কাল আজকাল

কামরুল হাসান বাদল | বৃহস্পতিবার , ৭ মার্চ, ২০২৪ at ৮:১০ পূর্বাহ্ণ

শুধুই অনিয়ম, অসঙ্গতি ও অব্যবস্থাপনা

আরেকটি ঘটনা (পড়ুন দুর্ঘটনা) না ঘটা পর্যন্ত আমাদের আলোচনা চলবে আগুন, আগুন লাগার কারণ, আগুন লাগার ঝুঁকি এবং এক্ষেত্রে চলমান অনিয়ম, অসঙ্গতি ও অব্যবস্থাপনা নিয়ে। তারপর আমাদের অপরিকল্পিত নগরায়ণ, অবৈধভাবে ভবন নির্মাণ, অনুমতি ব্যতিরেকে হোটেলরেস্তোরাঁ গড়ে তোলা, এসব অনিয়মের সঙ্গে জড়িতদের বিচার দাবি এবং দায়িত্বশীলদের অবহেলা নিয়ে। কয়েকদিন পত্রিকায় বিভিন্ন রিপোর্ট, সুপারিশ ও মতামত প্রকাশিত হবে। টিভিতে টকশো হবে। কন্টেন্ট ক্রিয়েটররা তৎপর থাকবে। তারপর আরেকটি ঘটনা বা প্রসঙ্গ এসে এটাকে চাপা দিয়ে দেবে।

ঢাকার বেইলি রোডে গ্রিন কোজি কটেজ নামের একটি আটতলা ভবনে অগ্নিকাণ্ডে ৪৬ জনের মৃত্যু হয় গত বৃহস্পতিবার। ভবনটিতে আটটি রেস্তোরাঁ ছিল। সরকারি ছুটির আগের দিনের সন্ধ্যায় সেখানে খেতে গিয়েছিলেন প্রচুর মানুষ। আগুন লাগলে তাদের অনেকে মারা যান। পরে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) জানায়, ভবনটিতে রেস্তোরাঁ করার অনুমতি ছিল না। অন্যদিকে ফায়ার সার্ভিস জানায়, ভবনটি যে অগ্নিনিরাপত্তার ঝুঁকিতে ছিল, তা তিন দফা চিঠি দিয়ে জানানো হয়েছিল। তবে ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।

এটি আমাদের চিরাচরিত অব্যবস্থাপনার করুণ চিত্র। বাস দুর্ঘটনার পর জানতে পারি, বাসের ফিটনেস সার্টিফিকেট ছিল না, চালকের লাইসেন্স ছিল না, হেলপার গাড়ি চালাচ্ছিল। লঞ্চডুবির পর জানতে পারি লঞ্চের ফিটনেস সার্টিফিকেট ছিল না, লঞ্চে সুকানি ছিল না, বাতি ছিল না, যাত্রীদের জন্য নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা ছিল না। বিল্ডিং দেবে গেলে জানতে পারি কর্তৃপক্ষের অনুমোদন ছিল না। আগুন লাগলে জানতে পারি হোটেলের অনুমোদন ছিল না। দাহ্য পদার্থ বা কেমিক্যালের গোডাউন করার অনুমতি ছিল না। আর এমন দুর্ঘটনার পরপর যেভাবে আলাপআলোচনা ও সুপারিশের বন্যা বয়ে যায় তার দশ শতাংশও কার্যকর হয় না।

যেমন, বেইলি রোডের অগ্নিকাণ্ডের পর সংশ্লিষ্ট সরকারি সংস্থাগুলো সমালোচনার মুখে পড়ে। জাতীয় সংসদেও বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়। ভবনমালিকদের দায়মুক্তি দেওয়ার অভিযোগ করেন সাবেক গৃহায়ণ ও গণপূর্তমন্ত্রী এবং বর্তমানে সরকারি দলের সংসদ সদস্য শ ম রেজাউল করিম। এই পটভূমিতে অভিযানে নেমেছে রাজউক, সিটি করপোরেশন ও পুলিশ। এখন অধিক তৎপর হয়ে অভিযান চালাচ্ছে যে যার মতো। অন্যদিকে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মানুষের জীবন বাঁচাতে, অগ্নিঝুঁকি দূর করতে, নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে অভিযান চালাতেই হবে। তবে তা হতে সমন্বিত, স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার ভিত্তিতে। এতে আরও বেশি সুফল পাওয়া যাবে।

রাজধানীর ২ হাজার ৬০৩টি ভবন অগ্নিঝুঁকিতে রয়েছে। ফায়ার সার্ভিসের হালনাগাদ তথ্য বলছে, এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ১ হাজার ১০৬টি বিপণিকেন্দ্র। তালিকায় আরও রয়েছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল, আবাসিক ভবন ও গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানের ভবন। চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ বা সিডিএর তালিকা অনুযায়ী, চট্টগ্রাম নগরে ৬ থেকে ১০ তলা পর্যন্ত ভবন রয়েছে ১৩ হাজার ১৩৫টি। ১০ তলার ওপরে ভবন রয়েছে ৫২৭টি। এসবের মধ্যে কী পরিমাণ ভবন অগ্নিঝুঁকিতে রয়েছে, তার কোনো পূর্ণাঙ্গ তালিকা কোনো সংস্থার কাছেই নেই। গত বছর ঢাকার বঙ্গবাজারে অগ্নিকাণ্ডের পর চট্টগ্রামের মার্কেটগুলো নিয়ে জরিপ কার্যক্রম শুরু করেছিল ফায়ার সার্ভিস। ওই সময় জানানো হয়েছিল, শুধু রেয়াজউদ্দিন বাজারেই ছোটবড় প্রায় ২০০ মার্কেট অগ্নিঝুঁকিতে রয়েছে। তালিকা করা হলেও পরবর্তীতে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে বলে জানা যায়নি।

ফায়ার সার্ভিসের চট্টগ্রাম অঞ্চলের সহকারী পরিচালক মো. আবদুল মালেক একটি পত্রিকাকে বলেন, চট্টগ্রাম নগরে কী পরিমাণ স্থাপনা অগ্নিঝুঁকিতে আছে, তা চিহ্নিত করার কাজ চলমান রয়েছে। যেভাবে আবাসিক ও বাণিজ্যিক ভবনগুলোতে রেস্তোরাঁ বা খাবারের দোকান খোলা হয়েছে, তাতে অগ্নিকাণ্ডের ঝুঁকি বহুগুণ বেশি। এই ব্যাপারে পদক্ষেপ নেওয়া হবে।

অধিকাংশ বহুতল ভবন অগ্নিনিরাপত্তা পরিকল্পনা (ফায়ার সেফটি প্ল্যান) মেনে চলে না বলে স্বীকার করেন সিডিএর প্রধান নগরপরিকল্পনাবিদ কাজী হাসান বিন শামস। তিনি পত্রিকাকে বলেন, ঢাকার বেইলি রোডে বড় দুর্ঘটনা ঘটেছে। এই ঘটনা থেকে শিক্ষা নিতে হবে। চট্টগ্রামের যেসব স্থাপনায় জমায়েত বেশি হয়, সেগুলো নকশা অনুযায়ী নির্মিত হয়েছে কি না তদন্ত করা হবে। নকশাবহির্ভূতভাবে ভবন নির্মাণ করলে এবং অগ্নিনিরাপত্তার ব্যবস্থা না থাকলে নকশা বাতিলসহ কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

সিডিএর প্রধান নগরবিদই বলছেন, ভবনগুলো নকশা অনুযায়ী হয়েছে কিনা তা তদন্ত করা হবে। লক্ষ্য করুন, তিনি পত্রিকাকে বলেন, ‘ঢাকার বেইলি রোডে বড় দুর্ঘটনা ঘটেছে। এই ঘটনা থেকে শিক্ষা নিতে হবে।তারমানে বেইলি রোডে দুর্ঘটনা না ঘটলে ওনারা শিক্ষা নিতেন না! তদন্তও করতেন না! অথচ নকশা অনুযায়ী ভবন নির্মিত হয়েছে কি না, তা দেখার দায়িত্ব চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের। সে সঙ্গে অগ্নিনিরাপত্তায় কী ধরনের পদক্ষেপ নিতে হবে, তা স্পষ্ট করে বলা হয়েছে চট্টগ্রাম মহানগর ইমারত (নির্মাণ, উন্নয়ন, সংরক্ষণ ও অপসারণ) বিধিমালা, ২০০৮এ। ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, নকশা অনুমোদন দিয়েই দায় সারে সংস্থাটি। নকশা অনুযায়ী ভবন হয়েছে কি না, তা যাচাইয়ের কাজটি ঠিকমতো করে না তারা।

অন্যদিকে ছয়তলার ওপর ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে ফায়ার সার্ভিসের ছাড়পত্র নেওয়া বাধ্যতামূলক হলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে তা মানা হয়নি। ইমারত বিধিমালা অনুযায়ী, ভবনগুলোতে বিকল্প সিঁড়ি থাকতে হবে। থাকতে হবে জরুরি বহির্গমন পথ। পর্যাপ্ত ও কার্যকর অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্র, আলোবাতাস প্রবাহের পরিসর। সব ইমারতে জরুরি প্রস্থান প্রদর্শনকারী দিক চিহ্ন থাকতে হবে। ২০ মিটার বা এর বেশি উচ্চতায় এক বা একাধিক তলা আছে এমন ভবনে অগ্নি নিরাপদ সিঁড়ি থাকতে হবে। জরুরি বহির্গমন পথকে অন্য কোনো কাজে ব্যবহার করা যাবে না, যাতে চলাচলের পথ বাধাগ্রস্ত হয়। অপ্রতুল সুবিধা থাকলে কর্তৃপক্ষ তা ব্যবস্থা করার নির্দেশ দেবে। এই নিয়ম কয়টি মার্কেট না ভবনে মানা হয়েছে তা আমাদের জানা আছে নিশ্চয়ই। তা সিডিএ ও ফায়ার সার্ভিসও জানে কিন্তু দুর্ঘটনা না ঘটলে, প্রাণহানি না হলে তারা তৎপর হবে না। দুর্ঘটনার পর সোজাসাপটা বলবে অনুমোদনহীন‘, বলবে, ‘আমাদের সতর্কবার্তা আমল দেয়নি তারা

এই যদি হয় বাস্তবতা তাহলে অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা দূর হবে কী করে? আর কত মানুষ প্রাণ হারালে লঞ্চ ও বাসের ফিটনেস ঠিক থাকবে, ভবনের অনুমোদন নিশ্চিত হবে, অনুমোদন ছাড়া ভবন তৈরি বন্ধ হবে, অনুমোদন ছাড়া যেখানেসেখানে হোটেলরেস্তোরাঁ খুলে বসা বন্ধ হবে।

লেখক : কবি, সাংবাদিক।

পূর্ববর্তী নিবন্ধবঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ভাষণ কেন অবিনশ্বর?
পরবর্তী নিবন্ধবোয়ালখালীতে চেয়ারম্যান স্মৃতি অলিম্পিক ফুটবল টুর্নামেন্ট সম্পন্ন