েছে। আমাদের উদ্ভাবিত ব্রি-২৮, ব্রি-২৯, ব্রি-৪৯, ব্রি-৫০সহ ব্রি প্রজাতির ধানগুলোকে বিভিন্ন মিলে কাটাকুটি করে, মিঙ এবং ওভারপলিশ করে চটকদার সব নামে চড়া দামে ক্রেতাদের কাছে বিক্রি করা হচ্ছে। তিনি মোটা চালগুলোর শরীর থেকে গড়ে ৩০ শতাংশের বেশি কেটে ছেঁটে নেয়া হয়। যাতে চালগুলো একেবার সরু হয়ে উঠে। এর উপর পলিশ করে এমন একটি আদল দেয়া হয় যাতে অতি সাধারণ মানের চালগুলোও চটকদার হয়ে উঠে।
মিল মালিকদের মাঝে গড়ে উঠা সংঘবদ্ধ একটি চক্র প্রতি বছরই লাখ লাখ টন চাল ছেঁটে বাজারজাত করছে। কৃষি গবেষণাসহ বিভিন্ন সরকারি সংস্থার হিসেবে এই কাটাকুটির ফলে বছরে অন্তত ৫৫ লাখ টন চাল গুড়ো হয়ে যাচ্ছে। এই কাটাকুটিতে ওজন কমে গেলেও মিল মালিকদের কোন সমস্যা হচ্ছে না। তাদের কোন লোকসান যায় না। তারা ছেঁটে নেয়া চালের গুড়ো করে বাজারজাত করে। যা চালের গুড়ো এবং ময়দার সাথে মিশিয়ে বাজারজাত করা হয়। এসব গুড়ো মানুষের বাসাবাড়ির পাশাপাশি বিভিন্ন বেকারিতে ব্যবহৃত হচ্ছে। মিল মালিকদের লোকসান না হলেও দেশের সাধারণ মানুষ প্রতারিত হচ্ছেন। ক্রেতারা সস্তা দামের মোটা চাল কিনছেন চড়া দামে। চটকদার নামের বস্তাভর্তি এসব চাল মানুষ উন্নতমানের চিকন এবং সরু চাল হিসেবে কিনে নিয়ে যান। রান্না বা খাওয়ার আগে এসব চালের গোঁজামিল ধরা পড়ে না। যখন ধরা পড়ে তখন আর কারো কিছু করার থাকে না।
চট্টগ্রামের একাধিক চাল ব্যবসায়ী গতকাল বলেছেন, চালগুলো কাটাকুটি করা হয় উত্তরবঙ্গের মিলগুলোতে। চট্টগ্রামে উল্লেখ করার মতো কোন মিল নেই। উত্তরবঙ্গের চাল এখানে এনে বিক্রি করা হয়। মূলতঃ মিল মালিকেরাই কোটি কোটি টাকা দামের চাল কাটাকুটি করে বাজারজাতের সাথে জড়িত। মিলগুলোকে যথাযথভাবে নিয়ন্ত্রণ করা ছাড়া সংঘবদ্ধ চক্রটিকে দমানো অসম্ভব বলে উল্লেখ করে তারা বলেন, এই চক্রটি শুধু দেশের সাধারণ মানুষকেই নয়, সরকারকেও বেকায়দায় ফেলছে।
কৃষি অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলেছেন, বছরে ৫৫ লাখ টন চাল গুড়ো করে ফেলার ভয়াবহ অবস্থা থেকে দেশকে রক্ষা করতে দেশের স্বার্থেই জরুরিভিত্তিতে পদক্ষেপ নিতে হবে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধমৌলবাদের বিরুদ্ধে শেখ হাসিনাই একমাত্র ভরসা : ইন্ডিয়া টুডে
পরবর্তী নিবন্ধটেকনাফ বন্দর থেকে দুই মাস পর ছাড় পেল মিয়ানমারের নৌকা