খালের মাঝখানেই বহুতল ভবন নির্মাণ কাজ

বর্ষায় চকরিয়ার তিন ইউনিয়ন পানিতে তলিয়ে যাওয়ার শঙ্কা

চকরিয়া প্রতিনিধি | সোমবার , ১৮ এপ্রিল, ২০২২ at ৪:৪৩ পূর্বাহ্ণ

কক্সবাজারের চকরিয়ার পূর্ব বড় ভেওলা ইউনিয়নের বেতুয়ার খাল বা ছড়া খালটি সরাসরি মাতামুহুরী নদীর সাথে সংযোগ স্থাপন করেছে। গুগল ম্যাপ অনুযায়ী এই খালের দৈর্ঘ্য প্রায় ১০ কিলোমিটার এবং প্রস্থ কোনো কোনো এলাকায় ৩০ ফুট থেকে ৬০ ফুট পর্যন্ত। প্রতিবছর বর্ষা মৌসুমে বৃষ্টি ও উজান থেকে নেমে আসা বানের পানি এই ছড়া খাল দিয়ে ভাটির দিকে নেমে মাতামুহুরী নদীতে গিয়ে পড়ে। এতে বিএমচর, পূর্ব বড় ভেওলা ও পশ্চিম বড় ভেওলাসহ আশপাশের কয়েকটি ইউনিয়নের মানুষ বন্যামুক্ত থাকে।
সরজমিন দেখা গেছে, মাতামুহুরী নদীর প্রবহমান শাখা এই বেতুয়ার খালটির দুই দিকের তীরও দখল করে ফেলা হয়েছে বিভিন্ন স্থানে। এবার খালের মাঝখানেই মাটি ফেলে একেবারে পুরোপুরি দখলে নিয়ে সেখানে নির্মাণ করা হচ্ছে বহুতল ভবন। পূর্ব বড় ভেওলা ইউনিয়নের চার নম্বর ওয়ার্ডের বানিয়ারচর অংশে পরিবেশ বিধ্বংসী এই ভয়াবহ অপতৎপরতা চললেও প্রশাসনের কোনো ধরনের নজরদারিও নেই। এতে বানিয়ারচর অংশে এই খালের ওপর গত তিনমাস ধরে চলছে বহুতল ভবন নির্মাণের কাজ।
খালের মাঝখানে বহুতল ভবন নির্মাণের খবর পেয়ে সরজমিন গেলে কথা হয় স্থানীয় একাধিক ব্যক্তির সঙ্গে। এ সময় তারা খালটিকে দখল করে সেখানে বহুতল ভবন নির্মাণ করায় চলতি বর্ষা মৌসুমে ব্যাপক এলাকা পানির নিচে তলিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করেন। এতে তিন ইউনিয়নের মানুষের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় বেশ কয়েকজন বাসিন্দা দৈনিক আজাদীকে বলেন, তাদের বাপ-দাদার আমল থেকেই এই বেতুয়ার খাল দিয়ে নৌকা যোগে চলাচল করেছেন। এটি সরাসরি মাতামুহুরী নদীর সাথে সংযোগ স্থাপন করেছে। কিন্তু বর্তমানে এই খালটিকে গিলে খাচ্ছে প্রভাবশালীরা। দিন দিন দুই তীর দখল করে ফেলায় খালের প্রশস্ততাও কমে এসেছে বানিয়ারচর এলাকায়।
তারা আরো বলেন, এতদিন দুই তীর দখল করে স্থাপনা নির্মাণ করা হলেও এবার সরাসরি খালের মাঝখানে মাটি ফেলে পানি চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে এবং নির্মাণ করা হচ্ছে বহুতল ভবন। এতে চলতি বর্ষা মৌসুমে অতি বৃষ্টি ও উজান থেকে নেমে আসা বানের পানি ভাটির দিকে আর নামতে পারবে না। এই অবস্থায় ডুবে যাবে তিন ইউনিয়ন বিএমচর, পূর্ব বড় ভেওলা ও পশ্চিম বড় ভেওলার চরপাড়া, দিয়ারচর, ফজু মিয়াজির চর, বানিয়ারচর, পশ্চিম সিকদার পাড়া, বেতুয়ার কূলসহ অন্তত ২০টি গ্রামের বসতবাড়ি ও ফসলি জমি।
শুধু ছড়াখালের জায়গা নয়, স্থানীয় নুরুল আলম ছিদ্দিকীর ব্যক্তি মালিনাকাধীন জায়গাও জোরপূর্বক দখলে নেওয়া হয়েছে বলে তিনি দাবি করেছেন। তিনি অভিযোগ করে বলেন, ‘মাদরাসায় ধর্মীয় শিক্ষা দেওয়া হয়। এ জন্য সবার সহানুভূতি থাকে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের প্রতি। কিন্তু যখন মাদরাসার ভবন নির্মাণের নাম ভাঙিয়ে রাতের আঁধারে এঙেভেটর দিয়ে প্রবহমান ছড়াখালের পানির প্রবাহ বন্ধ করে দেওয়া হয়, মানুষের জায়গা জোরপূর্বক দখলে নিয়ে রাতারাতি সেখানে ভবন নির্মাণের কাজ শুরু হয়, সেটি সন্ত্রাসী কায়দা।’
ভুক্তভোগী নুরুল আলম ছিদ্দিকী বলেন, ‘শুধুমাত্র কয়েকজন ব্যক্তির অসৎ উদ্দেশ্য হাসিলের জন্যই জোরপূর্বক ছড়া খাল এবং ব্যক্তি মালিকানাধীন জায়গা দখল করে সেখানে বহুতল ভবন নির্মাণ করছেন। এই ভবন নির্মাণের কারণে চলতি বর্ষা মৌসুমে ভয়াবহ বন্যা দেখা দেবে বিএমচর, পূর্ব বড় ভেওলা ও পশ্চিম বড় ভেওলায়। কারণ মাতামুহুরী নদীর সঙ্গে সংযুক্ত খালটি দিয়ে আর পারি সরতে পারবে না। আমি এই বিষয়ে কোন প্রতিকার পাবো না বলেই প্রশাসনের কাছে লিখিতভাবে অভিযোগ করতেও সাহস করিনি।’
বেতুয়ার খাল দখল করে কারা এই বহুতল ভবন নির্মাণ করছে – এমন প্রশ্নে স্থানীয় নুরুল ইসলাম মোল্যা ও সাইফুল ইসলাম দৈনিক আজাদীকে বলেন, ‘ছড়া খাল দখলে নিয়ে কেউ এই ভবন নির্মাণ করছেন না। এই ভবনটি করা হচ্ছে ব্যক্তি মালিকানাধীন জায়গায়। আর এই ভবনটি বানিয়ারচর হামিউচ্ছুন্নাহ্‌ মাদরাসারই। অতএব যারা ওই জায়গাকে প্রবহমান খাল বলছে তা সঠিক নয়।’ উপরোক্ত দুইজনই মাদরাসার দাতা সদস্য হিসেবে রয়েছেন জানিয়ে বলেন, ‘মাদরাসার এই ভবন নির্মাণে স্থানীয়ভাবে তহবিল সংগ্রহের পাশাপাশি দুবাই ভিত্তিক একজন দাতার অর্থায়নে এই ভবন নির্মাণকাজ চলছে তিনমাস ধরে। ভবন নির্মাণস্থলের পাশ দিয়ে ছড়া খালটি প্রবাহিত রয়েছে। যদি খালের কিছু অংশ এই ভবনের ভেতর গিয়ে পড়ে তাহলে পরবর্তীতে অন্যস্থানে ছড়া খাল কেটে পানি চলাচলের পথ সুগম করে দেওয়া হবে। যাতে বর্ষায় এখানকার মানুষ বন্যামুক্ত থাকতে পারে।’
ভবন নির্মাণের আগে সরকারি কোনো দপ্তর থেকে অনুমতি নেওয়া হয়েছে কী-না এমন প্রশ্নে তারা বলেন, ‘মাদরাসার ভবন নির্মাণ করতে হলে কোনো অনুমোদন নিতে হয় না। তাছাড়া এটি মাত্র দোতলা ভবন নির্মাণ হবে।’
বক্তব্য নেওয়ার জন্য যোগাযোগ করা হয় বানিয়ারচর হামিউচ্ছুন্নাহ্‌ মাদরাসার মোহতামিম মাওলানা ক্বারী নুরুচ্ছুলতানের সঙ্গে। এ সময় তিনি দাবি করেন, ‘কোনো প্রবহমান ছড়াখালের ওপর মাদরাসার ভবন নির্মাণ করা হচ্ছে না। ব্যক্তি মালিকানাধীন জায়গাতেই ভবন নির্মাণের কাজ চলছে। ভবন নির্মাণে অর্থায়ন প্রসঙ্গে মোহতামিম নুরুচ্ছুলতান বলেন, ‘বিদেশী কোনো অর্থ সহায়তায় এই ভবন নির্মাণ করা হচ্ছে না। শুধুমাত্র স্থানীয়দের কাছ থেকে পাওয়া অর্থ সহায়তায় ভবন নির্মাণের কাজ চলছে।’ তবে ভবন নির্মাণের বিপরীতে সরকারি কোনো দপ্তর বা ইউনিয়ন পরিষদ থেকে অনুমোদন নেওয়া হয়েছে কী-না এমন প্রশ্নে তা এড়িয়ে গিয়ে এ সময় দাতা সদস্য সাইফুলকে ফোন ধরিয়ে দেন মোহতামিম।
স্থানীয়দের দাবি, খাল দখলে নিয়ে একেবারে মাঝখানে বহুতল ভবন নির্মাণের বিষয়টি অবগত আছেন পূর্ব বড় ভেওলা ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান ফারহানা আফরিন মুন্না। তিনি কয়েকবার সেই ভবন নির্মাণকাজও পরিদর্শন করেছেন। তবে এই বিষয়ে জানার জন্য অসংখ্যবার যোগাযোগ করা হলেও বক্তব্য পাওয়া যায়নি তাঁর।
পূর্ব বড় ভেওলা ইউনিয়ন ভূমি সহকারী কর্মকর্তা (তহসিলদার) মো. আবুল মনসুর জানান, আরএস ও বিএস রেকর্ড অনুযায়ী মাতামুহুরী নদীর শাখা বেতুয়ার খালের দৈর্ঘ্য প্রায় ১০ কিলোমিটার এবং প্রস্থ কোনো কোনো এলাকায় সর্বনিম্ন ৩০ ফুট থেকে সর্বোচ্চ ৬০ ফুট পর্যন্ত। এই খালটি বিএমচর, পূর্ব বড় ভেওলা ও পশ্চিম বড় ভেওলার ওপর দিয়ে প্রবাহিত।
এ ব্যাপারে চকরিয়া উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) মো. রাহাত উজ-জামান দৈনিক আজাদীকে বলেন, ‘প্রবহমান খালের মাঝখানে অবৈধভাবে বহুতল ভবন নির্মাণ ভয়াবহ অপরাধ। এই ভবন নির্মাণের সঙ্গে যারাই জড়িত থাকুক তাদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার পাশাপাশি অবৈধ ভবন অপসারণের ব্যাপারেও যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে। ইতোমধ্যে ইউনিয়ন ভূমি কর্মকর্তাকেও নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে সবিস্তারে জানাতে।’

পূর্ববর্তী নিবন্ধমীরসরাইয়ে বাসচাপায় যুবলীগ নেতার মৃত্যু
পরবর্তী নিবন্ধভাটিয়ারিতে সিমনি শিপ ইয়ার্ডে ৫৪ লাখ টাকার স্ক্র্যাপ চুরি