ক্লাস নাইনে রেজিস্ট্রেশনে জালিয়াতি!

আজাদী প্রতিবেদন | শনিবার , ১৩ নভেম্বর, ২০২১ at ৬:৩৬ পূর্বাহ্ণ

দুই বছর আগে (২০১৯ সালে) ক্লাস নাইনে রেজিস্ট্রেশন। স্বাভাবিক ভাবেই এবারের (২০২১ সালের) এসএসসি পরীক্ষার্থী তারা। পরীক্ষায় অংশ নিতে ফরম পূরণও সম্পন্ন করেছে এসব শিক্ষার্থী। কেবল প্রবেশ পত্র হাতে পাওয়া বাকি। তবে বাধ সাধে করোনা পরিস্থিতিতে এবারের ভিন্ন নিয়ম। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত অনুসারে এবারের এসএসসিতে কেবল তিন বিষয়ে পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। বাকি বিষয়গুলোর মূল্যায়ন হবে সাবজেক্ট ম্যাপিং ও জেএসসির ফলাফলের ভিত্তিতে। যার কারণে ফরম পূরণ সম্পন্ন করা শিক্ষার্থীদের জেএসসির ফল যাচাই প্রক্রিয়ায় যেতে হয়েছে শিক্ষাবোর্ডকে। এতেই ধরা পড়ল জেএসসি পাস না করেও এসএসসির ফরম পূরণের চাঞ্চল্যকর তথ্য। অর্থাৎ ২০১৭ ও ২০১৮ সালে জেএসসি অকৃতকার্য অন্তত ৩৫ জন শিক্ষার্থীর ক্লাস নাইনে রেজিস্ট্রেশন সমপন্ন হয়েছে। যারা এবারের এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নিতে ফরম পূরণও সম্পন্ন করেছে। যদিও শিক্ষাবোর্ডের রেজিস্ট্রেশন প্রক্রিয়ায় জেএসসি ফেল করা কোনো শিক্ষার্থীর ক্লাস নাইনে রেজিস্ট্রেশনের সুযোগ নেই। শিক্ষাবোর্ডের বিদ্যালয় শাখার তত্ত্বাবধানে শিক্ষার্থীদের এ রেজিস্ট্রেশন প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়ে থাকে। রেজিস্ট্রেশন প্রক্রিয়ার সাথে সম্পৃত্ত শিক্ষাবোর্ড ও স্কুল সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, ক্লাস নাইনে রেজিস্ট্রেশন প্রক্রিয়ায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে ওয়েবসাইটে শিক্ষার্থীদের ডাটা ইনপুট দেয়া হয়। এক্ষেত্রে ফিল্টারিং সিস্টেমের কারণে জেএসসি অনুত্তীর্ণ কোনো শিক্ষার্থীর ডাটা সফটওয়্যার গ্রহণ করে না। যার ফলে জালিয়াতি ছাড়া জেএসসি ফেল করা এসব শিক্ষার্থীর ক্লাস নাইনে রেজিস্ট্রেশন সম্পন্নের সুযোগ নেই। আর এই জালিয়াতির নেপথ্যে স্কুল শিক্ষক ও বোর্ড কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ বড় ধরনের চক্র জড়িত বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, জেএসসি ফেল করেও ক্লাস নাইনে রেজিস্ট্রেশন করা ও এবারের এসএসসির ফরম পূরণ করা শিক্ষার্থীর সংখ্যা অর্ধশতের কম নয়। তবে এ ধরণের শিক্ষার্থীর প্রকৃত সংখ্যা নিয়ে এক ধরনের লুকোচুরি চলছে শিক্ষাবোর্ডে। এ সংখ্যা ৩৫-৩৬ জনের মতো বলে দাবি করেছেন বোর্ডের কর্মকর্তারা। বিষয়টি তদন্তে তিন সদস্যের কমিটি গঠন করেছে শিক্ষাবোর্ড কর্তৃপক্ষ। বোর্ডের কলেজ পরিদর্শক প্রফেসর জাহেদুল হক এ কমিটির আহ্বায়ক। আর উপ বিদ্যালয় পরিদর্শক মো. আবুল বাশার ও উপ-পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক (মাধ্যমিক) নারায়ণ নাথকে এ কমিটির সদস্য করা হয়েছে। বোর্ডের সচিব প্রফেসর আব্দুল আলীমের স্বাক্ষরে গত ১০ অক্টোবর এ কমিটি গঠন করা হয়। এছাড়া সংশ্লিষ্ট শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রধানদের কাছে ব্যাখ্যা তলব করা হয়েছে। তদন্ত কমিটি গঠন ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রধানদের কাছে ব্যাখ্যা তলবের তথ্য নিশ্চিত করে বোর্ডের বিদ্যালয় পরিদর্শক ড. বিপ্লব গাঙ্গুলী আজাদীকে বলেন, জেএসসি ফেল করেও ক্লাস নাইনে রেজিস্ট্রেশন ও এসএসসির ফরম পূরণ করেছে এরকম ৩৫-৩৬ জন শিক্ষার্থী আমরা চিহ্নিত করতে পেরেছি। জেএসসি ফেল করা এসব শিক্ষার্থীর এসএসসির প্রবেশপত্র আটকে রাখা হয়েছে। মোটকথা তারা এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নেয়ার সুযোগ পাচ্ছে না। এটি আমাদের জন্য স্বস্তির খবর। তবে এসব শিক্ষার্থীর মধ্যে কয়েকজন জেএসসি উত্তীর্ণ রয়েছে। আমরা তাদের প্রবেশপত্র ইস্যু করে দিয়েছি।
জেএসসি ফেল করা এসব শিক্ষার্থীর ক্লাস নাইনের রেজিস্ট্রেশন হওয়ার পিছনে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের দায় দেখছেন বিদ্যালয় পরিদর্শক ড. বিপ্লব গাঙ্গুলী। এছাড়া সফটওয়্যারের প্রযুক্তিগত দুর্বলতাও থাকতে পারে বলে আশঙ্কা করেন তিনি।
বিদ্যালয় পরিদর্শক বলেন, জেএসসি অকৃতকার্য কোনো শিক্ষার্থীর ডাটা ইনপুট না দিতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে বলে দেয়া হয়। যেসব প্রতিষ্ঠানে এরকম শিক্ষার্থী পাওয়া গেছে, সেসব প্রতিষ্ঠানের কাছে আমরা ব্যাখ্যা তলব করেছি। প্রতিষ্ঠানগুলো জবাব দিচ্ছে। আর ঘটনা তদন্তে কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটি কাজ করছে।
জানতে চাইলে তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক প্রফেসর জাহেদুল হক বলেন, জেএসসি উত্তীর্ণ না হলেও কিভাবে এসব শিক্ষার্থীর ক্লাস নাইনের রেজিস্ট্রেশন হয়েছে, বিষয়টি আমরা খতিয়ে দেখছি। দ্রুত সময়ের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়ার চেষ্টা চলছে বলেও জানান তিনি।
এ ঘটনায় শিক্ষাবোর্ডের শোকজ পাওয়া এক প্রধান শিক্ষক দাবি করেছেন- কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে ভুল করে জেএসসি অকৃতকার্য কোনো শিক্ষার্থীর ডাটা ইনপুট দেয়া হলেও সফটওয়্যার সেটি গ্রহণ করে না। ওয়েবসাইটে ওভাবেই সিস্টেম করা। সে হিসেবে এসব রেজিস্ট্রেশন হয়তো ম্যানুয়ালি হয়েছে, নয়তো সফটওয়্যার-সিস্টেমের সাথে সম্পৃত্ত কারো মাধ্যমে হয়েছে। মোটকথা এ ঘটনায় বড় ধরণের জালিয়াত চক্র জড়িত থাকতে পারে। ভালোভাবে তদন্ত করলে সেটি বের হয়ে আসবে। কিন্তু সর্ষের মধ্যে ভূত থাকলে প্রকৃত ঘটনা আড়ালে থেকে যাবে। অতীতেও শিক্ষাবোর্ডে বড় বড় জালিয়াতির ঘটনা ঘটেছে। ওসব ঘটনায় বোর্ডের কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ বড় ধরনের চক্র জড়িত বলে খবর বেরিয়েছে।
শিক্ষাবোর্ডের ওয়েবসাইট পরিচালনার দায়িত্বে রয়েছে কর্পোট্রনিক ইনফো সিস্টেম লিমিটেড নামের একটি প্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠানটির প্রধান নির্বাহী ইমরুল ইসলামের দাবি- রেজিস্ট্রেশন প্রক্রিয়ায় ডাটা কি দিচ্ছে না দিচ্ছে সবই স্কুলের এখতিয়ার। এক্ষেত্রে স্কুলের অবশ্যই দায় আছে। তবে আমাদের সিস্টেমে ফিল্টারিং সুবিধা যুক্ত করা রয়েছে। ফলে জেএসসি অকৃতকার্য কোনো শিক্ষার্থীর ডাটা ইনপুট দেয়া হলেও ফিল্টারিংয়ে সেটি আটকে দেবে। তাই এই সিস্টেমে এসব রেজিস্ট্রেশন হওয়ার সুযোগ আছে বলে আমরা মনে করছি না। নির্ধারিত সময়ের পর ম্যানুয়ালি অনেক রেজিস্ট্রেশন হয়। এই ম্যানুয়াল প্রক্রিয়ায় এ ধরণের ঘটনা ঘটতে পারে বলে ধারণা ইমরুল ইসলামের।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ম্যানুয়ালি একজন শিক্ষার্থীরও রেজিস্ট্রেশন হয়নি বলে দাবি করেছেন বোর্ডের বিদ্যালয় পরিদর্শক ড. বিপ্লব গাঙ্গুলী। এটি কিভাবে হল ঠিক বুঝে উঠতে পারছেন না মন্তব্য করে বিপ্লব গাঙ্গুলী বলেন, ওয়েবসাইট হ্যাকিংয়ের মাধ্যমে হয়েছে কী না, তাও বুঝতে পারছি না। হ্যাক হলে তো সংখ্যাটা আরো বেশি হতো। তদন্ত কমিটি প্রকৃত ঘটনা খুঁজে বের করবে বলে আশা বোর্ডের এ কর্মকর্তার।

পূর্ববর্তী নিবন্ধস্বর্ণের দাম বেড়েছে ভরিতে ২,৩৩৩ টাকা
পরবর্তী নিবন্ধমীরসরাইয়ে গলায় ফাঁস দিয়ে গৃহবধূর আত্মহত্যা